সময় চলে। চলে। ঘন্টা। দিন। মাস। বছর। সতত আবর্তনশীল সময়। সময় সবসময় একই রকম থাকে না। কখনো মধুর। কখনো অম্ল। আবার কখনো অম্ল-মধুর। সময় তার এই পথচলায় আমাদেরকে সঙ্গী করে নেয়। সময় পাল্টায়ও। সেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে আধুনিক বা উত্তরাধুনিক। সময় ইতিহাস হয়ে থেকে যায় তার ধরন-ধারণের মধ্যে। তবে সময়ের সবচেয়ে বড় যে গুণ, তা হলো সময় অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। এর বিপরীত ব্যাখ্যাও থাকতে পারে। কিন্তু Time is the best healer – এটা মন থেকে মেনে নিয়েই সময়ের হাতে আমরা অনেক কিছু সঁপে দিয়ে নিশ্চিত বা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সময়ের এই পরিভ্রমণে আরো একটি বছর চলে গেলো। ১৪২১ বঙ্গাব্দ। আমাদের নাগরিক জীবনে খ্রিস্টাব্দ-এর প্রভাবই বেশি। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের অফিস-আদালতে ও জীবনযাত্রায় খ্রিস্টাব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবু বাঙালি জীবনে, বাংলাদেশিদের জীবনে ও চলনে বাংলা বছরের গুরুত্ব কম নয় মোটেও। কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশে এখনো কৃষকগণ বাংলা সাল হিসেবে নিয়ে, পঞ্জিকা দেখে তাঁদের কাজকর্ম করে থাকেন। বাংলা সালকে ধর্তব্যে নিয়ে রচিত খনার বচন এখনো অনেক জনপ্রিয় ও নির্দেশনামূলক বাঙালি জীবনে।
বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে তাই বাংলা নববর্ষ বাঙালি জীবনে আসে উদ্যম আর নতুন চেতনার উৎস হয়ে। বৈশাখ তাই বাঙালির চেতনার অংশ। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে আয়োজিত হয় হালখাতার। বাংলা সালের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া হলো হাল্ছখাতা। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খুলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষ্যে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিস্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে “হালখাতা”-র উদ্ভব।
“পুরনো হিসেব আপডেট করে নিতে হালখাতা
মিস্টি দিয়ে মৈত্রীর বন্ধন; নয় কোনো ঝালকথা।
বাংলার ঐতিহ্যটা প্রীতির
বাণিজ্যে বসতি নীতির
হালখাতা সম্প্রীতি ছড়াক; মেলে দিয়ে ডালপাতা।”
বাংলা নববর্ষ বরণে চলে না না বাঙালি আয়োজনের ডালি। নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে রয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির।
অধুনা, বাংলা নববর্ষ ঘিরে ব্যবসা বাণিজ্যও গড়ে ওঠেছে অনেক। দেখা যায় অনেক নতুন আচার ও আয়োজনের যা ঠিক বাঙালি সংকৃতির সাথে যায় না। কারো কারো মাঝে একধরনের “পান্তা-ইলিশ খেতেই হবে” টাইপের ভ্রান্ত বিলাসিতাও কাজ করে।
বর্ষবরণে তাই সচেতনতা প্রয়োজন। অপসংস্কৃতি যাতে আমাদের গ্রাস করতে না পারে- সেই সচেতনতা। আশেপাশের কেউ যাতে আনন্দ বঞ্চিত না হয়- সেই সচেতনতা।
“নয় বিষাদ ক্লেদ দুঃখ; থাকুক প্রাণে-মনে হর্ষ,
বৈশাখের প্রথম দিন আজ; আজ শুভ নববর্ষ।
পুরাতন জরা সব নাশে,
নবরূপে বৈশাখ আসে
সব-জীবনে সুখ আনে শতরূপে উৎকর্ষ।”
বাংলা নতুন বছর ১৪২২ সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য।
শুভ নববর্ষ ।
========
সোআপ
১৩/০৪/১৫
(চৈত্রের শেষ দিন)
-
সহায়কসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
Comments (0)
ঝরঝরে লেখাটিতে অনেক ভাললাগা রেখে সাথে রইলাম।
শুভেচ্ছা...
অনেক অনেক ধন্যবাদ মামুন ভাই। আপনার জন্যও শুভকামনা সব সময়।
মানুষের মনের খুব গভীরে যে মনটি থাকে সেখানে জায়গা করতে না পারলে তার সংগী হওয়াটাই বৃথা। চিন্তার খুব গভীরে টাচ করেছেন সোহাগ ভাই। দারুন লেগেছে গল্প।
খুব মন দিয়ে গল্পটা পড়েছেন বুঝতে পারছি জিয়াউল ভাই। আপনার সুচিন্তিত মন্তব্য আমাকে খুব উৎসাহিত করল। শুভকামনা আপনার জন্য।
ভালো লাগলো গল্পটি। অনেক সাবলীলভাবে লিখিত।
শুভেচ্ছা ও সমর্থন রেখে গেলাম।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই সুমন সাহা। আপনার জন্য শুভকামনা নিরন্তর।