Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কে এম রাকিব

১০ বছর আগে

লেখকের দরবারে

লেখক হওয়ার খুব ইচ্ছে আমার। কিভাবে লেখক হওয়া যায় সেই ধান্দায় আছি। 'ধান্দা' শব্দটি আপনাদের পছন্দ না হতে পারে কিন্তু এই বান্দার ক্ষেত্রে এটাই সত্যি। লেখক উইলিয়াম ফকনার বলেছেন, লেখক হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে অন্তত চল্লিশ বছরের সাধনা (দুষ্টু লোক প্রশ্ন তুলবে, জিম্বাবুয়েতে মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৪০ বছরেরও কম  সেখানে এত দীর্ঘকালীন সাধনা বুদ্ধিমানের কাজ হবে?) তবে এসব কথায় কান দেয়ার লোক আমরা না, অন্তত আমি না। লেখক হওয়ার সুবিধাজনক আর শর্টকাট যত রাস্তা আছে আমি ইদানিং খোজার চেষ্টা করছি। সেগুলোর  মধ্যে একটা হল খ্যাতিমান লেখকদের বাসায়  গিয়ে হাত কচলে স্যার স্যার করে কিছু উপদেশ নিয়ে আসা। তেমনি একদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম দেশের  নামজাদা এক সাহিত্যিকের কাছে। উদ্দেশ্য লেখালেখি বিষয়ে কিছু জ্ঞান সঞ্চয়। এই বস্তু তার  কাছে প্রচুর পরিমানে মজুদ আছে। আমার আন্ধা চক্ষে জ্ঞানের রোশনি যে সেদিন পড়েছিল, তার নমুনা পাঠক অবশ্যই পাবেন।

স্যার কেমন আছেন?
ভাল থাকা বিষয়টা হচ্ছে আপেক্ষিক। বুঝলে? কেউ দেখবে রাস্তায় ঘুমাচ্ছে, জিজ্ঞেস করলে বলবে, 'আল্লায় রাখছে ভালোই' আবার কেউ দেখবে সব আছে গাড়ী বাড়ি অর্থকড়ি সবই বেশি। তাও বলবে, 'আর থাকা ! আছি কোন রকমে' , কিংবা বলবে, 'ভালো লাগে না কিছু'।  বলেই পিরিচ থেকে দুটি আঙুর মুখে পুরলেন। তারপর বললেন,  কারো থাকা ফিনফিনে মসৃন, আবার কারো মোটা বা স্থূল। আসলে দৃষ্টিভঙ্গিই সব। বুঝলে?   
তা কি মনে করে? সাক্ষাৎকার বুঝি? কোন পত্রিকা?

না স্যার, কোন পত্রিকা না,  আপনার কাছে কিছু উপদেশের জন্য এসেছি।
মনে হল তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন। তবে উপদেশ দেয়ার লোভ সামলানো কঠিন।  মুহুর্ত পরেই দেখলাম চামড়ার ভাজ খুলে তার কপাল সমতল হয়ে এলো। আশ্বস্ত হলাম।
বললেন, কয় বছর ধরে লিখছ?
এই শুরু করব স্যার, এখনো শুরু করিনি। তার আগে কিছু উপদেশ নিতে চাই ভাল লেখকদের থেকে। সবার আগেই আপনার কাছে এলাম (এটা নির্জলা মিথ্যে, উদ্দেশ্য তৈল প্রদান)
উপদেশ দেয়া আমার দ্বারা সম্ভব না। দিলেও লাভ হয় না, উপদেশ যদিও উমদা চিজ  কিন্তু তাতে বদহজম ছাড়া অন্য কিছু হয় বলে মনে হয় না। তা এসেছ যখন কষ্ট করে , বসো, গল্প করি( নরম সুরে, বললেন)
মানে বড় লেখক হওয়ার জন্য কি জরুরী?
 পাঠককে নিয়ে ভাবা জরুরী, তোমার নিজের লেখা নিয়ে নয়। আগে দেখবে পাঠক কি খেতে চায়। কেউ খুশি চোলাই মদ পেতে, আর কেউ উশখুশ করে গনধোলাই খেতে অর্থাৎ কোন ফুলে কোন দেবতা তুষ্ট সেটা তোমাকে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে। তুমি জোর করে কিছু খাওয়াতে পারবে না, মহান সাহিত্য একটা ভুয়া জিগির। কাফকা, ভ্যান গঘের মত শিল্পীর জীবদ্দশায় কেমন কেটেছে জান না? এমনকি আমাদের চোখও ভুল দেখে, কান ভুল শোনে সবই আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। আমার 'জীবন থেকে নেয়া' একটা ঘটনা বলি। আমি তখন ভার্সিটির ছাত্র। মাথার ভেতর, মহান সাহিত্য রচনার ভূত। দিনরাত লিখি কেউ চেনেনা। মনে মনে প্রত্যেক দিন তিক্ত দুনিয়া আর পাবলিকের রুচিকে গালাগাল করি। একদিন মুড়ির টিন মার্কা এক বাসে মডেল দেখতে দেখতে যাচ্ছি , হঠাৎ  যেন চোখে পড়ল দেয়ালে, 'মহান গরল কলেজ'। অনেকক্ষণ ভেবেও বুঝলাম না, মহান বিষের আবার কেমন কলেজ! শেষে বুঝলাম ওটা ছিল, মহানগর  ল কলেজ। অবচেতন মনের ইচ্ছা অনুযায়ী  চোখ ভূল দেখেছে। তাহলে ইচ্ছাটাই আসল। বুঝলে? শোপেনহাওয়ারও তার ইচ্ছার দর্শনে এসব বলেছে, অবশ্য তার জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে।

জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগার। বললাম, জ্বি স্যার। স্যার মৌলিক লেখা লিখতে চাই ...
হা হা হা, হাসালে, মৌলিক আবার কি জিনিস? একমাত্র আদম হাওয়া ছাড়া কিছুই মৌলিক না, সরি ধর্মমতে হাওয়াও মৌলিক না, আদমের পাজরের হাড় দিয়ে তাকে বানানো হয়েছে। আর তুমি চাও মৌলিক লেখা লিখতে! আরে মৌলিক সাহিত্য হচ্ছে সেটাই যে সাহিত্যিক চুরি সমালোচকেরা ধরতে পারে না।
একটা বিদেশী বই পড়বে, কাহিনী কিছুটা বদলে নিজের কথা ঢুকিয়ে  বাংলায় চালিয়ে দেবে। মৌলিক বই!
কিন্তু স্যার চুরির অভিযোগ তোলা হতে পারে, তাছাড়া নিজের কথা সেই বিদেশী কাহিনীর সাথে মেলানোও কঠিন।
তাহলে কিছু করতে হবে না, কেবল স্থান কাল পাত্র-পাত্রীর নাম বদলে বাংলা করো আর শেষে লিখে দাও বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে। কারো কিছু বলার থাকবে না।

 বেস্ট সেলার বই লিখতে ইচ্ছা হয়, ফেব্রুয়ারীর বইমেলা এলেই বুক টা ধক ধক করে, আহারে একটা বেস্টসেলার যদি লিখতে পারতাম! আপনি তো অনেকগুলো বেস্টসেলারের রচয়িতা......( মিন মিন করলাম)
মনে হল স্যার একটু নড়ে উঠলেন। তারপর বললেন, তোমার সাথে কথা বলে আজ মজা পাচ্ছি, তবে যাই বলি মনে রাখবে, বিটুইন ইউ এন্ড মি!
ইয়েস স্যার মনে থাকবে।

সিনেমার নায়কের চোয়াল যেমন সর্বদা উন্নত হবে, যেমন আধুনিক গায়কের গান গাইবার সময় গলার রগ দপদপ করা ইজ এ মাস্ট, ঠিক তেমনি বেস্টসেলারের কতগুলো মৌলিক উপাদান থাকবে। যেমন ধর, নায়িকা হবে পরীর মত রূপবতী, পড়বে অপরাজিতার মত নীল শাড়ি, থই থই জোছনা কিংবা বরষায় ভরসাহীন বিরহে অহরহ কাতর হয়ে পড়বে আর অতি অবশ্যই জীবনান্দের কবিতা ভালবাসবে, যুগের হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে এখন ইংরেজি কবিতার ব্যবহার আরো  নিরাপদ। বইয়ের মূল বিষয় হবে প্রেম। 'যেই প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়' সেই প্রেম সাপ্লাই দিতে হবে। বুঝলে?

এতেই হবে?

না আরো আছে, কাহিনীর মধ্যে, ক্যারেক্টারের মধ্যে ইচ্ছাকৃত পিকিউলিয়ারিটি নিয়ে আসবে। মুদ্রাদোষ চলবে খুব ভাল।

স্যার মুদ্রাদোষ?

হুম মুদ্রাদোষ, চলবে না কেন? সৈয়দ মুজতবা আলীর তর্জনিতে মাথার চুল জড়ানোর অভ্যাস ছিল, রবীন্দ্রনাথ বসে থাকলে সবসময় তার উরুতে ডানহাত ঘষতেন, তাদের মত বাঘা বাঘা লোকের মুদ্রাদোষ থাকলে সাধারণ চরিত্রের থাকবে না কেন? যতই মুখে ইতিবাচকতার ঝান্ডা ওড়াই না কেন, অন্যের দোষ শুনে আমরা বিমলানন্দ পাই।  ও আরেকটি জিনিস মনে পড়ল, বিখ্যাত ব্যক্তিদের কোন না কোন ভাবে জড়ানোর চেষ্টা করবে, তাতে অনেক পাঠক আগ্রহী হবে। বুঝলে?
(মুদ্রাদোষের কথায়  কেবল  একটা জিনিসবুঝলাম, স্যারের মুদ্রাদোষ 'বুঝলে?')

তবু মাথা নেড়ে বুঝলাম বলতেই, আবার শুরু করলেনঃ

তারপর ধরো বইয়ের মধ্যে একটু লঘু দার্শনিকতা পাঞ্চ করে দেবে। বুঝতে পারনি তো? আচ্ছা বোঝাচ্ছি। শুধু বেস্ট সেলার হলে চলবে? এওয়ার্ড- টেওয়ার্ড পেতে হবে না দুই একটা?

আমার চোখ চকচক করে উঠল। বললাম, ইয়েস স্যার।

এজন্য বললাম। কি করবে?  মনে করো রাস্তায় ক্যারেক্টার দেখল একটা কুকুর বা বেড়াল,তখন তোমার ক্যারেক্টার আর সেই কুকুর বা বিড়ালের মধ্যে চলবে তুলনা আর প্রতিতুলনা। ফিলোসফিক্যাল ডিজায়ার স্যাটিসফাইড। কিন্তু সাধু সাবধান, ডোজের দিকে খেয়াল করবে। কড়া ডোজে হিতে বিপরীত হতে পারে।

স্যার এগুলোও  তো সাধনার ব্যাপার।শর্টকার্ট কোন রাস্তা নাই?

তাও আছে ।মনে কর, লিখে তোমার একটু-আকটু নাম হয়েছে। তখন কি করবে তোমার কয়েকজন কঠিন সমালোচক খুঁজে বের করবে আর কষে গালাগাল দেবে, তারপর তোমাকে বিখ্যাত বানানোর দায়িত্ব ওরাই নেবে। বইয়ের কাটতি বেড়ে যাবে হু হু করে।

কিন্তু কঠোর সমালোচক খুঁজে বের করব কিভাবে?

হুম এখানেও সাধু সাবধান! যারা তোমার লেখা অপছন্দ করে তারাই কিন্তু তোমার কঠিন সমালোচক না, বরং তাদের তাদের মধ্যে তুলনায় যারা মেধাবী তাদের বাছাই করবে। তাদের বাছাই করবে কিভাবে?
বলে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন। আমিও হ্যা সুচক মাথা নাড়লাম। আবার শুরু করলেন-
গল্পের মাধ্যমে বলি। বুঝে নিও। একদিন সকালে রাস্তায় দেখি একটি কুকুর তার অন্ধ প্রভুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সম্ভবত অফিসে। একপর্যায়ে হিসি করে প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। অবাক কান্ড, রাগ না করে বরং পকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে ধরল আর কুকুরটা খেয়ে নিল। অবাক হয়ে আমি ছুটে গিয়ে বললাম, ভাই আপনার প্যান্টটা ভিজিয়ে দিল আর আপনি মুখে বিস্কুট ধরলেন? আপনি খুব দয়ালু। লোকটি বিরক্ত হয়ে বললেন, ধুর! রাখেন আপনার দয়ালু!  আমি বিস্কুট দিয়ে বুঝতে চাচ্ছি এর মাথাটা কোথায় যাতে পাছায় কষে লাথি দিতে পারি!

হে হে , বুদ্ধিমান! বুদ্ধিমান।

সফল হতে চাইলে তোমাকেও এভাবে বুদ্ধিমান হতে হবে। আর একটা জিনিস। যখনই সময় পাবে, পাঠক আর পাঠকের মনস্তত্ব নিয়ে পড়বে। যেমন এদেশে বইয়ের পাঠক মূলত কারা? যারা দুপুরে খাবার পরে ভাত ঘুম আসার আগেই গড়াগড়ি দিতে দিতে বই টেনে নেবে। তারা কোন বই পড়তে চাইবে? কিংবা যাদের ঘুষ খেতে হয়, নই্লে ঘুষি খেতে হয় তারা কোন ধরনের বই পড়বে? আসল কথা হচ্ছে বইয়ের পাঠক হচ্ছে তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেনি। তাদেরকে বুঝতে হবে ভাল করে। নমুনা দেব?

দিন ! স্যার দিন!-সোৎসাহে বললাম।

মনে করো একটি লোকের চোখের সামনে কাউকে ধোলাই দেয়া হচ্ছে, কিংবা রামদা'র কোপে কোন কান্ডজ্ঞানহীনের মুন্ডু নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। তখন সে কি করবে?

কোন ভাবে লোকটিকে বাচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। পুলিশেও খবর দিতে পারে।

পুলিশে খবর দেবে? হা হা তোমার সেন্স অফ হিউমার ভাল। পুলিশে তো খবর দিবেই না। পুলিশের উপর মানুষের সেই আস্থা নাই। পুলিশ সম্পর্কে কবি বলেছেন,' A thing of duty is boy forever' । সেই চিরকেলে বালক কি করবে? আসলে লোকটি তখন জাস্ট টিভির চ্যানেল বদলে ফেলবেন।

হা হা মজা পেলাম। স্যার।( সত্যি স্যার মজা করে কথা বলেন)

মজাই পেতে হবে, যেমন ধর, পাবলিক যে আমার লেখা খাচ্ছে, তা কেন? মজা পাওয়ার জন্যই তো!
আর পাঠকের মনে আঘাত দেবে না। ভুলেও জ্ঞান দিতে যাবে না। আতেল হলে তো বাতিল হলে।  তাদের ধ্যান ধারনা বদলানোর দায়িত্ব তোমার না। এখানে  কোন স্বামী  তার স্ত্রীর কপালে একটা চুমু খেলে অশালীনতা, কিন্তু স্বল্পবসনার জলসিক্ত অঙ্গসঞ্চালনা কিন্তু অশালীন না। এসব ভেবে দেখেছ কখনো?

না স্যার ভাবিনি কখনো।
ভাববে ভাববে। কিন্তু খোকা  তাদের এই মানসিকতা থেকেই তুমি সুবিধা নিতে চাইবে। এদের ডিমান্ড কম। মজা চায়। বুঝলে?

জ্বি স্যার।

তোমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম এগুলো কাউকে বলো না। তুমি শ্রোতা হিসেবে ভাল।

থ্যাংক ইউ স্যার। আমি তাহলে আসি আজ।

এসো তাহলে। আরকটা কথা আমার নতুন উপন্যাসটি নিয়ে একটা রিভিউ লিখে দিও। তরুনরা তাহলে আকৃষ্ট হবে।

অবশ্যই দেব স্যার ।আপনি আজ আমার জ্ঞাননেত্র খুলে দিয়েছেন। আসি স্যার। -- বলে বাসা থেকে বের হলাম। বাইরে দেখলাম, স্যারের 'থই থই জোছনা' আমার মনে পরদায় ভেসে উঠল, অপরাজিতার মত নীল রঙের শাড়ি পরিহিতা বিরহিনী, মনে পড়ল বরষা, জীবনানন্দ, ইংরেজি কবিতার ব্যবহার। মন আনন্দে ডগমগ করে উঠল। মনে হল এবারের বইমেলায় তো হল না আগামী বই মেলাতেই দুর্ধষ প্রেমের বই নিয়ে হাজির হব।



৩ Likes ৪১ Comments ০ Share ৫৬৬ Views