Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

১০ বছর আগে

লালন অনুসন্ধানে ছেঁউড়িয়া ভ্রমণ

শফিক সোহাগঃ 


আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্ববাদের অমর সাধক ফকির লালন শাহকে গভীরভাবে জানার আকাঙ্ক্ষা আমার বহু আগে থেকেই ছিল। সেই সাথে ছিল লালন আখড়া ভ্রমণের সাধ। দীর্ঘ চার বছর ধরে লালনকে নিয়ে নানা অন্বেষণ করেও তাঁকে পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি। আর ব্যর্থ হবই না কেন? বহু পণ্ডিত গবেষকগণও তো ব্যর্থ হয়েছেন লালন রহস্যের অতলে পৌঁছাতে! তবে লালন রহস্য অন্বেষণে ব্যর্থ হলেও ইতিমধ্যে পূরণ হয়েছে আমার লালন আখড়া ভ্রমণের সাধ। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলাস্থ গাড়াগঞ্জে আমার বোনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে তাদের কাছে বহুদিনের সাধের বিষয়টি প্রকাশ করতেই আমার বেয়াই সাজ্জাদ (বোনের দেবর) আমাকে আশ্বস্থ করল পরের দিনই তা পূরণ করা হবে।

ঠিকই পরদিন সকাল ১০:৩৫ টায় আমরা রওনা হই। আমি ড্রাইভ করছি; সাথে আছে সাজ্জাদ। আনুমানিক ৩৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশ করি।

গাড়ি থামিয়ে দু’জন চা পান করে নিলাম। সেখানে দুধ চা পাওয়া বড়ই দুষ্কর। রঙ চায়ের চাহিদাই বেশি; তাও আবার আদা লেবু ছাড়া। আমরা কুষ্টিয়া শহর থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ছেঁউড়িয়া গ্রামস্থ লালন আখড়ায়।

লালন আখড়ার প্রবেশমুখে পৌঁছার পর আমি বিস্ময়ের সাথে চারদিক দেখতে লাগলাম। আখড়ার প্রবেশদ্বারের আশেপাশে রয়েছে বহুসংখ্যক চমকপ্রদ শো-পিসের দোকান। সেখানে একতারাসহ হরেক রকম বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি গাছের শিকড় আর কাঠের তৈরি নানান জিনিসপত্রে ঠাসা। কিছু কিছু দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে তাবিজ-কবজ-মাদুলি, আংটি ও লালনের প্রতিমূর্তি। সর্বত্র সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি-ফতুয়া-শাড়ি পরিহিত নারী-পুরুষ, ঢোল-খোল-করতাল আর বিচ্ছিন্নভাবে ভেসে আসা একতারার টুংটুাং শব্দ বুঝিয়ে দেয় এ এক অন্য জগত!

আমরা প্রবেশদ্বার হয়ে আখড়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম এবং কৌতূহলী হয়ে চারিদিক দেখতে লাগলাম। লালন আখড়ার মোট আয়তন সাড়ে ১৪ একর। সরকারি সহায়তায় সেখানে গড়ে উঠেছে লালন একাডেমি ভবন ও কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্স ভবনে রয়েছে পাঠাগার, রিসোর্স সেন্টার আর অডিটোরিয়াম। বাম দিকের নিচ তলায় লালন জাদুঘর। মাজার কমপ্লেক্সে লালন শাহসহ মোট ৩২টি সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে লালন সমাধির পাশে তার পালিত মাতার সমাধি এবং বাহিরে পালিত পিতার সমাধি রয়েছে। এছাড়াও ১৪টি লালন শাহের মুরিদ, ১টি প্রশিষ্য আর বাকিগুলো তার অনুসারিদের।

আখড়ার চারপাশ ঘুরে আমরা লালনের সমাধির সামনে আসি। সেখানে এসে সাক্ষাৎ করি তার মাজারের খাদেম ফকির আলী শাহের সাথে। সাদা পাঞ্জাবি সাদা লুঙ্গি ও সাদা পাগড়ি পরিহিত ছিলেন তিনি। গলায় মালা এবং মুখে বেশ লম্বা সাদা চাপ দাড়িতে পুরো দরবেশ ভাব। আমি তার কাছে আমার পরিচয় পেশ করার পর তিনি বেশ আন্তরিকতার সহিত আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তার কণ্ঠে অসাধারণ সাধু ভাষার প্রতিটি শব্দ উচ্চারণই ছিল স্পষ্ট। চমৎকার ছিল তার বাচনভঙ্গি। তিনি লালন শাহের জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে আমাদের কাছে উপস্থাপন করলেন। এরপর আমি তার কাছে একটির পর একটি প্রশ্ন ছুঁড়তে লাগলাম। তিনি অত্যন্ত গোছালোভাবে প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন। অতঃপর লালন আখড়ায় অবস্থানরত কয়েকজন লালন অনুসারির কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। লালনের মাজারের খাদেম ফকির আলী শাহের নিকট হতে পাওয়া তথ্য, লালন অনুসারী ও লালন গবেষকদের নিকট হতে পাওয়া তথ্য এবং আমার দীর্ঘ চার বছর যাবৎ লালন অন্বেষণ থেকে লালন সম্পর্কে অর্জিত অতি ক্ষুদ্র জ্ঞান পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরলাম;



দেহতত্ত্ববাদের অমর সাধক ফকির লালন শাহ ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান নিয়ে নানাজন নানা বর্ণনা দিয়েছেন। ফলে লালনের জীবনী সম্পর্কে কিছু লিখার সঠিক উপকরণ পাওয়া বড়ই কঠিন। আর তাই লালনের মৃত্যুর পর ‘হিতকরী’ নামক পত্রিকা লিখেছিল, ‘ইহার জীবনী লিখিবার কোনো উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না, শিষ্যরা হয়তো তাহার নিষেধক্রমে না হয় অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না।’

কারো কারো মতে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের ভাঁড়রা গ্রামে লালন জন্মগ্রহণ করেন। আবার এমন তথ্যও প্রচারিত রয়েছে যে, লালনের জন্ম ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। তবে জন্মস্থান নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আবু তালিব ও লালন গবেষক ড. খন্দকার রিয়াজুল হক তাদের গবেষণায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছেন লালনের জন্মস্থান হরিশপুর গ্রামেই।

লালনের দীক্ষা জীবন সম্পর্কে তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। একটি হল- হরিশপুর গ্রামের গরিবুল্লা দেওয়ান ও আমেনা খাতুনের সন্তান লালন শিশুকালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার পিতা-মাতা তাকে বড় চারিতে করে ভাসিয়ে দেন নদীতে। হরিশপুরেরই বটকেমারার ঘাট থেকে দরবেশ সিরাজ শাহ লালনকে  উদ্ধার করেন। সাধক সিরাজ শাহের কাছ থেকে লালন দীক্ষা নেয়া শুরু করলেন এবং সেই সাথে করতেন সাধন-ভজন। একদিন সিরাজ শাহ লালনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এখানে তোমার দীক্ষা জীবন শেষ হয়েছে। আগামীকাল প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের আগেই তুমি হরিশপুর ত্যাগ করবে এবং সারাদিন হাঁটবে। যেখানে সূর্যাস্ত যাবে সেখানেই তুমি আস্তানা করবে।’

লালন তার গুরুর নির্দেশ মত সূর্যোদয়ের আগেই হরিশপুর ত্যাগ করেন এবং উত্তর দিকে হাঁটতে থাকেন। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়ার কালী নদীর পাড়ে পৌঁছুতেই সূর্যাস্ত হয়। গুরুর নির্দেশে এখানেই গড়ে তোলেন আখড়া।

দ্বিতীয় তথ্য মতে, লালন নিজের থেকেই একই গ্রামের স্বনামধন্য বাউল সাধক দরবেশ সিরাজ শাহের শিষ্যত্ব লাভ করেন। গুরুর নির্দেশে তিনি হজ্ব করতে মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা হন। ভারতবর্ষ ঘুরে বিভিন্ন তীর্থস্থান পরিদর্শন করেন। পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করেন। এ সময় লালন পড়ে থাকেন কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে কালী নদীর ধারে। ওই গ্রামের এক হিন্দু কায়েস্ত তাকে বাড়ি নিয়ে যান এবং সেবা যত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন ছেঁউড়িয়াতে অবস্থান করেন এবং এখানেই তিনি সাধন কর্মের মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ ঘটান।

কিন্তু লালন আখড়ার খাদেম ফকির আলী শাহসহ বেশ কিছু লালন অনুসারিগণ জানিয়েছেন ভিন্ন মত। তাদের মতে, লালন শাহের বয়স তখন আনুমানিক ষোল বা সতের বছর। পূণ্য লাভের জন্য তিনি তীর্থ ভ্রমণে বের হন। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করেন। মতিজান ফকিরানী নামক এক মুসলিম নারী নদীতে পানি আনতে গিয়ে দেখেন কলাগাছের ভেলার উপর শুয়ে আছে বসন্ত আক্রান্ত এক কিশোর। মতিজান ফকিরানী তাৎক্ষণিক তাঁর স্বামী মাওলানা মলম শাহকে ডেকে এনে দেখালেন। মাওলানা মলম শাহ দেখলেন কিশোরের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। মুসলিম এই দম্পত্তি ছিলেন নিঃসন্তান। তারা এই কিশোরকে নিজেদের ঘরে এনে অনেক সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। এই কিশোরই হলেন লালন, আর মাওলানা মলম শাহ ও মতিজান ফকিরানী হলেন লালনের পালিত পিতা-মাতা।

লালনের কিছু অনুসারি জানান, সুস্থ হওয়ার পর লালন গুরু সিরাজ শাহের সান্নিধ্য পান। চলতে থাকে গান-বন্দনা, সাধন-ভোজন। কিন্তু বাড়ি তার মনকে বার বার ডাকে। সেই ডাকেই একদিন তিনি ফিরে যান নিজ গ্রামে। দুঃখের বিষয়; মুসলিম পরিবারে খেয়ে লালনের জাত গেছে এই বলে স্বজনরা লালনকে ঘরে প্রবেশ করতে দেননি। তাইতো লালন বলেন-

‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সব দেখি তা না-না-না।’

নিজের বাড়ি থাকতেও গৃহহীন হয়ে পড়েন লালন। নিজের পরিবার স্বজন থাকতেও তার আর কেউ থাকে না। তিনি পুনরায় ফিরে যান তার পালিত পিতামাতার কাছে এবং শুরু করেন সাধনা। লালনের সহধর্মিনী তার সঙ্গী হতে চেয়েও সমাজের বাধার কারণে পারেননি। লালনহীন সংসারে কয়েক বছর পর তার মৃত্যু হয়।

সাধক লালন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। লালন আখড়ার খাদেম ফকির আলী শাহ মারফত জানতে পারি মহাগ্রন্থ আল কোরআন সম্পূর্ণ মুখস্ত ছিল লালনের। তার পালিত পিতা মাওলানা মলম শাহ প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর কোরআন তিলাওয়াত করতেন। একদিন লালন তার পালিত পিতার কোরআন তিলাওয়াত শুনে বিরূপ মন্তব্য করে বসলেন। বললেন, ‘কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ হচ্ছে না।’ একথা শুনে তার পালিত পিতা বললেন, ‘ঠিক আছে তুমিই শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করে শোনাও।’ লালন জবাব দিলেন, ‘কোরআন আপনার কাছেই থাক, আমি পড়ছি আপনি মিলিয়ে দেখেন।’ (সূত্র: ফকির আলী শাহ, খাদেম লালন আখড়া)।

অমর সাধক লালনের গানের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি হবে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি গানের সাধনায় মগ্ন ছিলেন। তার মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘এই তোরা কে কোথায় আছিস? আমার কাছে আয়, আমার এখন পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’ লালন বলতেন আর ফকির মনির উদ্দিন শাহ তা লিখে রাখতেন। মাঝে মাঝে লালন হৈ হৈ করে উঠে বলতেন, ‘লিখিস না; ছিনায় রাখ। এসব গান লোকে জানলে সারা বিশ্বে হৈ চৈ হবে। কেউ বুঝবে, কেউ বুঝবে না।’ মনির উদ্দিন শাহ লিখে রাখতেন আর সুর করতে মানিক শাহ। এতো বিপুল সংখ্যক গান এখন পাওয়া যায় না। কিছু কিছু শিষ্যের মৃত্যুর পর অছিয়ত মোতাবেক গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। 

লালনের প্রায় প্রতিটি গানেই আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও জৈবিক এ তিন প্রকার ব্যাখ্যা থাকে। এসব ব্যাখ্যা বুঝতে হলে জানতে হলে প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা। লালনকে খুঁজতে, লালনকে বুঝতে অগত্যা তার গানের কাছেই যেতে হয়। গানের মধ্যেই তিনি পুরো মাত্রায় বিদ্যমান থাকেন। সাধুদের কাছে লালনের গান শুধু গানই নয় বরং জ্ঞানও বটে। সে কারণে সুরের চেয়ে পদাবলির অন্তর্জালে বিরাজিত সার কথাই বাউল সাধানার পরম বস্তু।

ফকির লালন কোন জাত বা কোন ধর্ম মানতেন তা নিয়েও নানা মত রয়েছে। গবেষকরাও হন্যে হয়ে আগত্যা বিবিধ মত-দ্বিমত দিয়েছেন। লালনের জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল তাঁর ‘মহাত্মা লালন’ নামক নিবন্ধে বলেছেন, ‘সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, একথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম’ মুসলমান সাধকদের যুক্তিমতে, আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বলেই লালন তার গানে নিজের পরিচয় দিতে ফকির লালন, অধম লালন, দরবেশ লালন ইত্যাদি উপাধি যোগ করেছিলেন। আবার হিন্দু সাধকরাও ফকির পদের পাশাপাশি সাঁই-গোসাই ইত্যাদি সম্বোধন করে তাকে ডাকেন। ’ হিতকরী পত্রিকার মতে, ‘লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। অথচ সব ধর্মের লোকেই তাকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমান দিগের সহিত তাহার আচার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাহাকে মুসলমান মনে করিত। বৈষ্ণব ধর্মের মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। জাতিভেদ মানিতেন না, নিরাকার পরমেশ্বর বিশ্বাস দেখিয়া ব্রাক্ষদিগের মনে ইহাকে ব্রাক্ষ ধর্মাবলম্বী ভ্রম হওয়া আশ্চর্য নহে; কিন্তু ইহাকে ব্রাক্ষ বলিয়ার উপায় নাই। ইনি নোমাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায়?’

 


লালন কি জাত বা কি ধর্ম মানতেন এ বিষয়ে তার সহধর্মিনী বিশখা কিংবা পরিচিত জনরাও স্পষ্ট কিছু বলে যাননি। তবে লালন আখড়ার খাদেম ফকির আলী শাহ আমাকে সরাসরি স্পষ্ট করেছেন যে, লালন শাহ অবশ্যই ধর্ম মানতেন। তার ধর্ম হল মানব ধর্ম। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের ভিতর এক অচীন মানুষ বাস করে। লালন পুনঃজন্মে বিশ্বাসী ছিলেন।

তবে জাত উদ্ধারে যত তর্কই থাকুক না কেন, লালনের জাত বিষয়ক গানগুলো বিচার করলে স্পষ্ট হয় যে, লালন সচেতন ভাবেই জাত ধর্ম গোপন রাখতে চেয়েছেন। লালন বলেন,


সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।’

প্রকৃতপক্ষে লালন নিজেই পরিচয় দিতে চাননি। নিজের জাত পরিচয় সম্পর্কে তিনি পদে পদে মূলত এক কথাই বলতে চেয়েছিলেন-


‘সবে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে
কারে বা কি বলি আমি দিশে না মেলে।’



লালন শাহ দেখতে কেমন ছিলেন? আমরা লালনের যে ছবিটা দেখি তা কি আদৌ তার প্রকৃত অবয়ব কিনা সে বিষয়েও রয়েছে ভিন্ন মত। ১৮৮৯ সালের ৫ মে তারিখে শিলাইদহের জমিদারদের হাউস বোটে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে গিয়ে হাজির হন লালন। রবি ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাকে হাতে ধরে বসিয়ে দেন দামি একটা চেয়ারে এবং পেন্সিল দিয়ে তৈরি করেন লালনের একটি স্কেচ। লালন তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ একজন মানুষ। সেদিনটির মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি লালনের স্কেচটি যা এখন ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এটাই লালনের প্রকৃত প্রতিকৃতি, বাদবাকি প্রতিকৃতি কল্পনা দিয়ে রং মাখানো।

লালন শাহের সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কখনো সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে এটা নিশ্চিত যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের প্রতি বেশ মোহিত ছিলেন। লালনের দেহতত্ত্বের একটি গান রবি ঠাকুরের কাছে খুব বেশি প্রিয় ছিল-


‘খাচার ভিতর অচীন পাখি
কমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনো-বেড়ি
দিতাম পাখির পায়।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৫ সালে ভারতীয় দর্শন মহাসভায় ইংরেজি বক্তৃতায় এই গানটির উদ্বৃতি দিয়ে বলেছিলেন, অচীন পাখি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে কত সহজে মরমি অনুভব পৌঁছে দিয়েছিলেন লালন। লালনের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ হোক বা না হোক তবে লালনের অনুসারিদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল। এক চিঠির মাধ্যমে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

‘তুমিতো দেখেছ শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমতো। তারা গরিব। পোষাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় সহজভাবে তারা বলতে পারত।’ (সূত্র: চন্দন চৌধুরী)

লালনপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর পর তার গানের খাতাও সংগ্রহ করেছিলেন। লালনগীতি সংগ্রাহক একজনকে লালন শিষ্য ভোলাই শাহ বলেছিলেন, ‘দেখুন, রবি ঠাকুর আমার গুরুর গান খুব ভালোবাসতেন, আমাদের খাতা তিনি নিয়ে গেছেন।’ এখানে উল্লেখ্য, লালন শিষ্য ভোলাই শাহ লালনের পালিত পুত্রও বটে। লালন শাহ তাকে চার বছর বয়স থেকে পেলে বড় করেন। লালনের এই পালিত পুত্র ভোলাই শাহের এক শিষ্য হলেন ফকির গোলাম ইয়াছিন শাহ। তিনি লালন আখড়ার বর্তমান খাদেম ফকির আলী শাহ এর জন্মদাতা পিতা এবং লালনগীতি শিল্পী ফরিদা পারভীনের গুরুও ছিলেন। এছাড়াও ফকির ইয়াছিন শাহ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের লালনগীতির উপদেষ্টাও ছিলেন।

১৭ অক্টোবর, ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ (১ কার্তিক, ১২৯৭ বঙ্গাব্দ) শুক্রবার প্রাতে ১১৬ বছর বয়সে মরমি সাধক লালন শাহ পরলোক গমণ করেন। মৃত্যুর রাতেও তিনি রাতভর গান করেছিলেন। তার মৃত্যু দৃশ্যটি ছিল বড়ই মর্মস্পর্শী। শিষ্যপরম্পরায় বর্ণনা পাওয়া যায়, শায়িত লালন কপালের চাদর সরিয়ে শিষ্যদের শেষবার দেখে নিলেন। বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাব। এ বলে গান ধরলেন-


‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এই ভব কারাগারে...’

 


হঠাৎ থেমে যায় গান। কাতর কণ্ঠে তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই উচ্চারণ করতে পারলেন, ‘আমি চলিলাম’।

লালন শাহের মৃত্যুর ১৪ দিন পর অর্থাৎ ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকার সহ-সম্পাদক রাইচরণ দাশ ‘মহাত্মা লালন ফকির’ নামক একটি নিবন্ধে লালন শাহের জীবন ও কর্মের উপর আলোকপাত করেন। উল্লেখ্য, গান্ধীজীরও ২৫ বছর আগে লালন শাহ মহাত্মা উপাধি পেয়েছিলেন।

লালন আখড়াস্থ লালন একাডেমি প্রতি বছর লালন শাহের মৃত্যুবার্ষিকীতে মেলা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এতে সারা দেশ থেকে লালনের বিপুল সংখ্যক ভক্ত ও অনুসারি সমবেত হন। এছাড়া ভারত, নেপাল, ভূটান, ফ্রান্স, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের সাধুসন্ত ও লৌকসংস্কৃতির অনুরাগীরাও সমবেত হন। মেলা ছাড়াও সারা বছরই লালন ভক্ত ও লালন অনুসন্ধানীরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন লালন আখড়ায়। আর জানান দিয়ে যান মরমি সাধকের প্রতি তাদের ভালবাসা। সেই সাথে চলে লালনকে আবিষ্কার করার অনুসন্ধান। তাদেরই একজন আমি। লালন আখড়া ঘুরে ঘুরে যতই দেখেছি ততই নানান রূপের তথ্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। আর হয়েছি বিস্মিত।

লালন আখড়া ভ্রমণের পর আমরা রওনা হলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ির উদ্দেশ্যে। 


শফিক সোহাগ
shafiq_shohag@yahoo.com

০ Likes ৬ Comments ০ Share ৮৫৬ Views

Comments (6)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    কবিতার মাঝে ছন্দমুখর ভাবচিত্র

    শুভ কামনা কবি দাদা

    - বাংলার পাই বাপা

    অসাধারণ।

    - মোঃসরোয়ার জাহান

    darun darun............!সুপ্রিয় বন্ধু,কেমন আছেন ?মহান স্বাধীনতা দিবস লেখা প্রতিযোগিতা২০১৪ ক্যাটাগরি ১ এ আমার কবিতা “প্রিয় স্বদেশআছে,প্রতিযোগিতার জন্য।আপনাকে কবিতাটি পড়তে আমন্ত্রণ রইল।যদি ভালো লাগে তবে আপনার মূল্যবান একটি ভোট চাই।ভালো থাকবেন শুভ কামনা রইল।