Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মাদিহা মৌ

৮ বছর আগে

রোজনামা

সৃজনশীল ব্লগিং প্রতিযোগীতা - ২০১৬ এর জন্য


এক

ন্যাপথলিনের উগ্র গন্ধে ভারী হয়ে আছে আট বাই চার ফুটের তাকটি। বছরের পর বছর এই আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো কাপড়ের নিচের নির্দিষ্ট একটা জায়গায় পড়ে আছি। নয় মাসে ছয় মাসে একবার হয়তো বাইরের আলো বাতাসের দেখা পাই আমি। যখন এই আলমারির মালকিন গোছানো কাপড়চোপড়গুলো নিপুণ হাতে আরো নিখুঁতভাবে গোছায়, তখন। তার হাতের স্পর্শে মনে পড়ে
আমার অস্তিত্ব। বাকি সময়টাতে আমি ভুলেই যাই আমি কে। কেন বছরের পর বছর আমাকে এভাবে নির্জীবভাবে পড়ে থাকতে হচ্ছে।

ন্যাপথলিনের কল্যাণে পোকামাকড় আমার ধারে কাছে আসতে পারে না। মালকিন প্রায়ই ন্যাপথলিন দিয়ে যায়। এখানে অযত্নে পড়ে থাকলেও আমাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মালকিনের ভাবনার অন্ত নেই। তার কাছে যে আমাকে কারো আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে!

মাঝেমাঝে ন্যাপথলিন দেওয়ার কিংবা কাপড় গোছানোর সময়ের ব্যবধানটা বছরে গিয়ে ঠেকে। উদ্বায়ী ন্যাপথলিন উবে শেষ হয়ে যাবার কয়েক দিন পর্যন্ত তার রেশ থেকে যায়। পুরোপুরি ভ্যানিশ হবার পরপরই পিঁপড়ে আর তেলাপোকা ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। কেন যেন সাজানো কাপড়চোপড়ের চেয়ে আমার দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি। আমার উপর হামলে পড়ার আগে আমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পুরো একদিন সময় নেয় তারা। যেই মুহূর্তে আমার উপর আক্রমণ করে, তার ঠিক আগমুহূর্তে মালকিন এসে ন্যাপথলিন রেখে যায়। ওরা আমার আশেপাশে মরে পড়ে থাকে। এভাবেই কাটছে আমার জীবন। এভাবেই কাটবে। মনে হচ্ছে এখান থেকে আর কখনোই বের হওয়া হবে না। এই একঘেয়ে জীবনযাপন করেই আয়ুরেখা শেষ হয়ে যাবে।

দুই

এত বকবক করে ফেললাম, অথচ নিজের পরিচয়ই দিলাম না। আমি একটা রোজনামা। আজকালকার আধুনিক মানুষজন যাকে ডায়েরি নামে চেনে। আধুনিকতার জোয়ারে রোজনামা নামটা তো প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। অথচ আগে আমাদের গায়ে ইংরেজি হরফের DAIRYর বদলে গোটাগোটা বাংলা অক্ষরে রোজনামা বা রোজনামচাই লেখা থাকতো।

আমার জন্ম হয়েছিল, কয়েক যুগ আগে, কোন একটা বিখ্যাত কাগজ কলে। আমার মালকিন যেদিন আমাকে দোকান থেকে কিনে এনেছিল, সেদিন আমার খুশির অন্ত ছিল না। একনজর দেখেই মালকিনকে খুব মনে ধরেছিল আমার। টানা টানা মায়াবী চোখে কী গভীর দুঃখ লুকিয়ে রেখেছিল সে, সেদিন বুঝিনি। কিন্তু আমি তার ওই চোখের প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম।

এই যাহ! আলমারি খোলার শব্দ পাচ্ছি। ঠিকমতো শান্তিতে বসে যে নিজের কাহিনি শোনাব সে সুযোগটাও আমার নেই! ওমা! আলমারির মালকিন যে আমাকে হাতে তুলে নিলেন! আবার খামবন্দী করে হাতব্যাগে চালান করলেন! ঘটনা কী? আমাকে হাতবদলের সময়টা বুঝি অবশেষে এল?

ঠিক অনুমানই করেছি। আমার আমানতদাত্রী আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমারই মালকিনের একমাত্র মেয়ের কাছে। 

মেয়েটা কী নিদারুণ মমতা নিয়ে আলতো করে আমাকে স্পর্শ করে। আমার পরিচ্ছন্ন দেহটাকে পরনের ওড়না দিয়ে মোছে। কিন্তু আমাকে খুলে আমার রহস্য উন্মোচন করার সাহসটুকু সঞ্চার করতে পারে না। প্রতিদিনই আমার রহস্য ভেদ করার জন্য আমাকে নিয়ে টেবিলে বসে, কিন্তু ওর কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলগুলো আমার মলাট উল্টাতে পারে না। 

ওর এই সংকোচের যথেষ্ট কারণ আছে। ও জানে, আমার ভেতরকার যে রহস্য, সে ভালো হোক বা মন্দ, তা ওকে কাঁদাতে বাধ্য। 

এতদিনে আমার টনক নড়ল। আলমারির বিরক্তিকর জীবন নিয়ে হাপিত্যেশ করতাম আমি, কারণ আমি আমার অতীত ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার অতীতের সাথে বিষণ্ণচোখো এক মায়াবতীর কাহিনি জড়িয়ে আছে। যদি না ভুলতাম, তবে আলমারির নিশ্চল নিষ্প্রভ জীবন নিয়ে কক্ষনো আফসোস করতাম না। এখন কী ভয়ানক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমার জন্য তা ভেবে আমি খুব শঙ্কিত। 

তিন

বিষণ্ণচোখা সেই মায়াবতীর কথা বলছিলাম। আমাকে কিনে এনেই ঝর্ণাকলম নিয়ে লিখতে বসে গিয়েছিল সে। প্রথমদিন কেবল লিখলো "জীবনের দুঃখমালা"। এটুকু পড়ে আমি একচোট হেসে নিয়েছিলাম। দুনিয়ার সব মানুষই নিজেকে দুঃখী ভাবতে পছন্দ করে। এই মায়াবতীও তার ব্যতিক্রম নয়। তার দুঃখমালার মধ্যেও নিশ্চয়ই সুখের উপকরণ থাকবে? অন্তত আমার তাইই ধারণা। মানুষ জানে না, দুঃখের মধ্যেই সুখ লুকিয়ে থাকে। 

আমার ধারণা মিথ্যে হয়নি। এক সন্ধ্যায় আমার প্রথম পৃষ্ঠাতেই বেগুনি রঙের কলম দিয়ে সাদামাটা একটা পঙক্তি লিখে শুভ সূচনা করেছিল সেই মায়াবতী। সাদামাটা সেই ছয়টি লাইন আজীবন মুগ্ধ করে রেখেছিল আমাকে।

"… গোধূলিরাঙা আকাশের আলোর ছটা
তারপর এক আকাশ রাতের তারা
তারমাঝে শুধু মেঘ আর মেঘ
আর নীল জোছনাকুমারী
আমি এখন জেনেছি
বড্ড বেশি সুন্দর এই পৃথিবীটা … "

তবে সেইই শেষ। আমি আর কখনো বিষণ্ণচোখা মায়াবতীর হাসি দেখিনি। শুধু কান্নাই দেখেছি। ধারণ করেছি। তারপর সেই কান্নাকে শুকিয়ে শুষ্ক অশ্রুজল জমিয়ে রেখেছে আমার ভেতরে। পাতায় পাতায়। খালি চোখে তা অনুভব করা যাবে না। ছুঁয়ে দেখতে হয়।

আমার মনে আছে, ওর ভেজা চুলের গড়িয়ে পড়া শুষ্কপানিও আছে আমার কোন পাতায়। কোন এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে এসে ভেজা এলোচুলে লিখেছিল,
"… যদি তুমি আমার নীরবতা না বোঝ, তবে তুমি আমাকে বুঝবে না … "

তখনো বুঝিনি কার উপরে এত অভিমান। কারণ আমি ওর পরিবারের কাউকেই দেখিনি। আমার সামনে শুধু ও-ই আসতো। মনের ঝাঁপি খুলে বসতো নিরালায়।

দিন কয়েক পর সে আমাকে, তিন টুকরো কাগজ আর আঠা নিয়ে বসলো টেবিলে। কীসের কাগজ, বুঝিনি প্রথমে। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলাম, দুইখানা হলো ওর একাডেমিক সার্টিফিকেট, আর অন্যখানা হল চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার। সার্টিফিকেট আর এপয়েন্টমেন্ট লেটার কেন দিনলিপির পাতায় আঠাবন্দী করতে হলো, তা আমার বুঝে এল না।

পরে বুঝেছি, পড়াশুনো জানা এই মায়াবতীর শিক্ষার কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি সে পায়নি। সুযোগ হাতের মুঠোতে থাকা স্বত্ত্বেও। বরং নিরক্ষর বরের লাঞ্ছনা সহ্য করেছে দিনের পর দিন। সেসবই তো লিপিবদ্ধ করেছে আমার পাতায়। প্রথম দিকের কয়েকটা পাতা বাদে বাকি সবকটি পাতা ওর অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে। ওর দুঃখে আমিও কেঁদেছি। কিন্তু হায়, কেঁদে যদি ওর দুঃখ হালকা করতে পারতাম!

বহুদিন পর আরো ক'টি কবিতার পঙক্তি পেলাম। কথাগুলি এত সুন্দর, কিন্তু ভারি কষ্টের …

"… সবাই তো চলে যাবে, প্রশ্ন হচ্ছে কে কীভাবে যাবে।

দিন যেভাবে রাতের ভিতর যায়, সেভাবে কি?
গন্ধ যেভাবে ফুলের ভিতর যাবে, সেভাবে কি?

প্রাণ যেভাবে প্রাণীর ভিতর যায়, সেভাবে কি?
প্রাণ কীভাবে মৃত্যুর ভিতর যাবে? "

প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখতো মেয়েটা। যেদিন কিছু লিখবার থাকতো না, সেদিন নিজের নাম লিখত আলপনা করে। কখনো কখনো ওর আলপনায় অন্য একটা নাম থাকতো। মিহিকা। আমি ভাবতাম, কার নাম হতে পারে সেটা? অনেকদিন পর উত্তরটা পেয়েছিলাম, নামটা ওর মেয়ের।

এদিনের পর আর কখনো আমাকে নিয়ে লিখতে বসেনি। আমি আর কখনো ওকে দেখিনি। কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলাম ও আর কখনো ওর কান্না দিয়ে আমাকে সিক্ত করবে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে ও। 

চার

আজ অনেকদিন পর সেই টেবিলে ফিরে এলাম। যে টেবিলে বসে মায়াবতী তার দুঃখের সব কথা লিখে গেছে আমার ভিতর। ওর মেয়েটা টেবিলের উপর মাথা ফেলে, আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছে। ওর চোখের নোনাজল ফোঁটায় ফোঁটায় আমার মলাটের উপর পড়ছে। এক অশ্রুফোঁটার উপর আরেক অশ্রুফোঁটা পড়তেই ফোঁটাটির পরিধি বাড়ছে। আমি নিশ্চল থেকে গুনছি মনে মনে। সবে তো মাত্র শুরু!

মলাট উল্টে প্রথম পাতায় যেতেই চমকে উঠলো মিহিকা। উঠবেই না কেন? সাইড পাতার কবিতার পঙক্তির পর প্রথম লেখাটাই ওকে সম্বোধন করে লেখা। পরের পাতা উল্টালো, তার পরের পাতা, তার পরের পাতা … উল্টাতেই থাকলো। শেষ পাতা পর্যন্ত উল্টে গেল। প্রত্যেকটা লেখা ওকে সম্বোধন করে লেখা। অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো লেখাগুলির দিকে। ধীরে ধীরে আমার অক্ষরমালা ওর চোখে ঝাপসা হয়ে গেল। যে মেয়ে আজীবন মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে ছিল মাকে ভয় পেত বলে, সে মেয়ে যদি দেখে আস্ত একটা রোজনামা তাকে সম্বোধন করে লেখা হয়েছে, তবে সে অবাক হবে না কেন?

দ্বিতীয়বারের মত চোখ মুছে আবার প্রথম পাতায় এল মিহিকা। কিন্তু আমি তো জানি, সে যতবার আমাকে পড়বে, তাকে ততবার চোখ মুছতে হবে।

পাতার পর পাতা পড়ে গেল মেয়েটা। কোন লেখায় মেয়ের প্রতি রাগ, কোনটায় অভিমান প্রকাশ পেয়েছে। এসব লেখা পড়ার সময় কান্নাকাটি করল না মেয়েটা। কিন্তু তার পরের কয়েক পাতা পড়ে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর চেহারা দেখে আমার এত অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল যে, ইচ্ছে করছিল ওকে ঝাঁকি দিয়ে ওর ঘোর ভাঙ্গাই, কাঁদাই ওকে। হঠাত নিজ থেকেই তারস্বরে চিত্কার করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। আর বলল, 'আব্বু! তুমি সামান্য ক'টা টাকার জন্য আমার মাকে মরে যেতে বলেছ! এভাবে অভিশাপ দিয়েছ! আর এখন বছরের পর ধরে তোমার পরের বৌয়ের রোগ নিজে বয়ে বেড়াচ্ছ! নিজে রান্না করে তাকে খাওয়াচ্ছো! আর আমার মায়ের সাথে যাচ্ছেতাই খারাপ ব্যবহার করেছ! এ তোমার কেমন ইনসাফ আব্বু? এ তোমার কেমন বিচার?'

মেয়েটার কথা শুনে ওর বাবার প্রতি মনটা বিষিয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম, আমার বিষণ্ণচোখা মায়াবতী যা কষ্ট পেয়েছে, ওর মেয়েটা নিজের বাবার বদলে যাওয়া রূপ দেখে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরে রেখেছে মেয়েটা। বন্ধ চোখের দু'ধার দিয়ে অবিরামভাবে অশ্রু গড়াচ্ছে। ইচ্ছে করলো মেয়েটাকে একটু সান্ত্বনা দিই।

মেয়েটার ছায়া ছাপিয়ে বিশাল একটা ছায়া ঢেকে দিল আমাকে। ঘোরের মধ্যে থাকায় ঘরের দ্বিতীয় মানুষটার উপস্থিতি টের পেল না মিহিকা। টের পেলে নিশ্চয়ই আমাকে লুকিয়ে ফেলতো। আমার মনে কুডাক ডাকছে। মনে হচ্ছে, আজকের দিনটাই আমার জীবনের শেষ দিন। প্রাণপণ চেষ্টা করেও মেয়েটার ঘোর ভাঙ্গাতে। পারলাম না আমি। 

আমার ধারণা নির্ভুল হলো। এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে থাকলো। ঘোরে থাকা মিহিকার সামনে থেকে আমাকে খপ করে হাতে তুলে নিল ওর বাপ। একটা শব্দ উচ্চারণ না করে টেনে ছিঁড়তে শুরু করলো আমাকে। মেয়েটা পাগলিনীর মত আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেও আমার আজরাইলের হাতের এক ধাক্কায় পড়ে গেল মেঝেতে। ততোক্ষণে আমি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। এটুকু করেও ক্ষান্ত হল না লোকটা। মুমূর্ষু আমাকে নিয়ে গুঁজে দিলো আগুনের চুলায়। সর্বগ্রাসী আগুন যখন মহাউল্লাসে আমাকে বরণ করছে, তখন আমি ভাবছি, ন্যাপথলিন দেওয়া আলমারির তাকে থাকতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলাম আমি। তার উপযুক্ত পরিণামই হচ্ছে আমার। আমার সাথে সাথে আমার বিষণ্ণচোখা মায়াবতীর দুঃখমালা হারিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আত্মপ্রকাশ করে আমি ওর মেয়েটার দুঃখ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছি।

মায়াবতীর শেষ লাইন ক'টি আবৃতি করতে পারছি,
সবাই তো চলে যাবে, প্রশ্ন হচ্ছে কে কীভাবে যাবে।
দিন যেভাবে রাতের ভিতর দিয়ে যায়, সেভাবে কি?
গন্ধ যেভাবে ফুলের ভিতরে যাবে, সেভাবে কি?
প্রাণ যেভাবে প্রাণীর ভিতরে যায়, সেভাবে কি?
প্রাণ কীভাবে মৃত্যুর ভিতরে যাবে? 

আমার মায়াবতী তো জেনেছেই, এখন আমিও জানি, প্রাণ কীভাবে মৃত্যুর ভিতর দিয়ে যায়।
০ Likes ০ Comments ০ Share ৪৩৯ Views

Comments (0)

  • - মাসুম বাদল

    চমৎকার...!!! 

    • - মেঘা নওশীন

      সুন্দর...