রমিজ আমার বন্ধু। ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। সে বিয়ে করেছে প্রায় দুই বছর হতে চলল। যারা নতুন বিয়ে করবেন ভাবছেন তাদের অবশ্যই রমিজের বিবাহিত জীবনের ঘটনা জানা খুব প্রয়োজন। তাহলে বিয়ে করার পর আপনাদের বিবাহিত জীবনের সমস্যাগুলো দূর করতে পারবেন। রমিজ বলে, আমার জীবন বিসর্জন দিলাম আপনাদের জন্য। আমি যে সমস্ত ভুল গুলো করেছি- তা যেন আপনারা না করেন। বিয়ের সাতদিন পর রমিজ আমাকে খুব আক্ষেপ করে বলেছিল- দোস্ত, ক্যান তুই আমাকে বিয়ের সময় বাঁধা দিলি না। ... আহারে তখন যদি কেউ আমাকে একবার বুঝিয়ে বলত- বিয়ে করিস না, তাহলে এই... এই সমস্যা। আমি বিয়ে করতাম না। আল্লাহর কসম আমি বিয়ে করতাম না। বিয়ের মায়রে বাপ। রমিজের জন্য আমার খুব মায়া হয়। বেচারা। নতুন করে কোনো ভাই যেন ভুল না করে তাই আমি রমিজের অনুরোধে রমিজের সমস্যা গুলো নিয়ে লিখলাম। যদি তাতে আপনাদের কারো উপকার হয়... এই আশায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি রমিজকে দেখেছি।- খুব হাসি-খুশি ছেলে। মজা করে কথা বলে। আড্ডার সময় রমিজ না এলে আড্ডা জমত না। সাহিত্য নিয়ে তার পড়াশোনা অনেক। আমি প্রায়ই রমিজের কাছ থেকে বই ধার নিতাম। বই তিনদিন পর ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও আমি সাতদিন পর বই ফেরত দিলে রমিজ কিছু বলত না। চায়ের দোকানে আড্ডায় সব সময় রমিজ চায়ের বিল দিয়ে দিত।
একদিন জানতে পারলাম, রমিজ এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। নিয়মিত ডেটিং করছে। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। অবাক হওয়ার কারন হলো- রমিজ প্রেম করা টাইপ ছেলে না। সেক্স নিয়ে কখনও তাকে উচ্চবাক্য করতে দেখিনি। বরং সেক্স ব্যাপারটা তার কাছে সব সময় গা ঘিনঘিন করা ব্যাপার ছিল। একদিন মধ্য দুপুরে ফার্মগেট ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে রমিজের সাথে আমার অনেক কথা হলো। সে বলল, একটি মেয়ের সাথে ঘুরছি, গল্প করছি অথবা রাত জেগে ফোনে নানান বিষয় নিয়ে গল্প করছি তা মেনে নেয়া যায় কিন্তু সেক্স করছি তা মেনে নেয়া যায় না। কেন মেনে নেয়া যায় না- তার অনেক গুলো কারন বলল। আমি দেখলাম রমিজের কথায় যুক্তি আছে।
রমিজ বিয়ে করার দুইদিন আগে মেয়েটির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়ের নাম- অহনা। লাল মাটিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। ঢাকার উত্তরা নিজেদের ফ্লাটে থাকে। অহনার বড় এবং ছোট এক ভাই আছে। অহনার ইচ্ছা সে বিয়ের পর ব্যাংকে চাকরী করবে। আর রমিজ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। বিয়ের আগে যে সমস্ত সমস্যা গুলো হয়, রমিজ তার সব গুলো সমস্যার মধ্য দিয়েই গেছে। রমিজের পরিবারে রমিজের বিয়ে নিয়ে নানা সমস্যা হলো। কেউ বলে, এই মেয়ে কালো। কেউ বলে এই মেয়ে সাংসারিক হবে না। কেউ বলে এই মেয়ে হাসলে মাড়ি দেখা যায়। একজন বলল, এই মেয়ের চোখে সমস্যা আছে। রমিজের মা বললেন সবচেয়ে ভয়ংকর কথা- অহনার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেব না। এই মেয়ের নাক ভোচা। এদিকে অহনার বাসায়ও নানান কাহিনি। অহনার ব্যাবসায়ী বাবা বললেন, এই ছেলে(রমিজ)ফকিরা চাকরী করে। মা বললেন, এই ছেলের উপর আস্থা রাখা যায় না। অহনার বড় ভাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এই পোলার ছবি আমি ফেসবুকে দেখছি, চোর চোর চেহারা। আর অহনার ছোট ভাই (বিশিষ্ট পাকনা) বলল- রমিজ ছোট চাকরী করে, আমাকে আই ফোন কিনে দিতে পারবে? সব কিছু মিলিয়ে দুই পরিবারের থেকে সিদ্বান্ত হলো- এই বিয়ে হবে না। নো নেভার।
মূল গল্পে যাওয়ার আগে রমিজের প্রেম জীবনের কিছু কথা বলা যেতে পারে। অহনার সাথে রমিজ প্রতি সপ্তাহে দুইবার দেখা করত। তারা রিকশা অথবা সিএনজি'তে খুব ঘুরে বেড়াত। তাদের প্রথম দেখা হয় ধানমন্ডি লেকে। জ্যামের কারণে সেদিন রমিজ একঘন্টা দেরী করেছিল। এক বছরের মধ্যে তারা সারা ঢাকা শহর ঘুরে ফেলল। অহনা ফাস্টফুডের চেয়ে রাস্তার পাশে খাবারের দোকান গুলোর খাবার বেশি পছন্দ করতো। যে জায়গা গুলোতে রমিজ আর অহনাকে বেশি দেখা গেছে তা হলো- চটপটি-ফুচকা খেত আইডি ভবনের পাশের গলিতে, ভাপা পিঠা খেত মিরপুর বেনারসি পল্লীতে, ডাব খেত বানিজ্য মেলার সামনে থেকে, আখের রস খেত ইডেন কলেজের সামনে থেকে, বেলপুরি খেত ডুলি পাড়া থেকে, লুচি-কাবাব খেত মোহাম্মদপুর জেনিভা ক্যাম্পের সামনে থেকে এবং বিরানী (দুপুরবেলা বের হলে) স্টার কাবাব ধানমন্ডি থেকে। খাবারের বিল তারা দুইজন মিলেই দিত। রমিজের মতে মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো- প্রেমের সময়। আর সবচেয়ে বাজে সময় হলো- বিয়ের পরের সময়। রমিজ ইদানিং প্রায়ই আক্ষেপ করে বলে, আগে জানলে বিয়েই করতাম না, সারা জীবন শুধু প্রেম করে পার করে দিতাম। আর যদি খুব বেশি সেক্স করতে ইচ্ছা করতো- তাহলে আড়াই শ’ টাকা দিয়ে হোটেলে গিয়ে সেক্স করে আসতাম। ব্যস ঝামেলা শেষ।
এযুগের ছেলে-মেয়েদের প্রেম মানেই চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা এবং যারা খুব আধুনিক এবং সাহসী তারা করে সেক্স। বিশেষ করে আধুনিক মেয়ে গুলোকে জোর করতে হয় না, তারা ইচ্ছা করেই সেক্স করতে রাজী হয়। বরং সেক্স না করতে চাইলে- তারা বলে 'জিনিস মনে হয় ঠিক নাই'। রমিজও এই সব করেছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় না। অহনাকে খুশি করার জন্য সে বেশ কয়েকবার জড়িয়ে ধরেছে, চুমুও খেয়েছে। পরে অহনা ঠিক করে দিয়েছিল- রিকশায় উঠলে হাত ধরে বসে থাকতে হবে এবং বিদায় নেয়ার আগে অবশ্যই একটা চুমু খেতে হবে। আর সিএনজিতে অহনা নিজেই রমিজের কাঁধে মাথা রাখত। এভাবেই তারা দীর্ঘদিন পার করলো। আহ... কি আনন্দময় ছিল সেই সব সময় গুলো।
এক সময় অহনা আর রমিজ দুইজনই অনুভব করলো- তারা দুইজন দু’জনকে অনেক ভালোবাসে। অহনা রমিজকে বিয়ের কথা বললে, রমিজ জবাব দিল- পাঁচ বছর পরে, এখন আমার কাছে টাকা নাই। আমি চাই না সংসার জীবন আমাদের অভাব-অনটনের মধ্যে কাটুক।
এদিকে অহনা’র পরিবার থেকে অহনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু অহনা রমিজকে কথা দিয়েছে- সে রমিজকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। নো, নেভার। রমিজ নিশ্চিন্ত। কিন্তু অহনাকে প্রায়ই ঘটক এর মাধ্যমে অনেক ছেলেপক্ষ দেখতে আসে। যা রমিজের জন্য অনেক দুঃখজনক ব্যাপার। আর অহনার জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার। সত্য কথা বলতে কি, আমাদের সমাজে বিয়ের জন্য এক শ্রেণীর মানুষ, নানান জায়গায় নানান ভাবে মেয়ে দেখে বেড়ায়। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুডের দোকান, বাসায় অথবা মার্কেটে। কিন্তু বেশির ভাগ বিয়ে এভাবে হয় না। আমার এক খালাতো ভাই তিন বছরে প্রায় চার শ’ মেয়ে দেখেছে। পরে যে মেয়েকে বিয়ে করল, সে মেয়ে আস্ত ডাকাত। খালাতো ভাই সেই মেয়েকে এখন মারাত্মক ভয় পায়। শ্বশুর শ্বাশুরি এবং দেবর ননদকে দৌড়ের উপর রাখে। খালাতো ভাইয়ের এখন তিনটা মেয়ে। এই তিনটা মেয়ে একদিন বড় হবে। তাদেরও কি এভাবে চার শ’ ছেলে দেখে যাবে? এটা কি একটা চক্র? এমন কি চলতেই থাকবে?
নানান ঘটনার পর রমিজের সাথে অহনার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের সাতদিন পর রমিজের মনে হলো। বিয়ে করাটা বোকামি হয়েছে। চরম বোকামি। মেয়েরা প্রেমিকা হিসেবে ভাল কিন্তু বৌ হিসেবে না। বিয়ের আগে অহনার কোনো চাহিদা ছিল না। বিয়ের পর অহনার চাহিদা হয়ে গেল সমুদ্রের মতন বিশাল। এদিকে রমিজের বেতন সীমিত। রমিজ অহনার আবদার মিটাতে হিমসিম খাচ্ছে। রমিজ বিয়ের আগে অহনাকে বারবার বলেছে, আমার বেতন খুব অল্প। অহনা তখন বলেছে, অল্প দিয়েই আমি সুন্দরভাবে চলব। নুন দিয়ে ভাত খেলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না, তোমার সাথে থাকতে পারব- এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। কিন্তু প্রেম করার সময় মেয়েরা যে সমস্ত কথা বলে- বিয়ের পর তা সম্পূর্ণ ভুলে যায়। তাদের শুধু চাই আর চাই। দাও আর দাও। বিশেষ দিনে একটা শাড়ি উপহার দিলে, এমন ভাব দেখায়, যেন শাড়ি দেয়ার কথা ছিল চারটা। তুমি দিলে মাত্র একটা। তারপরও আমি লক্ষ্মী মেয়ের মতন মেনে নিলাম। দেখেছো- আমি কত ভাল বৌ। কিন্তু সামনের অমুক দিনে চারটা দিতে হবে। আমার অমুক বান্ধবীর জামাই সাতটা শাড়ি দিয়েছে, এর মধ্যে চারটা আবার ইন্ডিয়ান। এই শাড়ি গুলোই ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়ালের মেয়ে গুলো পড়ে। রমিজের কি ইচ্ছে করে না- অহনাকে তার পছন্দের জিনিস গুলো কিনে দিতে! সাধ থাকলেও সাধ্য নেই রমিজের।
প্রতিমাসে অহনার বান্ধবীদের কারো না কারো জন্মদিন অথবা বিয়ে থাকেই। এরপর আছে অহনা’র আত্মীয় স্বজনদের নানান অনুষ্ঠান। তাদেরকে অমুক দোকান থেকে অমুক গিফটা দিতে হবে। অহনা বুঝতে চায় না রমিজের বেতন খুব অল্প। এত অল্প টাকায় সবদিক সামলানো যায় না। রমিজ নানান ভাবে অহনাকে বুঝিয়েছে- তার বেতন সীমিত। সীমিত টাকা দিয়ে সারা মাস চলাই কষ্টকর। অহনা সব মন দিয়ে শুনে কিন্তু পরক্ষনেই সব ভুলে যায়। অহনাকে বিয়ে না করে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেও এমনই হতো। রমিজ বুঝে গেছে মেয়েদের মানসিকতাই এই রকম। প্রেমের সময় এক, বিয়ের পর আরেক।
বিয়ের পর রমিজের যে ব্যাপার গুলো সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে তা হলো- প্রতিমাসে দুইবার করে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া এবং শ্বশুর বাড়ি পক্ষের কারো দাওয়াতে যাওয়া। সেদিন রমিজ রাতে খেয়ে বারান্দায় বসে মাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছে তখন অহনা তাকে বলল- চলো, ছাদে যাই, অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। রমিজ তখন চাঁদ দেখার মত মানসিক অবস্থায় ছিল না। তার মাথায় চিন্তা আগামীকাল সকালে বাজারে যেতে হবে। ঘরে কোনো কিছু নেই। কিন্তু তার পকেট একেবারে ফাঁকা। প্রতি মাসের বিশ তারিখের মধ্যেই বেতনের সব টাকা শেষ হয়ে যায়। নানান চিন্তা ভাবনায় রমিজের ঘুম হয় না। প্রতিমাসে কারো না কারো কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়। টাকা ধার করা কি যে লজ্জার তা শুধু তারাই বুঝে যাদের নিয়মিত ধার করতে হয়। যারা বিয়ে করেছে- তাদের সাথে রমিজ আলাপ করেছে, তারা কিভাবে সংসার চালায়। তারা সবাই বলল- মাস শেষে যখন টানাটানি পরে তখন দোকান থেকে বাকি নিতে হয়। অথবা পরিচিত মানুষজনের কাছে হাত পাততে হয়। দুইজন মানুষের সংসার টানতেই রমিজের অবস্থা কাহিল। বাচ্চা-কাচ্চা হলে তখন কি হবে? তবে রমিজ বাজার সদাই ভালোই করে। সে কখনও ছোট মাছ কিনে না। মাছ মাংস আর মুরগী। অহনা মাছ কাটতে পারে না। একদিন সকালে রমিজ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, তখন রান্না ঘরে অহনা মাছ কাটছিল। হঠাত চিৎকারে শুনে রমিজ রান্না ঘরে গিয়ে দেখে- অহনা অনেকখানি হাত কেটে ফেলেছে। এরপর থেকে রমিজ বাজার থেকে মাছ কেটে নিয়ে আসে নিয়মিত।
বিয়ের আগে রমিজ রাজার মত চলতো। তার কোনো অভাব ছিল না। কোনো চিন্তা ছিল না। দামী সিগারেট খেত। নতুন নতুন জামা কাপড় কিনতো। এখন রমিজ বুঝতে পারে মানুষ কেন ঘুষ খায়। বৌ বাচ্চাকে সুখে রাখার জন্য তারা ঘুষ খায়। অহনার মন খারাপ হবে ভেবে রমিজ নিজের অভাবের কথা পুরোপুরি বলে না। অহনা স্বপ্ন দেখে- রমিজ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফ্লাট কিনবে- সে নিজের মনের মতন করে ঘর সাজাবে। রমিজ গাড়ি কিনবে- সে গাড়িতে করে শপিং করতে যাবে। দুই হাত ভর্তি করে শপিং করবে। বছরে দুইবার দেশের বাইরে বেড়াতে যাবে। গত বছর সুমি ভাবীরা থাইল্যান্ড গিয়েছে। কত্ত শপিং করেছে, কত্ত ছবি তুলেছে। সেই সব ছবি আবার ফেসবুকে আপলোড করেছে। অহনাও চায় দেশ বিদেশ ঘুরে অনেক ছবি তুলবে আর ফেসবুকে আপলোড করবে।
সেদিন রাতে ঘুমন্ত অহনাকে দেখে রমিজের খুব মায়া লাগল। আর বুকের ভেতর কষ্ট হতে লাগল। কি সুন্দর করে বাম গালের উপর বাম হাতে রেখে বাম পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আর রমিজের চিন্তায় ঘুমই আসে না। পরের দিন কোল্ড কফি খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে রমিজ মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে অহনাকে। সে বলেছে, হুম... খুব শ্রীঘই বড় একটা ফ্লাট কিনব। মেরুন রঙের গাড়ি কিনব। অহনা বলল- মেরুন না লাল, গাঢ় লাল। রমিজ বলল- আচ্ছা। খুশিতে অহনার মুখ ঝকমক করছে। রমিজ এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষনেই রমিজের মুখে ভর করলো এক আকাশ মেঘ। কাল শুক্রবার বাজারে যেতে হবে কিন্তু পকেট একেবারে ফাঁকা। কার কাছ থেকে টাকা ধার নিবে সে ভাবতে ভাবতে কপি’তে চুমুক দিল।
ছোটবেলা থেকেই আমি রমিজকে দেখেছি।- খুব হাসি-খুশি ছেলে। মজা করে কথা বলে। আড্ডার সময় রমিজ না এলে আড্ডা জমত না। সাহিত্য নিয়ে তার পড়াশোনা অনেক। আমি প্রায়ই রমিজের কাছ থেকে বই ধার নিতাম। বই তিনদিন পর ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও আমি সাতদিন পর বই ফেরত দিলে রমিজ কিছু বলত না। চায়ের দোকানে আড্ডায় সব সময় রমিজ চায়ের বিল দিয়ে দিত।
একদিন জানতে পারলাম, রমিজ এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। নিয়মিত ডেটিং করছে। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। অবাক হওয়ার কারন হলো- রমিজ প্রেম করা টাইপ ছেলে না। সেক্স নিয়ে কখনও তাকে উচ্চবাক্য করতে দেখিনি। বরং সেক্স ব্যাপারটা তার কাছে সব সময় গা ঘিনঘিন করা ব্যাপার ছিল। একদিন মধ্য দুপুরে ফার্মগেট ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে রমিজের সাথে আমার অনেক কথা হলো। সে বলল, একটি মেয়ের সাথে ঘুরছি, গল্প করছি অথবা রাত জেগে ফোনে নানান বিষয় নিয়ে গল্প করছি তা মেনে নেয়া যায় কিন্তু সেক্স করছি তা মেনে নেয়া যায় না। কেন মেনে নেয়া যায় না- তার অনেক গুলো কারন বলল। আমি দেখলাম রমিজের কথায় যুক্তি আছে।
রমিজ বিয়ে করার দুইদিন আগে মেয়েটির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়ের নাম- অহনা। লাল মাটিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। ঢাকার উত্তরা নিজেদের ফ্লাটে থাকে। অহনার বড় এবং ছোট এক ভাই আছে। অহনার ইচ্ছা সে বিয়ের পর ব্যাংকে চাকরী করবে। আর রমিজ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। বিয়ের আগে যে সমস্ত সমস্যা গুলো হয়, রমিজ তার সব গুলো সমস্যার মধ্য দিয়েই গেছে। রমিজের পরিবারে রমিজের বিয়ে নিয়ে নানা সমস্যা হলো। কেউ বলে, এই মেয়ে কালো। কেউ বলে এই মেয়ে সাংসারিক হবে না। কেউ বলে এই মেয়ে হাসলে মাড়ি দেখা যায়। একজন বলল, এই মেয়ের চোখে সমস্যা আছে। রমিজের মা বললেন সবচেয়ে ভয়ংকর কথা- অহনার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেব না। এই মেয়ের নাক ভোচা। এদিকে অহনার বাসায়ও নানান কাহিনি। অহনার ব্যাবসায়ী বাবা বললেন, এই ছেলে(রমিজ)ফকিরা চাকরী করে। মা বললেন, এই ছেলের উপর আস্থা রাখা যায় না। অহনার বড় ভাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এই পোলার ছবি আমি ফেসবুকে দেখছি, চোর চোর চেহারা। আর অহনার ছোট ভাই (বিশিষ্ট পাকনা) বলল- রমিজ ছোট চাকরী করে, আমাকে আই ফোন কিনে দিতে পারবে? সব কিছু মিলিয়ে দুই পরিবারের থেকে সিদ্বান্ত হলো- এই বিয়ে হবে না। নো নেভার।
মূল গল্পে যাওয়ার আগে রমিজের প্রেম জীবনের কিছু কথা বলা যেতে পারে। অহনার সাথে রমিজ প্রতি সপ্তাহে দুইবার দেখা করত। তারা রিকশা অথবা সিএনজি'তে খুব ঘুরে বেড়াত। তাদের প্রথম দেখা হয় ধানমন্ডি লেকে। জ্যামের কারণে সেদিন রমিজ একঘন্টা দেরী করেছিল। এক বছরের মধ্যে তারা সারা ঢাকা শহর ঘুরে ফেলল। অহনা ফাস্টফুডের চেয়ে রাস্তার পাশে খাবারের দোকান গুলোর খাবার বেশি পছন্দ করতো। যে জায়গা গুলোতে রমিজ আর অহনাকে বেশি দেখা গেছে তা হলো- চটপটি-ফুচকা খেত আইডি ভবনের পাশের গলিতে, ভাপা পিঠা খেত মিরপুর বেনারসি পল্লীতে, ডাব খেত বানিজ্য মেলার সামনে থেকে, আখের রস খেত ইডেন কলেজের সামনে থেকে, বেলপুরি খেত ডুলি পাড়া থেকে, লুচি-কাবাব খেত মোহাম্মদপুর জেনিভা ক্যাম্পের সামনে থেকে এবং বিরানী (দুপুরবেলা বের হলে) স্টার কাবাব ধানমন্ডি থেকে। খাবারের বিল তারা দুইজন মিলেই দিত। রমিজের মতে মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো- প্রেমের সময়। আর সবচেয়ে বাজে সময় হলো- বিয়ের পরের সময়। রমিজ ইদানিং প্রায়ই আক্ষেপ করে বলে, আগে জানলে বিয়েই করতাম না, সারা জীবন শুধু প্রেম করে পার করে দিতাম। আর যদি খুব বেশি সেক্স করতে ইচ্ছা করতো- তাহলে আড়াই শ’ টাকা দিয়ে হোটেলে গিয়ে সেক্স করে আসতাম। ব্যস ঝামেলা শেষ।
এযুগের ছেলে-মেয়েদের প্রেম মানেই চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা এবং যারা খুব আধুনিক এবং সাহসী তারা করে সেক্স। বিশেষ করে আধুনিক মেয়ে গুলোকে জোর করতে হয় না, তারা ইচ্ছা করেই সেক্স করতে রাজী হয়। বরং সেক্স না করতে চাইলে- তারা বলে 'জিনিস মনে হয় ঠিক নাই'। রমিজও এই সব করেছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় না। অহনাকে খুশি করার জন্য সে বেশ কয়েকবার জড়িয়ে ধরেছে, চুমুও খেয়েছে। পরে অহনা ঠিক করে দিয়েছিল- রিকশায় উঠলে হাত ধরে বসে থাকতে হবে এবং বিদায় নেয়ার আগে অবশ্যই একটা চুমু খেতে হবে। আর সিএনজিতে অহনা নিজেই রমিজের কাঁধে মাথা রাখত। এভাবেই তারা দীর্ঘদিন পার করলো। আহ... কি আনন্দময় ছিল সেই সব সময় গুলো।
এক সময় অহনা আর রমিজ দুইজনই অনুভব করলো- তারা দুইজন দু’জনকে অনেক ভালোবাসে। অহনা রমিজকে বিয়ের কথা বললে, রমিজ জবাব দিল- পাঁচ বছর পরে, এখন আমার কাছে টাকা নাই। আমি চাই না সংসার জীবন আমাদের অভাব-অনটনের মধ্যে কাটুক।
এদিকে অহনা’র পরিবার থেকে অহনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু অহনা রমিজকে কথা দিয়েছে- সে রমিজকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। নো, নেভার। রমিজ নিশ্চিন্ত। কিন্তু অহনাকে প্রায়ই ঘটক এর মাধ্যমে অনেক ছেলেপক্ষ দেখতে আসে। যা রমিজের জন্য অনেক দুঃখজনক ব্যাপার। আর অহনার জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার। সত্য কথা বলতে কি, আমাদের সমাজে বিয়ের জন্য এক শ্রেণীর মানুষ, নানান জায়গায় নানান ভাবে মেয়ে দেখে বেড়ায়। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুডের দোকান, বাসায় অথবা মার্কেটে। কিন্তু বেশির ভাগ বিয়ে এভাবে হয় না। আমার এক খালাতো ভাই তিন বছরে প্রায় চার শ’ মেয়ে দেখেছে। পরে যে মেয়েকে বিয়ে করল, সে মেয়ে আস্ত ডাকাত। খালাতো ভাই সেই মেয়েকে এখন মারাত্মক ভয় পায়। শ্বশুর শ্বাশুরি এবং দেবর ননদকে দৌড়ের উপর রাখে। খালাতো ভাইয়ের এখন তিনটা মেয়ে। এই তিনটা মেয়ে একদিন বড় হবে। তাদেরও কি এভাবে চার শ’ ছেলে দেখে যাবে? এটা কি একটা চক্র? এমন কি চলতেই থাকবে?
নানান ঘটনার পর রমিজের সাথে অহনার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের সাতদিন পর রমিজের মনে হলো। বিয়ে করাটা বোকামি হয়েছে। চরম বোকামি। মেয়েরা প্রেমিকা হিসেবে ভাল কিন্তু বৌ হিসেবে না। বিয়ের আগে অহনার কোনো চাহিদা ছিল না। বিয়ের পর অহনার চাহিদা হয়ে গেল সমুদ্রের মতন বিশাল। এদিকে রমিজের বেতন সীমিত। রমিজ অহনার আবদার মিটাতে হিমসিম খাচ্ছে। রমিজ বিয়ের আগে অহনাকে বারবার বলেছে, আমার বেতন খুব অল্প। অহনা তখন বলেছে, অল্প দিয়েই আমি সুন্দরভাবে চলব। নুন দিয়ে ভাত খেলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না, তোমার সাথে থাকতে পারব- এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। কিন্তু প্রেম করার সময় মেয়েরা যে সমস্ত কথা বলে- বিয়ের পর তা সম্পূর্ণ ভুলে যায়। তাদের শুধু চাই আর চাই। দাও আর দাও। বিশেষ দিনে একটা শাড়ি উপহার দিলে, এমন ভাব দেখায়, যেন শাড়ি দেয়ার কথা ছিল চারটা। তুমি দিলে মাত্র একটা। তারপরও আমি লক্ষ্মী মেয়ের মতন মেনে নিলাম। দেখেছো- আমি কত ভাল বৌ। কিন্তু সামনের অমুক দিনে চারটা দিতে হবে। আমার অমুক বান্ধবীর জামাই সাতটা শাড়ি দিয়েছে, এর মধ্যে চারটা আবার ইন্ডিয়ান। এই শাড়ি গুলোই ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়ালের মেয়ে গুলো পড়ে। রমিজের কি ইচ্ছে করে না- অহনাকে তার পছন্দের জিনিস গুলো কিনে দিতে! সাধ থাকলেও সাধ্য নেই রমিজের।
প্রতিমাসে অহনার বান্ধবীদের কারো না কারো জন্মদিন অথবা বিয়ে থাকেই। এরপর আছে অহনা’র আত্মীয় স্বজনদের নানান অনুষ্ঠান। তাদেরকে অমুক দোকান থেকে অমুক গিফটা দিতে হবে। অহনা বুঝতে চায় না রমিজের বেতন খুব অল্প। এত অল্প টাকায় সবদিক সামলানো যায় না। রমিজ নানান ভাবে অহনাকে বুঝিয়েছে- তার বেতন সীমিত। সীমিত টাকা দিয়ে সারা মাস চলাই কষ্টকর। অহনা সব মন দিয়ে শুনে কিন্তু পরক্ষনেই সব ভুলে যায়। অহনাকে বিয়ে না করে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেও এমনই হতো। রমিজ বুঝে গেছে মেয়েদের মানসিকতাই এই রকম। প্রেমের সময় এক, বিয়ের পর আরেক।
বিয়ের পর রমিজের যে ব্যাপার গুলো সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে তা হলো- প্রতিমাসে দুইবার করে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া এবং শ্বশুর বাড়ি পক্ষের কারো দাওয়াতে যাওয়া। সেদিন রমিজ রাতে খেয়ে বারান্দায় বসে মাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছে তখন অহনা তাকে বলল- চলো, ছাদে যাই, অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। রমিজ তখন চাঁদ দেখার মত মানসিক অবস্থায় ছিল না। তার মাথায় চিন্তা আগামীকাল সকালে বাজারে যেতে হবে। ঘরে কোনো কিছু নেই। কিন্তু তার পকেট একেবারে ফাঁকা। প্রতি মাসের বিশ তারিখের মধ্যেই বেতনের সব টাকা শেষ হয়ে যায়। নানান চিন্তা ভাবনায় রমিজের ঘুম হয় না। প্রতিমাসে কারো না কারো কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়। টাকা ধার করা কি যে লজ্জার তা শুধু তারাই বুঝে যাদের নিয়মিত ধার করতে হয়। যারা বিয়ে করেছে- তাদের সাথে রমিজ আলাপ করেছে, তারা কিভাবে সংসার চালায়। তারা সবাই বলল- মাস শেষে যখন টানাটানি পরে তখন দোকান থেকে বাকি নিতে হয়। অথবা পরিচিত মানুষজনের কাছে হাত পাততে হয়। দুইজন মানুষের সংসার টানতেই রমিজের অবস্থা কাহিল। বাচ্চা-কাচ্চা হলে তখন কি হবে? তবে রমিজ বাজার সদাই ভালোই করে। সে কখনও ছোট মাছ কিনে না। মাছ মাংস আর মুরগী। অহনা মাছ কাটতে পারে না। একদিন সকালে রমিজ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে, তখন রান্না ঘরে অহনা মাছ কাটছিল। হঠাত চিৎকারে শুনে রমিজ রান্না ঘরে গিয়ে দেখে- অহনা অনেকখানি হাত কেটে ফেলেছে। এরপর থেকে রমিজ বাজার থেকে মাছ কেটে নিয়ে আসে নিয়মিত।
বিয়ের আগে রমিজ রাজার মত চলতো। তার কোনো অভাব ছিল না। কোনো চিন্তা ছিল না। দামী সিগারেট খেত। নতুন নতুন জামা কাপড় কিনতো। এখন রমিজ বুঝতে পারে মানুষ কেন ঘুষ খায়। বৌ বাচ্চাকে সুখে রাখার জন্য তারা ঘুষ খায়। অহনার মন খারাপ হবে ভেবে রমিজ নিজের অভাবের কথা পুরোপুরি বলে না। অহনা স্বপ্ন দেখে- রমিজ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফ্লাট কিনবে- সে নিজের মনের মতন করে ঘর সাজাবে। রমিজ গাড়ি কিনবে- সে গাড়িতে করে শপিং করতে যাবে। দুই হাত ভর্তি করে শপিং করবে। বছরে দুইবার দেশের বাইরে বেড়াতে যাবে। গত বছর সুমি ভাবীরা থাইল্যান্ড গিয়েছে। কত্ত শপিং করেছে, কত্ত ছবি তুলেছে। সেই সব ছবি আবার ফেসবুকে আপলোড করেছে। অহনাও চায় দেশ বিদেশ ঘুরে অনেক ছবি তুলবে আর ফেসবুকে আপলোড করবে।
সেদিন রাতে ঘুমন্ত অহনাকে দেখে রমিজের খুব মায়া লাগল। আর বুকের ভেতর কষ্ট হতে লাগল। কি সুন্দর করে বাম গালের উপর বাম হাতে রেখে বাম পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আর রমিজের চিন্তায় ঘুমই আসে না। পরের দিন কোল্ড কফি খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে রমিজ মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে অহনাকে। সে বলেছে, হুম... খুব শ্রীঘই বড় একটা ফ্লাট কিনব। মেরুন রঙের গাড়ি কিনব। অহনা বলল- মেরুন না লাল, গাঢ় লাল। রমিজ বলল- আচ্ছা। খুশিতে অহনার মুখ ঝকমক করছে। রমিজ এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষনেই রমিজের মুখে ভর করলো এক আকাশ মেঘ। কাল শুক্রবার বাজারে যেতে হবে কিন্তু পকেট একেবারে ফাঁকা। কার কাছ থেকে টাকা ধার নিবে সে ভাবতে ভাবতে কপি’তে চুমুক দিল।