পার্ট ১ আমরা পাঁচ বোন। বাবা মা বাড়ীতে থাকেন। আমি ঢাকায় থাকি। থাকি বলতে বাধ্য হয়ে থাকি। কেউ কি সহজে ঢাকা থাকতে চায়। আমি ও ঐরকম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়ি। থাকতে হয় রোকেয়া হলে। পড়ালেখা ও শেষের দিকে। শুরুতেই বলেছি বাবা মা বাড়ীতে থাকেন। অবশ্য একটু বুদ্ধি থাকলে আমরা সবাই একসাথে ঢাকায় থাকতে পারি। আমার বাবা মা বুদ্ধিমান না। বাবার বুদ্ধি মার থেকেও কম। তা না হলে কি আমাদের এত কষ্ট করে জীবন পার করতে হয়। ঘটনাটা খোলেই বলি। আমার বাবার বাবা অর্থাৎ আমার দাদা ছিলেন ছোটখাট জমিদার। উনার অনেক সম্পদ ছিল। জনশ্র“তি আছে উনি সকালে জমি দেখতে বের হলে সারাদিন জমি দেখেও জমি দেখা শেষ করতে পারতেন না। আমার অবশ্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কারণ আমি জন্মের পর বোঝার বয়সে এর ছিটেফাঁটাও দেখতে পায় নি। আমার বোনদের দেখার কোন প্রশ্নই আসে না। কারণ আমিই সবার বড়। তাহলে দাদার এত সম্পদ বাবা কি করছেন। বাবার কোন ভাই বোন ছিল না। বাবার কোন চাচাও ছিল না। কাছের কোন আত্তীয়-স্বজনও ছিল না। বাবা মদ-গাঁজাও খাননি, জোয়াও খেলেননি এমনকি সিগারেটও খান না। কোন প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন বলেও মনে হয় না। কারণ বাবার স্বভাবে হাজী মুহাম্মদ মহসিনের কোন অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। বাবাকে অনেকদিন প্রশ্ন করেছি। উনি কোন উওর দেন না। জিজ্ঞাসা করলে বিরক্ত হন। উনি সম্পদ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি নন। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে, বাবার কাছ থেকে নাকি বিভিন্ন ব্যক্তি নামে বেনামে সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছেন। দাদা নাকি বলতেন, আমার এই ছেলে আমার সম্পত্তি গুলো দেখে রাখতে পারবে না। দাদার কথাই ঠিক হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে দাদা অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন। তা না হলে উনিও উনার সম্পত্তি রাখতে পারতেন না। উনার আমলে একবিঘা জমিও নাকি খোয়া যায় নি। যা গেছে সব বাবার আমলে। আবার এও শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষ নাকি ভারতবর্ষের বিরাট সম্রাট ছিলেন। কোন সম্রাট তা কেউ বলতে পারে না। তবে জাদরেল সম্রাট ছিলেন। উনার সুনাম নাকি সমগ্র ভারতবর্ষে ছিল। যাক, পূর্বের কথায় ফিরে আসি। বাবার একমাত্র কাজ কৃষিকাজ। এই সূত্রে বলা যায় আমরা কৃষক। যদিও কৃষক বলতে, অশিক্ষিত, দরিদ্র এবং গরীব-নিঃস্ব মানুষকে বুঝায় কিন্তু আমার বাবা সেরকম ছিলেন না। বাবা ছিলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। বাবার ইংরেজি উচ্চারণগুলো এত স্পষ্ট যে, কলেজের ইংরেজি শিক্ষকও বাবার মত স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারতেন না। উনি আমেরিকান এবং ব্রিটিশ ইংরেজি এত প্রার্থক্য করে বলতে পারতেন যে, আমেরিকান এবং ব্রিটিশরাও বুঝতে পারতেন না উনি কোন দেশের নাগরিক। মাও শিক্ষিত ছিলেন। মাও ইংরেজি বলতে পারতেন তবে বাবার মত না। যাই হোক, ইংরেজি পারলেই যে শিক্ষিত তা না। তবে আমাদের দেশের অনেকেই মনে করেন ইংরেজি পারা মানে অনেক শিক্ষিত হওয়া। এই কারণে উদাহরণ টানা। প্রকৃত কথা হচ্ছে, আমার বাবা মা উভয়ই শিক্ষিত। উভয়েই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। দুই জনই বোকা। এই দুজন বোকা মানুষ কিভাবে একত্রিত হয়েছিলেন তা আমার মাথাই আসে না। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা লজ্জায় কিছু বলে না। বাবাকে বললে, বাবা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তাদের বিয়ে হয়। এর বেশি কিছু বলে না। বাবাকে বলেছিলাম, তোমরা এত বড় ডিগ্রি অর্জন করেও কৃষক হতে গেলে কেন। বাবা বলে, কৃষক না হলে যা দেখছিস তাও থাকত না। জমি জামা গুলো রাখতে পারতাম না। বাবাও চাইছিল না। আমি বাবাকে বলি তুমি কি তোমার জমি জামা রাখতে পেরেছিলে। রাখতেই যেহেতু পারনি এখানে পরে ছিলে কেন। চাকুরি করতে। সুখে শান্তিতে থাকতে। মারে চাকুরি করলে শহরে যেতে হত। শহর আমার একদম ভাল লাগে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাহলে পড়েছ কিভাবে? বাবা বল প্রয়োগ করে পাঠিয়েছিলেন। বাবাকে খুব ভয় পেতাম এবং শ্রদ্ধা করতাম। উনার কথা ফেলতে পারিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর বল প্রয়োগ করার মত কেউ ছিল না। তাই থেকে গেলাম। আমি এখানে খুব সুখে শান্তিতে আছি। আমার কোন দুঃখ নেই। একটু বিস্তারিতভাবে বলা দরকার। আমাদের বাড়ী ময়মনসিংয়ের প্রতান্ত অঞ্চলে। বাড়ীতে বিল্ডিং আছে। দুতলা নয় একতলা। রুম আছে সাতটি যদিও আমরা সব বোন একসাথে থাকি। পড়ার সময় যার যার রুমে চলে যাই। বাড়ীর সামনে উঠান আছে। বাড়ীর চারকোনে চারটি নারিকেল গাছ আছে। এই নারিকেল গাছের নিচে বসলে প্রাকৃতিক বিনা বাতাস পাওয়া যায়। আমার নাম রুমা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি আগেই বলেছি। আমার ইমেডিয়েট যে ছোট তার নাম আসমা। সে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেও হলে থাকে। এর চেয়ে যে ছোট তার নাম রুবি। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এর পরের বোনটিও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে বিভাগ এবং হল আলাদা। সবার ছোট বোনটি বাড়ীতে বাবা মার সাথে থাকে। সে নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আমরা সবাই ভাল ছাত্রী। সব দিক দিয়ে আমরা অনেক খুশি ছিলাম। তবে একটা ভাই নাই বলে দুঃখ করতাম। বাবা, মাকে দেখতাম তাদের মনে কোন দুঃখ নেই। উনারা বলতেন, ছেলে হলেও যা, মেয়ে হলেও তাও। সুতরাং তরাই আমাদের ছেলে, তরাই আমাদের মেয়ে। সান্ত্বনা দিত নাকি সত্যি সত্যি তা বুঝতে পারি না। তবে আচার আচরণে কখনোই আমরা মেয়ে বলে অবহেলা করত না। এই রুমা এভাবে বসে আছিস কেন। ক্লাসে যাবি না। কাউকে নিয়ে মনে হয় খুব ভাবছিস। এই বয়সে মেয়েদের এরকম ভাবা ভাবি ভাল না। ও! দাঁড়া আফরোজা। আমার খেয়ালই ছিল না। মেয়েটির নাম আফরোজা ওয়াহিদ। পাঠকরা ভাবতে পারেন, ওয়াহিদ আবার মেয়ের নাম হয় নাকি। ওয়াহিদ হচ্ছে ওর বাবার নাম। নিজের নামের সাথে বাবার নাম সংযুক্ত করে দিয়েছে। বিয়ের পর স্বামীর নাম সংযুক্ত করবে। এটার নাকি মজাই আলাদ। বারবার নাম পরিবর্তন। এক নাম নিয়ে নাকি সারাজীবন থাকতে বিরক্ত লাগে। যাই হোক, মেয়েটি যাই বলুক না কেন। মেয়েটি অনেক ভাল। আমার বান্ধবী বলে বলছি না। সবাই ভাল বলে তাই আমিও ভাল বলি। পাঠকদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমরা পাঁচবোন অসম্ভব সুন্দরী। এটা আমি বলি না, সবাই বলে। তাই বিষয়টা জানিয়ে দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি আর এসব ভাবছি। এই রুমা তর কি হয়েছে বলত। কখন থেকে হাঁটছি তুই কিছু বলছিস না। মনে মনে কি এত ভাবিস। আমাদের বলা যায় না। নাকি আমাদের বান্ধবী হিসেবে মনে করিস না। আরে তেমন কিছু না। ইদানিং আমার কি জানি হয়েছে। যখনই একটু অবসর হয় তখনই বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ভর করে। ভাবতে না চাইলেও চিন্তা গুলো মাথাটাকে করকর করতে থাকে। কি যে করি। আর ভাল লাগে না। এই রুমা তর ফোন বাজে। ফোনটা ধর। হাসতে হাসতে তুই পাগল হয়ে যাবি। আসমা কেমন আছিস। আপা ভাল। একটা সমস্যা হয়েছে। বলে ফেল। আপা মোবাইলে এত কথা বলা যাবে না। সামনা সামনি বলতে হবে। আমার এখানে আসলেই পারিস। পরীক্ষা যে। আচ্ছা রাখি আপা। পরে কথা বলব। বলনা কি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কোন সমস্যা। না আপা। তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার একটা পরামর্শ লাগবে। ঠিক আছে। সময় হলেই এসে পরবি। বেশি সমস্যা হলে আমাকে ফোন করিস। মোবাইলের লাইন কেঁটে গেল। চিন্তায় ডুবে গেলাম। বলে রাখা ভাল। আমি ব্যতীত অন্য চার বোন অন্যরকম। চারজনের চরিত্রগুলোর সাথে মিল থাকলেও আমার সাথে মিল খুব কমই। যেমন, আমি পড়তে ভালবসি। অন্য সবাই পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য কোন বই পড়তে ভালবাসে না। অন্য বোনেরা যখন রাস্তায় বের হয় তখন সুন্দর সাজগোছ করে বের হয়। আধুনিক অবস্থার সাথে তাল মিলাতে পছন্দ করে। আধুনিক অবস্থা বলতে তাদের কাছে হলিউড এবং বলিউডকে মনে হয়। এরা বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন পোশাক দেখবে এবং ঐ সমস্ত পোশাকের মত পোশাক পড়তে চেষ্টা করবে। তাদের ফ্যাশন আইকনগুলো ও তাদের খুব পছন্দ। এগুলো তারা অনুসরণ করতে পছন্দ করে। আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি ছবি আর বাস্তব এক না। ছবিতেই তাদের ভাল মানায়। বাস্তবে তাদের মানাবে না। ওদের সবাই পছন্দ করবে। একজনের জন্য কেউ পছন্দ করতে চাইবে না। আমাকে বোনেরা যুক্তি দেয়। তাদের দাম কত জান। তাদের জন্য কত যুবক তাদের জীবন পর্যন্ত বির্সজন দেয়। তাদের বক্তের সংখ্যা কত কোটি কোটি। তারা এত কিছু অর্জন করেছে পোশাকের মাধ্যমেই। গ্রামের মহিলাদের মত পোশাক পরলে এরা নায়িকা হতে পারত না। সারাদিন লাকড়িই ঠেলতে হত। পোশাকে সব কিছু পরিবর্তন হয়। তুমি কি মনে কর এরাই সবচেয়ে সুন্দর। আসলে তারা দেখতে তেমন সুন্দর না। তাদের সাজগোছের মাধ্যমে সুন্দর করা হয়। তুমি বাবার বড় মেয়ে। বড় ছেলে মেয়েরা একটু শান্ত শিষ্টই হয়। তুমি একটু বেশি শান্ত শিষ্ট। তদের যা ভাল লাগে তাই তরা কর। আমার এগুলো ভাল লাগে না। আমি নিজেকে আড়াল করে রাখতেই বেশি পছন্দ করি। তবে আমার বোন গুলো যাই করুক। ওরা অনেক ভাল। ওরা যতই হলিউড, বলিউড করুক না কেন তা ঘরের ভিতরেই। বাহিরে বের হলে শালীনতা বাজাই রেখেই বের হয়। রাতে ঘুম হল না। সারারাত জেগে রইলাম। বারবার আসমার সমস্যার কথাটা মাথায় আসতে লাগল। একটা ভাই থাকলে ভাল হত। অনেক জিনিস আছে মেয়েরা সমাধান করতে পারে না। একজন ছেলের দরকার হয়। মেয়েরা যেমন মেয়েদের কাজগুলো একশত ভাগ সঠিক করে করতে পারে তেমনিভাবে ছেলেরা ছেলেদের কাজগুলি একশত ভাগ সঠিক করে করতে পারে। মেয়েদের কাজগুলি যদি ছেলেরা করে তাহলে যেমন তালগুল পাকিয়ে ফেলে তেমনিভাবে ছেলেদের কাজগুলি যদি মেয়েরা করে তাহলেও তালগুল পাকিয়ে ফেলে।