একদিন আমান হেঁটে হেঁটে চলেছিল। গন্তব্য উদ্দীশ্যহীন। ঝুপড়ি এক চা’র দোকানের সামনে ছোট্ট একটি পানের দোকান। খোলা পান বিক্রী হয় সেখানে। সাথে ‘সাদা পাতা’ এবং চুন সুপারি। দোকানে একটা ছোট টেপরেকর্ডারে বেশ উচ্চ স্বরে গান বাজছে।
‘কাজল নদীর জলোর
ভরা ঢেউ ছলছলে’… …
নিজের ভেতর থেকে আমান যেন হঠাৎ বের হয়ে আসে। ফিরে যায় অনেক আগে। নৌকায় করে বাগেরহাট থেকে নানাবাড়ি যাচ্ছে। আব্বা-আম্মা, ছোট ভাই, আর ছোট খালু। নদীর পানিতে মাঝির বৈঠা র সংঘর্ষে কোমল-মৃদু আওয়াজ। পানির নিজস্ব রঙ নেই জানে সে। কিন্তু পানির কি নিজস্ব ঘ্রাণ আছে?
ছোট খালু খুব ভালো গাইতে জানতেন। নৌকায় বসে তিনি এই গানটি গাইছিলেন! এক অপূর্ব সুরলহরীতে সেই সময়টা কত্তো আনন্দে কেটে যেত!
নৌকার ছইয়ের ভেতর মায়ের আঁচলের নরম পেলবতায় হৃদয় ছুঁয়ে যেত আমানের। একটা গান মধুমতি নদীর সেই প্রবল যৌবনের বুক চিরে চিরে ঢেউয়ের তালে তালে স্রোতের অনুকূলে নেচে বেড়াতো! মায়ের নরম হাতের ছোঁয়া আজ আমান এখনো ওর কপোলে অনুভব করে। ভাবলেই কেমন ঘুমে বুজে আসে চোখ। হৃদয়ে তখন প্রশান্তির শ্যামল ছায়াময় অনুভূতি বিরাজ করে।
এক খুচরা পানের দোকানের সামনে বিহ্বল আমান ওর ছেলেবেলার সব থেকে প্রিয় জায়গায় বেড়ানোর সুখস্মৃতিতে উদ্বেলিত হয়। তখন সেটা ছিল জীবনের সব চেয়ে মধুরতর সময়। নানা বাড়ি বেড়াতে যাওয়া।
কিন্তু সেটা যে ওর মায়ের ‘নাইয়র’ ছিল! তখন বুঝে আসে নাই। একজন মা- একজন নারী এবং একজন মেয়ে ও বটে। সন্তান হিসাবে আমরা কেবল তাকে মা ই দেখি। আজ আমানের নিজের মায়ের সেই নাইয়র যাত্রা সময়ের ঘ্রাণে ভেসে ভেসে ওর হৃদয়কে প্রহ্লাদে নাচিয়ে তোলে!
একটা কষ্ট অনুভব করে আমান। মা কে কেবল মা ই দেখবার জন্য। তাঁর ভিতরের একজন বালিকা-যুবতী-বাবার প্রিয়তমা স্ত্রী- অন্য এক বাবা মায়ের মেয়ে এসব রুপগুলিকে কত অবহেলায় সে ফিরিয়ে দিয়েছে… দেখতে চায় নাই। কেবল মা হিসাবে তাঁর অপুর্ণতা ই চোখে পড়েছে। মায়ের সেই অপুর্ণতাকে ব্যর্থতার ডালিতে নিপূণভাবে সাজিয়েছে। অভিমানে কষ্ট পেয়েছে-কষ্ট দিয়েছে।
আজ এক বিষণ্ন বেলাভূমে একজন আমান বড্ড তীব্র যন্ত্রণায় নিজের মা কে মনে করে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে বোবা হয়ে যায়।
সে কষ্ট পায়-হারানো সময়ের বিবর্ণতায়… মধুমতি নদী মরে যাওয়ায়… কাজল কালো জলে পানি-শ্যাওলা আর ঝরা পাতার আঁশটে ঘ্রানে উদ্বেলিত হৃদয়ে একটা গানের অনুরণনের অনুপস্থিতিতে!
আমান কষ্ট পায় নিজের মা কে চিনতে না পারার কারণে!
হৃদয় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে নিজের এবং পৃথিবীর প্রতি চরম ঘৃণায় একটা ই মাত্র শব্দ-
ওহ! মা!
Comments (1)
হুম সত্যিই বলেছেন... হয়ত আমরাও তখন থাকবনা
ধন্যবাদ মাইদুল !! অনেক দিন পর আপনার মন্তব্য দেখলাম