Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মাকসুদের রবীন্দ্র-দর্শন






মাকসুদের রবীন্দ্র-দর্শন

সাইয়িদ রফিকুল হক

মাকসুদ ছোটবেলা থেকেই কবি নজরুলের ভক্ত। তাদের পরিবারের সবাই যে নজরুলকে ভালোবাসে তা নয়—কেউ-কেউ ভালোবাসে—আর মাকসুদ তাদেরই অনুগামী হয়েছে। নজরুল মুসলমান। আর রবীন্দ্রনাথ হিন্দু! কথাগুলো শৈশব থেকে শুনে আসছে মাকসুদ। আর এগুলো সে শুনতে-শুনতে একেবারে হাফেজ হয়ে গেছে। তার বাবা রবীন্দ্রনাথকে অবজ্ঞা করে কথা বলতে ভালোবাসে। প্রথমে এসব শুনতে মাকসুদের একটুআধটু খারাপ লাগতো। পরে আর খারাপ লাগেনি। বরং সেও এই দলে যে কখনও মিশে গেছে—তা সে এখন হাজারবার চেষ্টা করেও বলতে পারবে না।

স্কুলজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে মাকসুদের এবিষয়ে বহুবার ঝগড়া হয়েছে। এমনকি কয়েকজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বও ভেঙ্গে গেছে—তবুও সে রবীন্দ্রনাথকে কোনো ছাড় দেয়নি। আর কোনোপ্রকার ছাড় দেওয়ার পাত্র সে নয়। তার বাপ-দাদার মুখে সে শুনেছে: রবীন্দ্রনাথ শুধুই একজন হিন্দু! আর-কিছু নয়। সেই থেকে তার মানসগঠনে একটা বড় ধরনের গণ্ডগোল হয়ে গেছে। আর তার এই গণ্ডগোল কলেজজীবনেও রয়ে যায়। সেখানেও সে নজরুলের পক্ষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে খাটো করে কথা বলেছে। এখানেও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিন্ন করেছে অনেকে। তবুও সে একেবারে নাছোড়বান্দা। বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে সে যেন কোথাও বসতে দিবে না। তার এইসব কথাবার্তা শুনে বন্ধুরা হেসেছে। আর কেউ-কেউ বলেছে—পাগল! আর কথাগুলো তারা মন থেকেই তার উদ্দেশ্যে বলেছে।

মাকসুদের এই রবীন্দ্রবিরোধী-পাগলামি বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনেও লেগে রইলো। এখানেও সে আগের মতো বন্ধুদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তুমুল তর্কেবিতর্কে লিপ্ত হতো। ভাগ্যিস সে কোনো সাহিত্যের ছাত্র নয়, তা-না-হলে বাংলাসাহিত্য পড়তে গিয়ে তাকে ভীষণ হোঁচটই খেতে হতো। সে ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হয়েও সাহিত্যবিষয়ে কথাবার্তা বলতে কোনো দ্বিধা করতো না। প্রথমে তার বন্ধুরা এতে তেমন একটা আপত্তি করতো না। কিন্তু পরে তারা যখন জানলো: সে জীবনে-মরণে আগাগোড়া রবীন্দ্রবিরোধী—তখন তার বন্ধুরা রীতিমতো চমকে উঠলো। এমন একটা অর্বাচীন এখনও এই দেশে আছে? আর ভাবতে-ভাবতে তারা শঙ্কিত হয়ে উঠলো।

প্রশ্নটা আরও অনেকের মনে জাগলো। আর এতে মাকসুদের বন্ধুসংখ্যা কমতে শুরু করলো। তার রুচিশীল বন্ধুরা তাকে সরাসরি ত্যাগ করে নিজেদের সম্মান বাঁচাতে তৎপর হয়ে পড়লো। আর তারা ভাবতে লাগলো: রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বিশালমাপের কবিকে যারা একফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়—তারা ভয়ানক ক্রুদ্ধ আর উগ্রবাদী। এদের সঙ্গে সুধীসমাজের সম্পর্ক রাখাটা বোকামি ছাড়া আর-কিছু নয়। তবুও বন্ধু বলে কথা। মাকসুদের হাতেগোনা কয়েকজন বন্ধু অবশিষ্ট রয়ে গেল। তাদের সঙ্গে সে তেমন একটা আলাপ জমিয়ে আগের মতো আর মজা পায় না। এরা মাকসুদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ব্যতীত আর-কিছু বলে না।

একদিন মাকসুদ তার এক নতুন বন্ধুর বাড়িতে গেল। সেখানে দুপুরের খাবারের পর তাদের আলাপ-আলোচনার মধ্যে সাহিত্যপ্রসঙ্গ আসতেই ভরামজলিশে মাকসুদ একটা বেফাঁস কথা বলে বসলো। এতে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। বিশেষতঃ এতে মাকসুদের বন্ধু রেহান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। তার এই নতুন বন্ধুটি যে এমন একটি কথা বলবে তা সে জীবনেও ভাবেনি। সে আজ তাকে কত আদর করে তাদের বাসায় নিয়ে এসেছে—সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবে বলে। আর সে কিনা বাসায় এসেই এমন একটি বেফাঁস কথা বললো!

আজ রেহানের শুভজন্মদিন ছিল। এই উপলক্ষে দুপুর থেকেই তারা কয়েকজন বন্ধু একত্রিত হয়েছিলো। আর সেখানে রেহান তার এই নতুন বন্ধুটিকেও দাওয়াত করে। আর এখানেই মাকসুদ তার আগের মতো স্বভাবসুলভভঙ্গিতে বলে ফেলে: রবীন্দ্রনাথ তার ভাতিজীকে কবি নজরুলের পিছনে লেলিয়ে দিয়ে নজরুলের প্রতিভাধ্বংস করেছিলেন! কথাটা শোনামাত্র রেহানের অন্যান্য বন্ধুরা একেবারে হৈহৈ করে উঠলো। আর তাদের প্রবল বাধার মুখে মাকসুদ একেবারে কেঁচো হয়ে গেল! তার যেন এখন পালাবার কোনো পথ নাই। রেহানের বন্ধুরা তাকে শক্তমতো ধরে বসলো। আর তারা কথার মাধ্যমে তাকে ভীষণ ধোলাই দিতে লাগলো। আর এমতাবস্থায় ধোলাই খেতে-খেতে মাকসুদ শুধু পালাবার পথ খুঁজছিলো।
এমন সময় রেহানদের ড্রইংরুমে এসে ঢুকলেন অধ্যাপক লিটু মিয়া। তিনি রেহানের মামা। তিনি আসতেই সবাই তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো। তিনি একটা সোফার একপাশে বসে বললেন, “আমি তোমাদের হৈচৈ শুনে ছুটে এলাম। তোমাদের একজনের একটা কথা আমাকে ভীষণভাবে আহত করেছে। আর তোমাদের মধ্য থেকে এখন-এইমাত্র কেউ-একজন বলেছে: রবীন্দ্রনাথ নাকি নজরুলের প্রতিভাধ্বংস করার জন্য তার ভাতিজীকে নজরুলের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন! কথাটি কত সাংঘাতিক আর কী ভীষণ জঘন্য! এমন কথা কোনো মানুষ এখনকার দিনে মুখে আনতে পারে? আরে, তোমরা হলে আধুনিকযুগের ছেলে। তাই, তোমাদের মুখে এতো সস্তা-কথা মানায় না।”
একটু থেমে সবার দিকে চেয়ে তিনি পুনরায় বললেন, “এই কথাটি কে বলেছে? আমি তাকে একটু দেখতে চাচ্ছি।”
রেহানের বন্ধুরা একযোগে মাকসুদকে দেখিয়ে দিলো। এবার মাকসুদ কাঁচুমাচুভঙ্গিতে বললো, “এটা তো সবাই জানে।”
মাকসুদ আরও-কিছু বলতে যাচ্ছিলো। এসময় রেহান চোখ-টিপে মাকসুদকে থামতে বললো। অবশেষে সে থামলো।

অধ্যাপক লিটু মিয়া অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি মাকসুদের কথা শুনে ভয়ানক চটে গিয়েছেন। কিন্তু বাইরে একেবারে শান্তভাব বজায় রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, “আগে রবীন্দ্রনাথসম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। তারপর তাঁর সম্পর্কে দুই-চারটি কথা বলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মাকসুদ যে কথাটি বলেছে, তা এই সমাজের একশ্রেণীর মূর্খদের কাজ। কিছুসংখ্যক মূর্খ রবীন্দ্রবিরোধিতার নামে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আজেবাজে প্রচারে নিয়োজিত হয়েছিলো। আর তাদের বংশধরগণ এখনও সেই কাজটি করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ কোনো সাধারণ পরিবারের ছেলে নন। তিনি জমিদারপুত্র। তাদের পূর্বপুরুষগণ স্বশিক্ষায় বহুকাল আগে থেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। তারা ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ। এই পরিবারের লোকদের সঙ্গে সবাই মেলামেশা করার সুযোগ পেতো না। আর সেই পরিবারের মেয়েরা ছিল একেবারে দুর্লভ। তাদের পরিবারের মেয়েরা অসম্ভব রূপবতীও ছিল। এছাড়াও তাদের পরিবারের মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষায় ভারতবর্ষে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। আর পরিবারের পুরুষরাতো ভারতবর্ষে শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম রূপকার। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই কাজটি করেছেন। তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী নামক যে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে গেছেন, তা আজও বিশ্বের বুকে এক মডেল। তোমাদের একটি কথা জানতে হবে: রবীন্দ্রনাথদের পরিবারের মেয়েরা কখনও সস্তা ছিল না যে, তাদের কারও সঙ্গে জোর করে বিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করার জন্য সেই সময় বিলেত থেকে পাস করা সব শিক্ষিত-ব্যারিস্টাররা ঘোরাফেরা করতো। এই পরিবারের এক-মেয়েকে বিয়ে করেছে ভারতের পতৌদির মুসলমান-নবাব। আর তাদের পরিবারের মেয়েদের বুঝি কারও পিছনে লেলিয়ে দিতে হবে? এসব কথা কোনো সুস্থ মানুষ বলে না! এগুলো অসুস্থমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তোমাদের আরও জানতে হবে: কবি নজরুল প্রমীলা-নাম্নী যে তরুণী বা হিন্দু-মেয়েটিকে বিবাহ করেছিলেন তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বংশের কারও কোনো সম্পর্ক নাই—আত্মীয়তা তো দূরের কথা। এসব বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তাছাড়া, তোমরা কেন কবি নজরুলের পক্ষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করবে? আরে, স্বয়ং কবি নজরুলই তো তাঁকে গুরু-গুরুদেব বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এখন এইসব নিয়ে টালবাহানা করে লাভ কী?”

অধ্যাপক লিটু মিয়া আর-কিছু না বলে উঠে ভিতরে গেলেন। আর যাওয়ার আগে তিনি মাকসুদের দিকে একবার তাকিয়ে শুধু একটুখানি হাসলেন। তার এই হাসিটুকু যে ভীষণ স্নেহের—তা একবার দেখলেই যে-কেউ বুঝতে পারবে।

রেহানের মনটি হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল। আজ তার জন্মদিন। বন্ধুদের জন্য কতরকম মুখরোচক খাবারের আপ্যায়ন করেছে সে। আর সন্ধ্যার পরে কেক-কাটার পরে শুরু হবে আসল খাওয়াদাওয়া। আর এইসময় তার মনটি খারাপ হলে সন্ধ্যার অনুষ্ঠান জমবে কীভাবে? তার অন্যান্য বন্ধুরা রেহানকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
মাকসুদ একবার উঠে চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু রেহান তাকে যেতে দিলো না। সে একটু পরে আগের মতো হাসিমুখে সবার উদ্দেশ্যে বললো, “আমরা আগের মতো হাসিখুশি হয়ে যাই। আবার জমে উঠুক আমাদের আড্ডা।” কিন্তু এতেও যেন আড্ডাটা আগের মতো জমছে না। সবাই যেন মাকসুদের দিকে তাকিয়ে কেমন উসখুস করছে। আর তাকে সবাই কোনো-একটা বিষাক্ত ভাইরাস ভাবছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাকসুদও নড়েচড়ে বসে। আর সে এখান থেকে সরে যাওয়ার একটা পথ খুঁজছে। আর সে একটু পরে একটা সুযোগও পেয়ে গেল। রেহান একবার কী-একটা দরকারে ভিতরে যেতেই মাকসুদ দ্রুত উঠে পড়লো তার আসন থেকে। তারপর সে একদিকে ছুটে পালালো।

বাসার ভিতরের কাজ সেরে রেহান ফিরে এসে দেখলো মাকসুদ সেখানে নেই। সে এতে খুশি হতে পারলো না। সে ভাবছে: তার এই বন্ধুটি ভুল করলেও সে মানুষ হিসাবে একেবারে খারাপ নয়। তার ভিতরে অনেক ভালো গুণ রয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথবিষয়ে তার এই মন্দ-ধারণাটি তো একদিনে হয়নি। আর এতে তার পরিবারের দোষ সবচেয়ে বেশি। আর তাই, সে গভীরভাবে ভাবলো: মাকসুদ যদি তাদের সঙ্গে আরও-কিছুদিন মেলামেশা করতে পারে—তাহলে, তার ধারণা পাল্টাতেও তো পারে! এমন একটা ধারণার বশবর্তী হওয়ায় মাকসুদের প্রতি রেহানের মায়া পড়ে গেল। তাছাড়া, তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান এখনও শেষ হয়নি। তাই, সে মন খারাপ করে আবার বাসার ভিতরে গেল।

শেষবিকালে রেহানের বন্ধুরা আগের মতো আড্ডাবাজিতে আবার মেতে উঠলো। রেহানদের ড্রইংরুমটা এখন ছোটখাটো একটা জনসভা বলেই মনে হচ্ছে। রেহান ওর ছোটবোনের সঙ্গে ছাদে এলো নিরিবিলিতে কিছু ছবি তোলার জন্য। আর এখানে এসেই সে ভীষণ অবাক হলো। আর দেখলো: তাদের বিশাল ছাদের এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে মাকসুদ। আর মাকসুদকে দেখামাত্র রেহানের মনটা একনিমিষে ভালো হয়ে গেল।

রেহান কাছে এসে মাকসুদের কাঁধে হাত না-রাখা পর্যন্ত সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আকস্মিকভাবে রেহান ও-কে জড়িয়ে ধরে খুশিমনে বললো, “তুমি যাওনি, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আর আমার বন্ধুদের কথায় তুমি মনখারাপ কোরো না।”
এবার মাকসুদ ম্লান-হেসে রেহানকে বাধা দিয়ে বললো, “না-না, ওদের কোনো দোষ নাই। ওরা সবাই খুব ভালো। আসলে, আমি নিজেই খুব ছোটো। তাই, রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল-মহীরুহকে উপড়ে ফেলার জন্য এতোদিন বৃথাই অপচেষ্টা করেছি। আজ তোমার লিটু-মামার কথা শুনে আমার মনটা কেমন যেন করছে! আমি এতোদিন কত বোকা ছিলাম। আর এমন একজন মহামানবকে শুধুই নিজের অজ্ঞতায় দিনের-পর-দিন শুধু ছোট করার অপচেষ্টা করেছি। ছিঃ, এ-লজ্জা আমারই বন্ধু। তোমাদের কোনো দোষ নাই। আর তোমাদের কোনো ভুল নাই।”
মাকসুদের মুখ থেকে হঠাৎ এমন সুন্দর কথা শুনে রেহান চমকিত হলো। আর সে ভাবতে লাগলো: তার ধারণা হয়তো সত্য হতে যাচ্ছে। আর রবীন্দ্রনাথের অমর উক্তি ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ কথাটারও সত্যতা প্রমাণিত হতে চলেছে! সবমিলিয়ে রেহানের মনে যেন আর আনন্দ ধরে না!
এর একটু পরে মাকসুদের আগ্রহেই রেহান রবীন্দ্রনাথবিষয়ে নানান আলোচনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেললো। আর সে একটা বিষয়ে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করলো, মাকসুদ আগের মতো রবীন্দ্রনাথকে আর উগ্রভাবে আক্রমণ করছে না। বরং তার কণ্ঠে যেন জায়গায়-জায়গায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রশংসাবাণীই প্রাধান্য পাচ্ছে। সবকিছু দেখেশুনে রেহানের মনে হলো: রবীন্দ্র-দর্শন আসলেই মানুষের চিন্তাভাবনাকে বিকশিত করতে পারে। আর এর মধ্যে একটা আশ্চর্যরকম শক্তিও লুকিয়ে আছে।

ওদের কথাবার্তার একফাঁকে রেহানের ছোটবোন মৌমিতা ওদের বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিচে নেমে গেল। ওদের দুজনের কারওই সেদিকে একটু খেয়ালও ছিল না। ওরা ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে আগের মতো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে।

রেহান জানে, মাকসুদ একসময় গান গাইতো। আর রেহানের কাছে বন্ধুত্বের প্রথম দিনে মাকসুদই তাকে একথাটি বলেছিলো। তাই, কথার ফাঁকে-ফাঁকে রেহান ভাবছিলো: তার আজকের জন্মদিনে সে মাকসুদকে দিয়ে অন্তত একটি গান পরিবেশন করাবে। এতে তার জন্মদিনের পরিবেশটা জমজমাট হবে। আর সবাই মাকসুদকে যে-ভাবে গোঁড়া ভেবে বসে আছে তারও কিছুটা অবসান হবে।

জন্মদিনের কেক-কাটার আগে ওরা দুজন নিচে নেমে এলো। আর এসময় ওদের ড্রইংরুমটা যেন একেবারে কানায়-কানায় পরিপূর্ণ। এখানে, রেহানদের পরিবারের সবাই উপস্থিত রয়েছে। অবশ্য ওদের ছোটপরিবার। ওর মা-বাবা আর ছোট বোনটি। আর-কিছু চাচাতো-মামাতো-খালাতো ভাইবোন। আর বন্ধুদের সংখ্যাই আজ বেশি।
কেক-কাটার পরে আপ্যায়ন-পর্ব শেষ হলে রেহানের লিটু-মামা নিজে হারমোনিয়াম নিয়ে এলেন। আর কে-কে গান গাইবে তিনি তার একটা তালিকা মনে মনে করতে লাগলেন। এমন সময় রেহান তার মামার কানে-কানে কী যেন বললো। এতে তার মামা হাসিমুখে তার হাতে হারমোনিয়ামের ভারটা ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। এইসময় রেহান সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে বলে বসলো: এখন আমাদের সামনে গান গাইবে আমার বন্ধু মাকসুদ।
এতে রেহানের বন্ধুরা অবাক হলো। আর তাদের ধারণা: এরকম একটি গোঁড়া-ছেলে কি গান গাইতে পারবে? নাকি শেষপর্যন্ত সে অনুষ্ঠানটি ভণ্ডুল করবে!
আর মাকসুদ তো প্রথমে ঘাবড়ে গেল। এতো লোকের মাঝে তাকে গান গাইতে হবে। এ-কী কম ভাবনার বিষয়! তবুও সে মাথাঠাণ্ডা রেখে একটু সময় নিয়ে একটা গান বাছাই করলো। আর সে নিজের হাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে লাগলো: ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি…।’ মাকসুদ একেবারে বিশুদ্ধস্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে। মাকসুদ সবাইকে খুব অবাক করে দিয়েছে। আর এখন কারও মুখে কোনো কথা নেই। আর সে এই বর্ষাদিনে কী চমৎকার একটা গান বাছাই করেছে!
সে মন দিয়ে গানটি শেষ করলো।

সকলে অভিভূত হয়ে করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানালো। এতে মাকসুদ বেশ খানিকটা লজ্জাই পেলো। কে একজন ভিড়ের মধ্য থেকে বলে উঠলো: এতো ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন, তবে আরেকটি হোক না। দেখতে-দেখতে বড়রাও তাকে আরেকটি গান গাইবার জন্য বেশ ধরে বসলো। আর সে সবার অনুরোধে আরেকটি গান গইলো: ‘একটুকু ছোঁওয়া লাগে…।’

মাকসুদের গান শুনে সবাই মুগ্ধ। আর সবাই আরও কয়েকজনের গান শুনছিলো। কিন্তু এই এরই একফাঁকে ভিড় ঠেলে কখন যে বাইরে গিয়েছিলেন রেহানের লিটু-মামা। তা কেউই বুঝতে পারেনি। তিনি এই বৃষ্টিদিনে আধাভেজা হয়ে ফিরে এলেন হাতে কিছু ফুল আর কয়েকটি বই নিয়ে। তিনি সবার সামনে মাকসুদকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানালেন। আর ওর হাতে তুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী গীতবিতান আর ছোটগল্পসমগ্র। সবাই করতালি দিয়ে আনন্দে মেতে উঠলো। আর মাকসুদের চোখে প্রায় জল এসে গেল। সে লিটু-মামার পা-ছুঁয়ে সালাম করলো।

এর কয়েকদিন পরে মাকসুদের বন্ধুরা দেখলো, মাকসুদ তার ফেসবুকের টাইমলাইনে একটা স্ট্যাটাসে রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ লিখেছে:
আমাদের রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলাসাহিত্যের সম্পদ নয়, তিনি বিশ্বসাহিত্যেরও সম্পদ। আর রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষেরা এই পৃথিবীতে সহজে জন্মে না। এবং রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষকে সম্মান করলে নিজেরও সম্মান বেড়ে যায়।




সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৬/০৮/২০১৬

 

 

 

 

১ Likes ০ Comments ০ Share ৩০২ Views