Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ইফ্ফাত রুপন

৮ বছর আগে

মা

ঠক ঠক করে দরজা ধাক্কানোর শব্দ হচ্ছে।

বীণা এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল তাই সে শুনতে পায় নি। নিশ্চয়ই তার স্বামী এসেছে। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো তার।

বীণার স্বামী নিয়াজুল হক। ডাক নাম নিয়াজ। একটি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি করে। ছয় বছর আগে বেশ শখ করে নিয়াজের সাথে বীণার বিয়ে দিয়েছিলেন বীণার বাবা। বিয়ের পর বীণা বুঝতে পেরেছিল তার বাবা মেয়ের জন্য পৃথিবীর সবচাইতে যোগ্য ছেলেটিকেই নির্বাচন করেছেন। অনেক সাজানো গুছানো সংসার ছিল একসময় তাদের। কিন্তু এখন?

বীণা কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিল। নিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। দরজা খুলতে অনেক দেরি করে ফেলেছে সে। সারাদিন ঘরের কাজ কর্ম করে এতটাই ক্লান্ত হয়ে যায় সে যে বিছানায় একটু শোয়া মাত্রই তার ঘুম চলে আসে। রাতে সে ভালো করে ঘুমুতে পারে না। কেন যেন নিয়াজের পাশে শোয়া মাত্র প্রচণ্ড ঘৃণা জন্ম নেয় তার নিজের প্রতি। এই মানুষটির প্রতি অনেক অন্যায় করে ফেলেছে সে। যতক্ষণ নিয়াজ তার চোখের সামনে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বীণার এক ধরণের অনুশোচনা বোধ হয়। নিয়াজ খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ফিরে আসে গভীর রাতে। প্রতিদিন সকালে বীণা দোয়া করে যাতে নিয়াজ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। নিয়াজ চলে যাবার সাথে সাথে বীণা কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। সারাদিন ঘরের কাজকর্ম আর রান্না বান্না করে সে। রাত হলে শুরু হয় তার আতঙ্ক। কখন নিয়াজ ফিরে আসবে। প্রতি রাতেই সে আল্লাহর কাছে দোয়া করে, নিয়াজ যাতে আজ রাতে ফিরে তার মুখ দেখতে না পায়। নিয়াজ যাতে আর কোন রাতেই আর বীণার মুখ দেখতে না পায়।

নিয়াজ আজ ঢুকল একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে। বেশ বড় একটা ব্যাগ। বীণার বেশ জানতে ইচ্ছা করছিলো ব্যাগের মধ্যে কি আছে। কিন্তু সে নিয়াজকে কিছু জিজ্ঞেস করলো। নিয়াজকে সে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না।

আজ নিয়াজের মন বেশ ফুরফুরে। আজ অনেক ভালো কেটেছে তার দিনটা। একটা বোনাস পাওয়ার পাশাপাশি বেশ পুরনো দিনের এক বন্ধুর সাথেও অনেক দিন পর দেখা হয়ে গিয়েছিল আজকে তার। এক সময় এই বাসায় তাদের সব বন্ধুদের বেশ আনা গোনা ছিল। তার বন্ধুবান্ধব, বীণার বান্ধবীরা। সবাই মিলে কত যে মজা করেছে তারা এক সময়। কত জায়গায় ঘুরাঘুরি, কত আড্ডা আরও কত কিছু। কিন্তু সেই সব কিছু এক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল।

নিয়াজ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বীণা সেই ঘটনার পর আজও তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারে নি। নিয়াজ অনেক চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক হবার। কিন্তু বীণাই কখনো আর তাকে সেই সুযোগ দেয় নি।

পুরনো বন্ধুটির কাছ থেকে নিয়াজ আজ একটি গিফট পেয়েছে। তার বন্ধুটি বলছিল অনেক আগে তাদের জন্য সে এই গিফটটি কিনে রেখেছিল। কিন্তু নিয়াজ আর বীণার সেই এক্সিডেন্টের কারণে তাকে আর সেটি দেয়া হয় নি। এখনো অবশ্য নিয়াজ গিফট এর প্যাকেটটি খুলে দেখে নি। আগে ডিনার সেরে নেয়া যাক তারপর নাহয় দেখা যাবে।

ডিনার সেরে নিয়াজ ঘুমিয়ে পরল। 












বীণা ঘুম থেকে উঠলো আজ বেশ দেরি করে। খুব ভোরে আজ নিয়াজ বেরিয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধোয়ার সময় তার চোখে পরল সোফার উপর রাখা নিয়াজের গতকালকে নিয়ে আসা ব্যাগটা।

বীণা ব্যাগটা হাতে নিলো। সে কি খুলবে এই প্যাকেটটা? নিয়াজ কিছু বলবে নাতো? মানুষ সবসময় তার কৌতুহলের কাছে হার মানে। বীণা প্যাকেটটা খুলে ফেলল।

ভেতরে বেশ বড় একটা পুতুল। অনেকটা বারবি ডলের মতো। পুতুলটি একটি মেয়ে পুতুল। বেশ সুন্দর দেখতে পুতুলটি। মাথার চুল ঝুটি বাঁধা। চোখ গুলো বেশ বড় বড় আর উজ্জ্বল। পুতুলটা এতই সুন্দর যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। বীণা পুতুলটিকে কোলে করে নিয়ে খাটের উপর বসাল। কিন্তু এটি খাটের উপর বসতে পারছিল না। খুব নরম হওয়াতে বার বার হেলে পরে যাচ্ছিল। তাই বীণা দুই তিনটি বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে পুতুলটিকে বসাতে লাগলো। আর তখনি তার অর্কের কথা মনে পরে গেলো।

অর্ক বীণার ছেলে। বীণার একমাত্র ছেলে। আজ অর্কের বয়স হতো প্রায় তিন বছর। অর্কের চোখ গুলোও এই পুতুলটির মতো বেশ বড় আর উজ্জ্বল ছিল। বাবার চেহারা পেয়েছিল সে। সেই সাথে গায়ের রঙ ও। স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল বিধায় হাঁটার সময় অনেকটা থপ থপ করে হাঁটত সে। এই পুতুলটির গায়ের রঙও অনেকটা অর্কের গায়ের রঙের মতো। মেয়ে পুতুল হলেও অর্কের সাথে বেশ কিছু মিল আছে এই পুতুলটির। অর্ক তখন মাত্র হাঁটতে শিখেছিল। গুটি গুটি পায়ে একপা দুপা করে হাঁটত সে। তিন কদমের বেশি সে আগাতে পারতো না। বীণা ঠিক সেই তিন কদম হিসেব করে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো। অর্ক টলতে টলতে তিন পা এগুতো। তারপর বীণার কোলের উপর আছড়ে পরত। বীণা হাসি মুখে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরত তখন। আর অর্কও তার ফোকলা দাঁতে মার কোলে যেতে পেরে খিল খিল করে হেসে উঠত।

অর্কের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর তখন সে আর নিয়াজ মিলে বান্দরবান ঘুরতে গিয়েছিল। বেশ ভালোই কাটছিল তাদের দিনগুলো। বীণা তখন চিন্তা করতো তার মতো সুখে পৃথিবীতে বোধয় খুব কম মেয়েই আছে। কিন্তু এক মুহূর্তে তার সব কিছু লন্ড ভন্ড হয়ে গেলো। বান্দরবান থেকে ঢাকা ফিরে আসার সময় রাস্তায় তাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নিয়াজ গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিল রাস্তার এক পাশে। বান্দরবানের অধিকাংশ রাস্তাই পাহাড়ি অঞ্চলের উপরে। রাস্তার পাশে বেশ বড় বড় গিরিখাদ থাকে সেখানে। নিয়াজ গাড়ি ঠিক করছিলো। বীণা তার অর্ককে নিয়ে চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখছিল। দেখতে দেখতে রাস্তা থেকে বেশ কিছু দূরে গিরিখাদের কিনারে চলে গিয়েছিল বীণা। গিরিখাদের নিচে তাকিয়ে বেশ শিউরে উঠেছিল সে। অর্ক তখন বড় হচ্ছিলো। কোলের মধ্যে বেশ ছট ফট করতো সে। ফিরে আসার সময় হঠাৎ কি যেন হোল। অর্ক কি যেন একটা দেখতে পেয়ে কোলের মধ্যে বেশ ছটফট করে উঠলো। আর বীণাও অর্ককে সামলাতে যেয়ে তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলো না। পা পিছলে পরে গেলো গিরিখাদের মধ্যে।

পুলিশ বীণাকে খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু তন্য তন্য করে খুঁজেও অর্ককে খুঁজে বের করতে পারে নি। কেস বন্ধ করার সময় তারা ফাইলে লিখে দিয়েছিল, “Victims body was dragged by forest animals.”

বীণাকে যখন পাওয়া গিয়েছিল তখন তার শরীরের প্রায় জায়গার হাড় ভাঙা অবস্থায় ছিল। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ায় পরবর্তী তিন মাস তাকে আইসিওর এর মধ্যে পূর্ণ লাইফ সাপোর্ট এর সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়। তিন মাস পর যখন বীণার জ্ঞান পূর্ণভাবে ফিরে আসে তখন সে প্রথমেই নিয়াজকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমার অর্ক কোথায়?”

নিয়াজ সেদিন বীণার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি। এই ঘটনার পর থেকে বীণা সম্পূর্ণ বদলে যায়। বীণার ধারণা তার কারণেই অর্ক আজ তাদের মধ্যে নেই। নিয়াজ বীণাকে সেদিন নিষেধ করেছিল যাতে অর্ককে কোলে নিয়ে গিরিখাদের কিনারে না যায়। কিন্তু বীণা তার কথা শুনে নি।

অর্কের লাশ পাওয়া যায় নি। তাই বীণা আজো বিশ্বাস করে অর্ক বেঁচে আছে। একদিন সে তার মার কাছে ফিরে আসবে। অর্কের তো লাশ পাওয়া যায় নি। কেউ তো তাকে বলে নি যে অর্ক মারা গেছে। সবাই বলেছে অর্ক হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরে আসে। অর্কও একদিন না একদিন তার মার কাছে, বীণার কাছে ফিরে আসবে।

 










নিয়াজ আজ বাসায় আসলো বেশ রাত করে। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর যখন বীণা দরজা খুলছিল না তখন সে নব মোচড় দিয়ে বুঝতে পারলো বীণা বাসায় নেই। দরজায় তালা দেয়া আছে। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে ঘড় ঘড় জাতীয় একটা শব্দ আসছে। নিয়াজ চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। বীণা কোথাও যায় নি। বাসাতেই আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে সেলাই মেশিনের সামনে বসে কি যেন সেলাই করছে। নিয়াজ বেশ অবাক হোল। এই সেলাই মেশিন বীণা গত দুই  বছরে কোন দিন ব্যাবহার করে নি। আগে অনেক সেলাই কাজ করতো বীণা। এটা তার একটা শখের মতো ছিল। সেলাই কাজে তার হাতও বেশ ভালো ছিল। কিন্তু অর্ক চলে যাবার পর থেকে আর কোন দিন নিয়াজ বীণাকে সেলাই মেশিনের সামনে বসতে দেখে নি। তাই একটু কৌতুহলি হয়েই নিয়াজ বীণার রুমে ঢুকল।

বীণা একমনে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলের শার্ট সেলাই করছে। নিয়াজ যে বাসায় এসেছে তা সে খেয়ালও করে নি। তার চোখে মুখে কেমন যেন একটা আনন্দের ছাপ দেখতে পেল আজ নিয়াজ। নিয়াজ আর বীণাকে বিরক্ত করতে চাইল না। তাই হাত মুখ ধুয়ে নিজের মতো ডিনার সেরে নিলো সে। কিন্তু নিজের রুমে ঢুকে বেশ চমকে উঠলো নিয়াজ।

খাটের উপর একটি পুতুল বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসানো। পুতুলটি মেয়ে পুতুল কিন্তু তার চুল কেটে ছোট করে রাখা হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হোল অর্কের সাথে বেশ মিল আছে এই পুতুলটির। কেমন উজ্জ্বল গায়ের রঙ যেমনটা ঠিক অর্কের ছিল, বড় বড় চোখ.........

নিয়াজ এবার বুঝতে পারলো বীণা কার জন্য জামা বানাচ্ছে। অর্কের কথা মনে পরায় নিয়াজেরও মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। অর্ক তখনও ঠিকমতো কথা বলতে শিখে নি। অনেক কিছুই বলতো কিন্তু তার উচ্চারণ স্পষ্ট ছিল না। বাবাকে সে বলতো – “ বাব্বা...”।

আজ আর নিয়াজ বীণাকে ডাকল না। নিজের মতো করে ঘুমিয়ে পরল।

 









কেক কাটার সাথে সাথে সবাই বেশ জোরে করতালি দিয়ে উঠলো।

আজ নিয়াজের বড় বোনের ছেলের জন্মদিন। বেশ বড় করে আয়োজন করেছে আজ তারা। আজ নিয়াজের বোনের ছেলে তূর্যের চার বছর পূর্ণ হোল। ছোট বেলায় অর্কের সাথে বেশ খেলত সে।

বীণাও এসেছে আজ তূর্যের জন্মদিনে। এই কয়দিনে বীণার মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। সে এখন সারাক্ষণ পুতুলটিকে নিয়ে পরে থাকে। এর মধ্যে পুতুলটিকে বেশ বদলে ফেলেছে বীণা। ছেলেদের মতো চুল করে জামাকাপড় পরিয়ে অনেকটা অর্কের মতো করে ফেলেছে সে পুতুলটিকে। মাঝে মাঝে অর্কের জামা কাপড়ও সে পরায় এই পুতুলটিকে। প্রায় সময় এখন নিয়াজ রাতে বাসায় ঢুকে বেশ চমকে যায় বীণা আর পুতুলটিকে দেখে। এক নজর দেখলে মনে হয় বীণা তাদের অর্ককে নিয়ে বসে আছে।

আজ সারাদিন বীণার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। অনেক কাজ করতে হয়েছে তার। নিয়াজের বোনেরা বীণাকে অনেক স্নেহ করে। তাদের সাথে মিলে কাজ করতে করতে আর ঘর গুছাতে গুছাতে কখন যে রাত হয়ে গেলো তা কেউ টেরও পেল না। রাতে ডিনারের পর যখন সব গেস্টরা চলে গেলো তখন নিয়াজদের খুব কাছের কিছু আত্মীয় বাসা দূরে হওয়াতে নিয়াজের বোনের বাসায় থেকে গেলো। নিয়াজের বোনেরা নিয়াজ আর বীণাকেও যেতে দিল না।

ভালোই কাটছিল তাদের রাতটা। অনেকদিন পর বীণার নিয়াজের আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা হোল। নিয়াজের আত্মীয় স্বজনদের সাথে অনেকদিন ধরে কোন যোগাযোগ ছিল না তার। আজ সবাইকে একসাথে পেয়ে বেশ ভালোই লাগছিল বীণার। কিন্তু কথা বলতে বলতে বীণা জানতে পারলো নিয়াজের দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোনের কথা। তার ৯ বছরের মেয়ে গত বছর এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আঁচার কেনার জন্য না বুঝে রাস্তার ওপর প্রান্তে যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়েছিল সে। কিন্তু ট্রাকের আঘাতে...... মাটি দেয়ার জন্য তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায় নি। শুধু তার পা দুটো অক্ষত ছিল।   

বীণার খুব খারাপ লাগলো নিয়াজের সেই বোনের জন্য। নিয়াজের বোন এখানেই আছে। খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলতে গেলো সে। কিন্তু কথা বলতে যেয়ে বেশ অবাক হোল বীণা।

নিয়াজের বোনের নাম ফাবিহা। বেশ সুন্দরী দেখতে। আর বেশ উজ্জ্বল তার পোশাক পরিচ্ছদ। মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে। অন্যান্য গেস্টদের সাথে বেশ হেসে হেসে আর মজা করে কথা বলছে সে। তার ৯ বছর বয়সের একটা বাচ্চা গত বছর মারা গেছে তাকে দেখলে কেউ বুঝতেও পারবে না।

বীণা যেয়ে ফাবিহার সাথে কথা বলল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেলো তাদের। ফাবিহা বেশ অমায়িক একটা মেয়ে। খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নেয়। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় দেখা গেলো সবার বাসায় জায়গা হচ্ছে না। এতো ছোট বাসায় এতো মানুষের জায়গা হবার কথাও না। তাই অনেককে ফ্লোরে জায়গা করে দেয়া হোল ঘুমানোর জন্য। আজ ফাবিহা শুলো বীণার সাথে।

ঘুমুতে যেয়ে অনেক কথা হোল তাদের মধ্যে। নিজেদের সংসার, হাসবেন্ড এবং সবশেষে তাদের ছেলেমেয়ের কথা উঠলো। ফাবিহার ছোট্ট আরেকটা মেয়ে আছে। ছেলেমেয়ের কথা উঠে আসাতে বীণা বেশ চুপচাপ হয়ে গেলো। তার ফাবিহাকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তার মেয়ে মারা গেছে কিন্তু তারপরও সে কিভাবে এতো হাসিখুশি থাকে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে পাল্টাতে এক সময় বীণা তাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,

আচ্ছা ফাবিহা তোমার মেয়ের নাম কি ছিল?

আনিকা।

অনেক বড় হয়েছিল তাই না?

হ্যাঁ। বড় তো হয়েছিলই। সেই সাথে অনেক দুষ্টও হয়েছিল।

তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

হ্যাঁ করো।

তুমি কিভাবে এতটা ভালো আছো? তুমি তোমার সন্তান হারিয়েছ। তারপরও তুমি প্রাণ খুলে হাসতে পারো, কথা বলতে পারো। আমিও তো আমার সন্তান হারিয়েছি। আজ এতো বছর হয়ে গেলো কিন্তু আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারি নি। অর্কের কথা ভুলতে পারি নি। সেখানে তুমি কিভাবে পারছ?

ফাবিহা বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর বলল,

বীণা আমার মেয়ে মারা গেছে। আমার চোখের সামনে মারা গেছে। আমি নিজ হাতে তার কবরে মাটি দিয়েছি। আমি জানি আমার আনিকা আর কোন দিন আমার কাছে ফিরে আসবে না। আমার কোন আশা নেই। আমি শত চেষ্টা করলেও আমার আনিকাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। তাই তার কথা আমি ভুলে আছি। আর তাই আমি স্বাভাবিক আছি। তুমি তো আজ পর্যন্ত এটাও জানো না যে অর্ক সত্যি সত্যি মারা গেছে কিনা। তোমার তো আশা আছে বীণা। তাই তুমি অর্কের জন্য অপেক্ষা করছ। আর তাই তুমি তাকে ভুলতে পারছ না। মানুষের আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে বীণা। আর মাঝে মাঝে এই আশাই মানুষকে অনেক কিছু ভুলতে দেয় না। সারা জীবন কষ্ট দেয়।

বীণার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। ঠিকই তো বলেছে ফাবিহা। তার তো আশা আছে। অর্ক আগে ফিরে আসুক। তারপর নাহয় সে স্বাভাবিক হবে। মন খুলে হাসবে।

 










হাসপাতালে ঢুকার আগে আগে নিয়াজকে অনেক প্রসেস এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এখন নিয়াজের সাথে করে আনা খাবার দাবার সব কিছু পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। নিয়াজ সবসময় চায় বীণাকে ইন্ট্যাক্ট খাবার গুলো দেয়ার জন্য। কিন্তু তা আর হয় না। হাসপাতালে ঢুকার আগে সবাই এক চামচ করে তা পরীক্ষার জন্য চেখে দেখে।

বীণা এখন আছে একটি মানসিক ভারসাম্যহীনদের হাসপাতালে। তার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হয়ে যায়। সে শুধু তার পুতুলতাকে নিয়ে পরে থাকতে শুরু করে। আস্তে আস্তে সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যায়ে তার অবস্তা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে সে কোন মানুকে আর চিনতে পারতো না। পরে আর কোন উপায় না দেখে তাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

বীণা এখন নিয়াজকেও চিনতে পারে না। একমনে তার পুতুলটিকে নিয়ে পরে থাকে। পুতুলটিকে অর্ক বলে ডাকে। নিজের সন্তানের মতো আদর করে। নিয়াজ সপ্তাহে দুই দিন আসে বীণাকে দেখতে।

নিয়াজ বীণার চেম্বারে ঢুকে দেখে বীণা ঘুমিয়ে আছে। তার পুতুলটিকে জড়িয়ে ধরে। নিয়াজ তার জন্য আনা খাবার গুলো নিয়ে খাটের পাশে রাখা চেয়ারটাতে চুপ করে বসে থাকে।

বীণার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য সে হারিয়ে যায় তাদের আগের দিন গুলোতে। সে বীণা আর অর্ক।

যখন বীণা অর্ককে জড়িয়ে ধরে ঘুমাত তখনও মাঝে মাঝে নিয়াজ বীণার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাকিয়ে থাকতো একজন মা আর তার বুকের একমাত্র অবলম্বনের দিকে............

                               

 

                                             

 

 

 

 

 

 

 

০ Likes ৪ Comments ০ Share ৪৬৬ Views

Comments (4)

  • - কাল বৈশাখী ঝড়

    অসাধারন... 

    - প্রলয় সাহা

    মারাত্মক লেখা। ভালো থাকবেন।