Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কে এম রাকিব

১০ বছর আগে

মধ্যরাত্রি দর্শন

রাত ১২ টার সময় সেদিন আমি আর আমার মামা প্রথম বের হয়েছিলাম ঢাকার মধ্যরাতের চেহারা দেখতে। মামা ডাক্তার মানুষ । তবে তার মধ্যে দার্শনিকভাব প্রবল। তার চাপাচাপিতেই বের হওয়া। নইলে সাধের ঘুম রেখে আমি কি আর রাস্তায় ঘুরতে বের হই? মামা তার প্রিয় শিল্পীর নাম নিয়ে বলল, রাত্রি দিনের চাইতেও বর্ণময়, জানিস? আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম, জ্বি মামা ঠিক বলেছ। এমনিতেই মামা আমার জন্য দুই অক্ষরের একটা শব্দ বরাদ্দ রেখেছেন। বদ। । তাছাড়া ইকোনমিক ক্রাইসিসে আমার মত বেকারের এই একমাত্র মামাই মুশকিল আসান। তাকে ঘাটিয়ে লাভ নেই। মন্ত্রীর স্তাবকদের মত হয়ে যেতে হবে! তবে আমিও কম ঝানু লোক না। শর্তসাপেক্ষে বের হয়েছি। আমার জন্য একটা প্রেমের চিঠি লিখে দিতে হবে।একজনকে দেব। মামা কাব্যিক কথা বার্তা বলে, কবিভাবাপন্ন। লেখার হাতও খারাপ না। রাস্তায় হাটছি আর কথা বলছিঃ

মামা কড়া লিকারের কয়েকটা ডায়লগ ঢুকিয়ে দিও

মামা বলল, কড়া লিকারের ডায়লগ আবার কিরে?

মানে ভালবাসা, প্রেম, 'তোমাকে ছাড়া বাচবো না' টাইপ কথাবার্তা। যা শুনেই ফিদা হয়ে যাবে।

ফিদা হয়ে যাবে? এম এফ হুসেন? ইন্ডিয়ান পেইন্টিং জিনিয়াস?

না মামা, আমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়বে।

ও তাই বল! এসব ডায়লগ ডিজিটাল যুগে অচল। তার চেয়ে এস এম এস লিখে দে। চোস্ত ইংলিশে লিখবি। এদেশে এখন ইংলিশটা পাবলিক ভাল খাচ্ছে।
কিন্তু ভাল ইংলিশ ত আসে না, সব জায়গায় গাইড বই মেরে পার পেয়ে গেছি। প্রেমে তো গাইড বই অচল।

গাইড বই পড়ে পড়েই মিসগাইডেড হয়ে গেলি।

তোমার উপদেশ মার্কা কথা রাখো। পারলে হেল্প করো।

আচ্ছা বাদ দে। ঢাকার রূপ দ্যাখ। নির্জন শান্ত সমাহিত। চেতনা ছুয়ে যাবার মত কোলাহলশূন্যতা। মজাই আলাদা। বুঝলি কিছু সৌন্দর্য্য আছে ভোগের আর কিছু আছে উপভোগের। এটা উপভোগের। উপভোগ কর।

মামা, লোকটা যাচ্ছে কই? এমন দৌড়ে- হঠাৎ ছুটন্ত একটি লোককে দেখিয়ে বললাম।

মামা আর আমি দেখতে চাইলাম অমন তড়িঘড়ি করে লোকটা কি করতে চায়। একটু দূরের থামের কাছে গিয়েই লোকটি জিপার টেনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিল।
মামা বলল, লোকটি বুদ্ধিমান, বুঝলি!
কেন বুদ্ধিমান এই প্রশ্ন করার আগেই বলল, সংস্কৃতে শ্লোক আছে, নং বেগং ধারয়েৎ ধীমান' মানে বুদ্ধিমানমাত্রই বেগ ধারন করে না। এই লোকের বেগ চেপেছে কিন্তু সে ধারন করেনি। তাই বুদ্ধিমান।

হাহাহা করে হেসে উঠলাম উচ্চস্বরে। (অবশ্যই মামাকে খুশি করতে!)

মামা কিন্তু বিরক্ত হল। এত জোরে হাসবি না, রাতে নৈঃশব্দ্যের পর্দা থাকে, সেটা ছিড়ে যায়।

রাতও কি পর্দানশীন?

তুই ভার্সিটি উঠে আসলেই বদ হয়ে গেছিস।- মামা খুব বিরক্ত হলেন। এই হল মুডি মানুষের অবস্থা, এই মেঘ এই রৌদ্র। শ্রাবণমাসের আকাশের মত( এই উপমাটাও মামার কাছ থেকে শিখেছি!)

মামা চা খাই চলো, ভাল লাগবে।
ট্রাউজার্সের পকেট থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে হাতে দিলেন। 'আর টাকা পয়সা নেই। যা করার করবি এই টাকায়'

এত কঞ্জুস কেন তুমি? একশ টাকা নিয়ে কেউ বের হয়?

হঠাৎ রাস্তায় আমাদের সামনে তিন ব্যক্তি উদিত হলেন। নেতা গোছের লোকটি সামনে, বাকী দুজন আমাদের দুইপাশে।

নেতা হুকুম দিলেন, টিভিতে দেখা গুন্ডাদের মতই, যা আছে বাইর কইরা দে

ভাই আপনারা কারা? আমি ডক্টর শিহাব- মামা হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ওই ফাইজলামি করস? একটা থাবড়া দিয়া তর থোতমা লাড়াইয়া দিমু। মানুষ চেনস?

অল্পকালের জন্য মামা হতভম্ব হয়ে গেল। নিচুস্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলঃ 'থোতমা লাড়াইয়া দিমু মানে কি'

তোমার মেডিকেলের ভাষায়, ডিস্লোকেশন অফ ম্যান্ডিবল, ম্যান্ডিবল ডিসলোকেইট করে দেবে। -বললাম আমি।

'বলিস কি?' মামা আরো ভয় পেয়ে গেল। বলল,ভাই আমাদের কাছে তেমন কিছু নাই। একশ টাকা আছে নিবেন?

এবারে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল মামার গালে। 'আমারে ফকিন্নির বাচ্চা পাইছস?' একশ টাকা দিবি?

বাধ্যগতদের নির্দেশ দিল, ওই তোরা খাড়ায়া দেখস কি? দেখ কি আছে ফকিন্নির বাচ্চার'

মিনিট দুই আমাদের বডি সার্চ করে হতাশ কন্ঠে বলল, ওস্তাদ একশ টেকা আর একটা চাইনিজ মোবাইল এর পকেটে পাইছি।- আমাকে দেখিয়ে বলল।

রাইখা দে। ফকিন্নির পুতেরা কাইনব।- রাগে গজর গজর করল ওস্তাদ।

এই ফকিন্নির পুতেরা ওইদিক ফিরা খাড়া।- আমরা নির্দেশ মানলাম।
পেছন থেকে দুজনের পাছায় লাথি দিয়ে বলল, দৌড়া দৌড়া। থামলেই মাইরা লাগামু।

আমরা দৌড় দিলাম। বেশ কিছুদূর এসে হাপাতে হাপাতে বললাম, মামা মন খারাপ হয়েছে?
নাহ! মন খারাপ কেন হবে? আসলে ওর ইগোতে লেগেছে। একশো টাকার কথা বলাটা। ফ্রয়েডের থিয়োরী ইগো আর সুপারিগোর কথা বলেছে। আমারই ভূল হয়েছে।

বাদ দে এসব। শহর দেখি আয়।

মামা ফিরে যাবে বাসায়?

কেন? পাগল তুই? না ভীতু? ১০০ টাকা এখনো আমাদের হাতে আছে। তুই আমাকে কঞ্জুস বলেছিলি। দেখলি তো বেশি টাকা আনলে কি হত!

একটু থেমে আবার বলল, গান জানিস পল্টু?

না মামা! তাহলে এতদিনে দু একটা মেয়ে পটিয়ে ফেলতাম। তুমি জানলে শোনাও। মামিকে তো পটিয়েছ।

সে তো কবিতা দিয়ে!

তাই চলুক।

মামা শুরু করলঃ
''এখন আকাশে ঘুম নেই
তবু
ঘুমের ইশারা
এনেছে তোমার চোখ ।'

মামা, ঘুম কি আকাশে থাকে কখনো?- আমি বাগড়া দিলাম।

তুই কবিতা কিছুই বুঝিস না। ধুর!

মামা হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। চলো বসি।

রাস্তায় কিছুদূর পর পর একটা দুটো চায়ের দোকান। মামার সম্মতি পেয়ে একটায় গিয়ে বললাম, দুই কাপ চা। দোকানদার আমার কথা শুনল বলে মন হয় না। কোন কিছু নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছে। অবশ্য পাশাপাশি টিভিও চলছে, নায়িকা সুর করে গান গেয়ে যাচ্ছে পিয়ানো বাজিয়ে, কিন্তু কেউ শুনছে না। হঠাত দেখলাম, গালাগাল শুরু হয়ে গেছে।
মামা বলল, চল চা খেয়ে কাজ নেই। যে অবস্থা। মাঝরাতেও ঝগড়া।
বের হয়ে এলাম।

গালাগাল দেখে বুঝলাম চায়ের দোকনটি ছিল সংসদ টিভির মত। ওনলি ফর এডাল্টস। ছোটবেলায় 'টি স্টল' প্যারাগ্রাফে পড়েছি, A tea  stall is often called a mini-parliament'. ছোট বেলার শিক্ষা বড় গভীর শিক্ষা, অব্যর্থ বস্তু, হাড়ে হাড়ে টের পেলাম ।
আমরা একটা রিকশা নিলাম, যেহেতু পকেটে ১০০ টাকার নোট, আবার হাটতে হাটতে ক্লান্তও হয়ে গেছি। দেখলাম, আসলেই রাতের চেহারা দেখার মত । গাছগুলোও সুন্দর দেখতে। রাস্তায় মাঝেমধ্যে মানুষ দেখা যায়, কেউ কেউ সিগারেট ফুকছে,(হয়ত গঞ্জিকাও আছে) দলবেধে, কেউ একা ঝিমাচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের নিচে। মাঝে মধ্যে রূপপোজীবিনীর দেখাও মিলছে, মাতালও দেখলাম একটা। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে দুজন দুজন করে পুলিশ। উদাস উদাস ভাব চলে এলো। মামা আগে থেকেই উদাস, চুপচাপ। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, রিকশা বেশ জোড়ে চলছে। ব্যাটারিচালিত রিক্সা। আস্তে চালাতে বললাম।

আচ্ছা মামা, একটা জিনিস খেয়াল করেছ? নরমাল রিক্সায় ব্যাটারীচালিত রিকশার চেয়ে ভাল লাগে।
মামা উদাস হয়েই আছে, মাঝে মধ্যে আকাশ দেখছে। একটু পরে বলল, হুম করেছি। আসলে দুইটাই সমান। নরমাল রিকশায় আরাম বেশি পাই কারন তাতে চালকের কষ্ট বেশি হয়। অন্যের কষ্টে আমরা আনন্দ পাই।

মামা আবার ঝিম মেরে গেছেন। রিকশা ছেড়ে দিয়ে আমরা হেটে হেটে বাসায় ফিরলাম। আসার পথে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কিছুই ছিল না। শুধুমাত্র একবার পথে একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে, মামা কেঁদে উঠে বললেনঃ
হে বৃক্ষ, হে প্রকৃতির অক্সিজেন সিলিন্ডার, ঢাকার বাতাস তো সীসার ভান্ডার, বাড়াও তোমার প্রজননের হার।
মামার ভেতরে কাব্যভাব দেখে গাছ থেকে মামাকে ছাড়িয়ে বললাম, মামা, মামী কিন্তু জেগে আছে, অপেক্ষা করছে, চলো।

এই হল আমাদের মামা ভাগনের ঢাকাশহরের প্রথম মধ্যরাত্রি দর্শন। সেবারই প্রথম বুঝেছি কেবল সুন্দরী না শহরেরও প্রেমে পড়া যায়। এরপর আমরা আরো অনেকবার বের হয়েছি। এখনো হই মাঝেমধ্যেই । প্রত্যেকবারই কিছু জিনিস কমন থাকে। পুলিশ, নাইট গার্ড, চায়ের দোকান, রূপপোজীবিনী, নেশারু, কিংবা নিশিপাওয়া লোক। এক ধরনের আবহমানতা আছে এই গভীর রাত্রির শহরের। মনে হয়, গদির লড়াইয়ে রাজনীতিখোরেরা যেমন এদেশে কোস্তাকুস্তি করে যাবে নিরবধি কাল, গ্রামের বাদুর যেমন মধ্যরাতে চুষতে থাকবে স্বাদু বিচিকলা, তেমনি আমাদের এই শহরের দুপুর রাতে চলতে থাকবে এইসব।

 

০ Likes ২৭ Comments ০ Share ১০৮০ Views

Comments (27)

  • - জাহাঙ্গীর আলম

    অসম্ভব ভালো লাগল ৷ ধন্যবাদ ৷

    - আলমগীর সরকার লিটন

    অসাধারন কবিতা-----

    - মোকসেদুল ইসলাম

    বাঃ চমৎকার লিখনী

    Load more comments...