ছোটবেলার কথা। মধুকে আমি দেখেছি। মধু আমাদের পোষা বাঁদরের নাম। ওর কথা আমার ভাল ভাবে মনে নেই। তবু যেটুকু মনে আছে আর ঠাকুমা,মা,বাবা,কাকাদের কাছে যেটুকু গল্প শুনেছি সব মিলিয়ে আজ মধুর কথা লিখতে পারলাম।
সেবার ঢাকার খিদিরপুর গ্রামে গিয়ে ছিলাম। আমাদের পৈত্রিক বাড়ি। মধু সেখানেই থাকত। মধুকে কি ভাবে কোথায় পাওয়া গিয়ে ছিল তা আজ আর মনে নেই।
মধু আমাদের পোষমানা বাঁদর। বাঁধা থাকলে কারু কোন ক্ষতি করে না। তবে জাতে বান্দর তো ! কখনোসখনো খোলা থাকলে কেউ ভয়ে তার কাছে যেতে চায় না। কখন কি করে বসবে তার ঠিক আছে ?
তবে দেখেছি যে আমার ঠাকুমা আর আমাদের বাড়া বানার এক বয়স্কা বউ মধুর পেছনে খুব লাগত। আর ওই কাজ ওরা করত ও যখন বাঁধা থাকত তখন। দূর থেকে লাঠি দেখাত,মুখ ভেংচাত বান্দরের মতই নানা রকম মুখের অঙ্গভঙ্গি করত। এসব করার জন্যে মধু ছিল ওদের ওপর বেজায় খেপা। কিন্তু বেচারা মধু কিছুই করতে পারত না,কারণ--ও যে থাকত শিকলে বাঁধা ! এক দিন মধু ছুটে গেল। ঠাকুমা,বাড়া বানার বউ তো তা জানে না। ওরা যথারীতি মধুর পিছে লাগবে বলে তার কাছেই যাচ্ছিল। মধু যেই না ওদের দেখল অমনি দিলো বেদম তাড়া--তাড়া খেয়ে ওরা তো পালাতে গেল,কিন্তু এত তাড়াতাড়ি পালাবে কোথায় ?পড়ি মরি করে ঠাকুমা গিয়ে পড়ে গেলেন কুয়ো তলায়। ঠাকুমা ত্রাহি ত্রাহি করে চীৎকার করছেন,বাঁচাও বাঁচাও বলে। আর বাঁচাও ! ইতিমধ্যে মধু ঠাকুমাকে খামচানো শুরু করে দিয়েছে। চীৎকার চেঁচামেচিতে বাবা কাকা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন।
বাবা,কাকাদের দেখে ঠাকুমাকে ছেড়ে এবার মধু ছুটল বাড়া বানা বৌয়ের দিকে। সে তখন গোয়ালে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। বাবা, কাকার গলা শুনে উঁকি মেরে দেখতে গিয়েছিল মধু কোথায়। ব্যাস আর যায় কোথায় ? মধু তাকে তাড়া করে নিয়ে গেল উঠোনে।বাড়া বানার বউ গলা ছেড়ে চীৎকার করছিল,উঠোনে দু পাক ঘুরতে না ঘুরতেই চিত হয়ে গেল পড়ে।
এবার মধুর পালা। ও গালে আর হাতে দুই খামচি দিয়ে আর কোথায় খামচাবে বোধহয় ভাবছিল,ততক্ষণে বাবা আর কাকা মধু,মধু,চীৎকার করেতে করেতে মধুর কাছে এসে হাজির হল। মধুর আর কামড়ানো হল না--তবু আপাতত শোধ নেওয়া হয়ে গেল বলে বাবার হাতে ও ধরা দিল। বাবা মধুকে দু চারটে লাঠির বাড়ি মারল। ওকে শাসন করে আবার সুপারি গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে দিল বেঁধে।
আমার বয়স তখন খুব কম। চার বছরের মত হব। একদিন মধু নাকি ছাড়া পেয়ে আমার পাশটায় এসে বসলো। আমি কিছু নিয়ে খেলা করছিলাম। মা ব্যাপারটা দেখে চীৎকার করে উঠলেন।মধুর কি মনে হল কে জানে ও হঠাৎ আমায় কোলে তুলে নিলো--ঠিক যেমনটা বাঁদর তার বাচ্চাকে কোলে নেয়।
এ দৃশ্য দেখে মার তো চোখ চড়ক গাছ ! ভয় পেয়ে তিনি চেঁচামেচি করে উঠলেন। মধু এবার উদ্ভূত ব্যাপার করল। ও আমায় কোলে নিয়ে এক লাফে চড়ে গেল ঘরের চালে। হৈচৈ করে ঘরের সবাই তখন চালের নীচে জড়ো হয়েছে। সবাই হায় হায় করছিল। মা আর ঠাকুমা জোরে জোরে কাঁদ ছিলেন। বাবা,কাকারা তখন ঘরের বাইরে কোথাও ছিলেন,শুনতে পেয়ে তাঁরা ছুটে এলেন।
মধু তখন আমায় কোলে নিয়ে দিব্বি বসে আছে। মাঝে মাঝে আমার মাথা থেকে উকুন বেছে দাঁত দিয়ে চিপে মার ছিল বা খাচ্ছিল। আমায় কিন্তু মধু এতটুকু আঁচড় গায়ে লাগতে দেয় নি--কামড়ানো তো দুরের কথা। হ্যাঁ,মাঝে মাঝে মধু নাকি আমার গালে ওর গাল ঘষছিল। মনে হয় আদর করছিল। ঠিক যেমনটা আমায় আমার মা বা ঠাকুমা করতেন। শুনেছি বাঁদরের অনুকরণ শক্তি নাকি খুব বেশী !
যাই হোক,বাবা নাকি এসে আমায় উদ্ধার করলেন। ঘরের চালে মই লাগিয়ে আমায় অক্ষত নামিয়ে আনলেন। বাবা মধুকে মারতে গেলে মা তাঁকে বারণ করেছিলেন। কারণ মধু তো আমার কিছু ক্ষতি করে নি,আমায়বরং ভালবেসেছে।
মধু চাইতো না যে আমাদের ঘরের কেউ ওকে ছড়ে বাইরে যাক--গেলেও বেশী সময়ের জন্যে যাক। কাকু বা বাবাকে যখন দু একদিনের জন্যে বাইরে যেতে দেখত তখন মধুর একদম ভাল লাগত না। যেই দেখত হাতে ব্যাগ বা সুটকেস নিয়ে কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে মধু কান্না করত,চিকণ সুর নিয়ে,কাঁই,কাঁই করত। তারপরও যখন চলে যাচ্ছে দেখত তখন ও কাঁদতে কাঁদতে সুপুরি গাছে বেঁধে রাখা চেন সুদ্ধ ঘষটে ঘষটে ওপরে উঠতে থাকত।বাড়ির লোকটা চলে যাচ্ছে তা দেখতে থাকত। এমনি ভাবে কাঁদতে কাঁদতে ও চড়ে যেত সুপুরি গাছের এক্কেবারে আগায়। সেখান থেকে ঘরের মানুষটিকে যত সময় দেখা যেত ও দেখতে থাকতো। তারপরও কিছু সময় অপেক্ষা করে ও নিচে নেমে আসতো।
মধুকে নাকি বাচ্চা থেকে বাবা,কাকারা আদর করে পেলে ছিলেন। তাঁরা ওকে বেশ ভালবাসতেন।মা ছিলেন অন্নদাতা। দুবেলার খাবারটা এনে বাবা বা কাকার হাতে তুলে দিতেন মধুকে দেবার জন্যে। মধুতা দেখেছে।
এমনি ছিল আমাদের বাঁদর,মধু।
তারপর এলো সেই ক্ষণ। আমরা দেশ বাড়ি ছেড়ে ভারতের দিকে রওনা হলাম। মধুকে দাদু রাখতে পার ছিলেন না। তাই আমাদের সঙ্গে ওকে নিয়ে চললাম। জাগার কথা মনে নেই, সেখান থেকে আমাদের নৌকা চড়তে হবে। বাবা সেই নদীর পারের এক গাছের গোড়ায় মধুকে বেঁধে নৌকায় ফিরে এলেন।
মধু সেই গাছের গোড়ায় বাঁধা পড়ে রইলো। আমাদের নৌকো ছেড়ে দিল। মনে আছে আমি দেখছিলাম,মধু আমাদের সঙ্গে আসার জন্যে কত লাফঝাঁপ করছিল ! কত চীৎকার, চেঁচামেচি করছিল ! আমি ডুকরে কেঁদে উঠে ছিলাম,চীৎকার করে বলে উঠে ছিলাম,বাবা,মধুকে নিয়ে এস—বাবা,মধুকে নিয়ে এস--ও মরে যাবে...
সত্যি,তখন সবাই শোকে মুহ্যমান--কারো মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। বাবা আমার পিঠে তাঁর সান্ত্বনার হাত ঠেকিয়ে বলে উঠে ছিলেন,বাবা,মধুকে আমরা নিয়ে যেতে পারব না,বাবা !
সমাপ্ত
Comments (3)
নক্ষত্রব্লগে স্বাগতম সেলিনা আপা। প্রথম পোস্টের জন্য রইলো অনেক অনেক অভিনন্দন। ভীষণ খুশি হলাম আপনাকে এখানে পেয়ে।
আপনার বন্ধুর বাবাকে আল্লাহ্ বেহেস্ত নসীব করুন। আমীন।
**************
জানিনা ঘটনাটা সত্যি না কল্পনা প্রসূত। তবে লিখেছেন খুব যত্ন নিয়ে বুঝা যাচ্ছে। নীলার ভালোবাসা আর বিশ্বাসকে সে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে হারানো প্রেমকে নতুন সঙ্গী করে নিয়েছে। পোড় খাওয়া নীলার সেটা মেনা নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ছোট্ট শিশু জুঁইকে নিয়ে বাকী জীবন কাটানোর প্রতিজ্ঞায় প্রামাইমারি স্কুলের চাকুরীটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুঁইকে বাবার ভালোবাসার অভাবটা বুঝতে না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করছে নীলা। নিষ্ঠুর বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পারবে কিনা কারো জানা নাই। কিন্তু একটা মানুষ দশ বছর বিবাহিত জীবন পার করে দিয়ে কীভাবে তার স্ত্রীকে ফেলে চলে যায়। এদের আসলে মানুষ বলাও ঠিক না। এরা পশুর চাইতেও অধম। এদের জন্যই আমাদের সমাজে ব্যভিচার, হত্যা, পরকীয়া দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ধিক্কার জানাই এইসব রুদ্রদের।
অনেক ভালো লাগলো গল্পটা সেলিনা আপা। আপনার স্বভাবজাত ভালো লেখারই একটা ছোট্ট সৃষ্টি। অনেক দিন ধরে ব্লগে দেখি না। লেখার ধার যে একটুও কমে নাই বুঝা যায়। ধন্যবাদ সেলিনা আপা। আশা করছি নিয়মিত দেখা হবে।
আফা কেমুন আছুন ?
অনেক দিন পর ব্লগ এ পেলাম শুভ কামনা জানবেন ।
ফেসবুক বা নেট এর যে কোন ছবি উপর রাইট বোটম ক্লিক করে ছবি কপি করে ব্লগ এ পেস্ট করেন
বেশ লাগল ,,,,,একুশের শুভেচ্ছা,,,,,,,
আপনাকেও একুশের শুভেচ্ছা রইল ..। ধন্যবাদ
অসাধারণ৷ বিশেষ করে শেষ অংশটুকু অন্যরকম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ৷ ভাল থাকবেন ৷
ধন্যবাদ সময় দিয়ে পড়ার জন্য