Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লীলা নাগের ১১৪তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা


লীলাবতী নাগ, লীলা নাগ বা লীলা রায় তিন নামেই তিনি পরিচিত। তিনি কে ছিলেন তা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। বিশ শতকের প্রথমার্ধে শুধু ঢাকা শহরেই নয়, পুরো বাংলায় অসামান্য মহিলা, রাজনিতীবিদ, সংগঠক হিসাবে যিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লীলা নাগ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম ছাত্রী, সাংবাদিক এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী। উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও নারী জাগরণের পথিকৃত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নারী লীলা নাগ। তার পৈত্রিক বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে। লীলা রায় মহিলা সমাজে মুখপাত্র হিসেবে “জয়শ্রী” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ছিলেন। লীলা রায় ছবি আঁকতেন এবং গান ও সেতার বাজাতে জানতেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেত্রী ছিলেন। এ জন্য কয়েকবার তাঁকে কারা বরণ করতে হয়। ১৯০০ সালের আজকের দিনে তিনি ভারতের আসামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ১১৪তম জন্মবার্ষিকী। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের নারী নেত্রী লীলা রায়ের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।


(সিলেটের পাঁচগাঁও ইউনিয়নে বিপ্লবী লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা রায় ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী লীলা নাগ ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ আসাম সরকারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাধে চাকরি সূত্রে লীলা নাগের পরিবার আসামের বাসিন্দা হয়। তার মা কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন সুগৃহিণী। তার পিতৃ-পরিবার ছিল তৎকালীন সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও-এর অন্যতম সংস্কৃতমনা ও শিক্ষিত একটি পরিবার। ১৯০৫ সালে আসামের দেওগর বিদ্যালয়ে লীলা নাগের শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে দুবছর অধ্যয়নের পর ভর্তি হন কলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে। ১৯১১ সালে ঢাকার ইডেন হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালে ওই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৬ সালে লীলা নাগের পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ চাকরি হতে অবসর গ্রহণের পর স্থায়ীভাবে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন। তবে ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর লীলা নাগ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। সে কলেজে সেরা ছাত্রী ছাড়াও ছবি আঁকা, গান ও বিভিন্ন খেলাধুলায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ জন্য কলেজের সবার মধ্যমণি ছিলেন লীলা নাগ। কলেজের রি-ইউনিয়নের উদ্যোক্তা হিসেবে সিনিয়র স্টুডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সবাইকে চমকে দেন তিনি। কলেজে শিক্ষাকালীন লীলা নাগ ‘লোকমান্য তিলক’র মৃত্যুদিবস উপযাপনকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং ছাত্র-ধর্মঘটের ডাক দেন। এছাড়া ‘বড়লাট’ কে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানানোর প্রথা বাতিলের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন।

১৯২১ সালে লীলা নাগ মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ পাস করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ওই বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা অর্থাত্ সহশিক্ষা চালু ছিল না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. রবার্ট হার্টস লীলা নাগের মেধার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ইংরেজি বিষয়ে মাস্টার্স শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থায় লীলা নাগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও ঋষি রামানন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯২৩ সালে লীলা নাগ ইংরেজি বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রীধারী। তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা রায়ের মেধা ও আকাঙ্খা বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চান্সেলর ডঃ হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন। তার একক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই।

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে লীলা নাগ বিপ্লবী অমিত রায়কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার নাম হয় শ্রীমতি লীলাবতী রায় যিনি লীলা রায় নামে সমধিক পরিচিত। বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে লীলা রায় বিশেষ ভুমিকা পালন করেছেন। তিনি ঢাকার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় (তৎকালীন নারীশিক্ষা মন্দির) প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত বিভাগের পর লীলা নাগ কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা নাগ (লীলা রায়) ও অনিল রায় দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। তিনি কাজ করেছিলেন পূর্ব বাংলার সংখ্যলঘু রক্ষা ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে। সক্রিয় ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। এ সময়ে সুফিয়া কামাল কোলকাতা থেকে ঢাকায় শরনার্থী হয়ে আসলে লীলা রায় তাকে সাহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগে গঠিত হয়েচিল "পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি" যা বর্তমান মহিলা সমিতির শেকড়। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিমলীগ সরকারের কোপানলে পরে ১৯৫১ সালের দিকে লীলা রায় ও অনিল রায় দম্পতিকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে। ১৯৫১ সালে তৎকালীন ভারত সরকার উদ্বাস্তু উচ্ছেদের বিল আনেন। এ বিলের প্রতিবাদ করায় গ্রেফতার হন লীলা রায়। ১৯৫২ সালে লীলা রায়ের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় অকাল বৈধব্য এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথী স্বামী অনিল রায়কে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন লীলা রায়। অল্পদিনের মধ্যে গভীর শোককে কাটিয়ে ওঠে তিনি সমাজ বিপ্লবের সংগ্রামকে বেগবান করার কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে লীলা রায় জয়প্রকাশ নারায়নের সমাজবাদী শিবিরে যোগ দেন।

১৯৬৪ সালের ২৫ মার্চ ‘পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটি’র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে পুলিশ লীলা রায়কে গ্রেফতার করে। ১৯৬৬ সালে মুক্তিলাভের পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাঁকে কোলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বাকশক্তি। শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে যায়। এ অবস্থায় আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন ভারতে উপমহাদেশের মহীয়সী নারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক জয়শ্রী সম্পাদিকা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লীলা নাগ ওরফে লীলা রায় ৬৯ বছর বয়সে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আজ এই মহিয়সী নারীর ১১৪তম জন্মবার্ষিকী। উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি মহিলা সাংবাদিক লীলা নাগের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

০ Likes ১ Comments ০ Share ৭৯৭ Views