Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

হরি দাস পাল

৮ বছর আগে

বেঁচে থাকার সুখ(প্রতিযোগীতা/২০১৬, ক্যাটাগরি-২)

যে অফিসে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল, সেই অফিসের রিসিপশনিষ্ট মেয়েটিকে নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা ভেবেছিল আসাদ। পরিপার্টি সুন্দর অফিসের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে মেকাপের আড়ালে বয়স লুকানোর যথার্থ চেষ্টা করেছে মেয়েটি এবং সফলও হয়েছে বলতে হবে। মাত্র একঘন্টা মেয়েটির সামনে বসে থেকে আসাদের মধ্যবিত্ত মানুসিকতা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল যে, এই অফিসের অন্তত ছয় জনের সাথে মেয়েটির গভীর প্রেমের সম্পর্ক্য আছে। আরো দুজনের সাথে হবু হবু প্রেম। মেয়েটি আশ্চর্যজনকভাবে অফিসের বেশিরভাগ কর্মচারীরর বাড়ির খবর, ঘরের খবর এমনকি হাড়ির খবরও জানে। ছেলের জন্মদিনে আয়নাল সাহেব কি রঙের শার্ট পরেছিলেন, আজিজ ভাইয়ের শ্যালিকা কার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে, হারুন সাহেব ডিনারে কি খেতে পছন্দ করেন, হেন কোন খবর নেই যে, মেয়েটি রাখেনা। গল্পটা শুরু হবেও সেভাবেই। কিন্তু পরীক্ষাটা এত বাজে হয়ে গেল যে গল্পটল্প আসাদের মাথা থেকে উড়ে গেল।

বাইরে বের হয়ে মনে হল, এই মুহর্তে একটা দবদবে গরম চুলোর মধ্যে প্রবেশ করলো আসাদ। বিআরটিসির একটা ডাবল ডিপোতে উঠে কোন রকমে একটা সিট ম্যানেজ করে বসে পরলো সে। বুকের উপর শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিল। বিষন্নতায় মন ছেয়ে আছে তার। এই চাকরীটাও বোধহয় হবেনা। অথচ খুব প্রয়োজন ছিল। মা’র শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। ছোট বোনটাও দেখতে দেখতে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী। বোনটি তার মেধাবী। অথচ ওর পড়াশোনা চালানোর সামর্থ্য বাবার নেই। টাকার অভাবে যদি ওকে বিয়ে দিয়ে পরের হাতে তুলে দিতে হয় নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবেনা আসাদ। তাছাড়া অল্পসল্প করে বন্ধু-বান্ধবের কাছেও ঋন জমেছে অনেক। এমন সময় চাকরীটা খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে সুযোগও মনেহয় গেল।

মরা নদীর বুকে যেভাবে শ্যাওলা ভেসে থাকে ঠিক সেইভাবে যানবাহনগুলো আটকে আছে প্রচন্ড জ্যামে। আসাদের পাশের ভদ্রলোকটি এক ছোলাওয়ালা ছোকড়ার সাথে ছোলার দাম নিয়ে বারগেনিং করছে। ওই, এইটুকুন ছোলার দাম দশ টাকা! গাঁঞ্জা খাইছো নাকি? পাঁচ টাকায় দিবা? ছোকড়াটিও নাছোড়বান্দা। জে, না। একদাম দশ টাকা। আচ্ছা যাও, সাত টাকা? কইলাম তো কম নাই। লোকটি গলা চড়িয়ে বল্লো, কম নাই মানে! তোমার ছোলা কি মোদন ঘোষের সন্দেশ নাকি? আট টাকার এক পয়সাও বেশি পাবানা। রাজি? আসাদের মেজাজ চড়ে গেল। তবু সে বসেবসে দশ মিনিট দশদিক ভেবে নিল্। নাহ! সে কিছুতেই নিজের অস্তিত্বের গুরুত্ব খুঁজে পেলনা। নেই, হচ্ছেনা, হবেনা, হাহাকার, পারছিনা এইসবের মধ্যে বেঁচে থেকে কি লাভ? জীবন যেখানে ছোলার দর কষাকষি সেখানে মরণই শ্রেয়। ঢাকা শহরে তো কত রেল ক্রসিং আছে। যেকোন একটাতে গিয়ে ট্রেনের সামনে লাফ দিলেই ঝামেলা শেষ! ধুত্তোরি বলে বাস থেকে নেমে পড়লো সে। আজ জীবনের একদিন কি তার একদিন। যখন থেকে আসাদ আত্নহত্যার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে তখন থেকেই বুকটা কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে। এমন সময় একটা সিগারেট ধরাতে পারলে বেশ হয়! রাস্তার পাশেই বাক্স বাটরা নিয়ে একজন বুড়ো বসে আছে। আসাদ কাছে গিয়ে বল্লো, একটা হলিউড সিগারেট দেন তো। বৃদ্ধ কর্কশ গলায় বল্লো, হলিউড নাই, গোল্ডিপ হইবো। আসাদ হেসে বল্লো, তবে বিদায় বেলায় গোল্ডিপ’ই হোক।

সিগারেটে সবে দু’টান দিয়েছে এমন সময় কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেল আসাদ। একজন ফ্যাকাশে চেহারার লোক বত্রিশ পাটির সবগুলো দাঁত বের করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের আদলটা চেনা বটে কিন্তু সে যেন বিস্মৃত কোন স্বপ্নের মতো। পলাশই প্রথম কথা বল্লো, চিনতে পারলি না তো? আমি পলাশ রে! আসাদ সত্যি সত্যি অবাক হয়েছে। এস.এস.সি পরীক্ষার পর পলাশের বাবা বদলি নিয়ে চলে যাওয়ার পর আর মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। সেও তো বছর সাতেক হল। সত্যিই চিনতে পারিনি রে। চেহারার এ কি অবস্হা করেছিস? মানুষ প্রেমে পড়লেও তো এ অবস্হা হয়না। পলাশ স্বাভাবিক গলায় বল্লো, বহুদিন পর দেখা তোর সাথে। আগে চল কোথাও গিয়ে বসি, তারপর কথা হবে। ধারেকাছে একটা কফিশপে দুকাপ কোল্ড কফি অর্ডার করে দুজনে বসলো। কফিতে চুমুক দিয়ে পলাশ বল্লো, এখনো কবিতা লিখিস? আসাদ চোখ পাকিয়ে বল্লো, ধূর! ধূর কেন? ভাল লিখতিস কিন্তু! জগদীশ স্যারকে নিয়ে লেখা তোর সেই কবিতাটার কথা মনে আছে? দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো। পলাশ হাসি থামিয়ে বল্লো, তোর পূরবীর কথা মনে আছে? আসাদ উপর নিচে মাথা ঝাকিয়ে বল্লো, ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির কথা ভুলে যায় এমন বেরসিক কি এ ভূবনে আছে? পলাশ দুদিকে মাথা নাড়ালো। কিছুটা গম্ভীর গলায় বল্লো, তাহলে ওকে কে যেন লুকিয়ে চিঠি লিখতো সেটাও তো ভুলিসনি? আসাদ চোখ বড় বড় করে বল্লো, সে তো বিরাট ইতিহাস, ভুলি কি করে। সেকি হুলস্হূল কান্ড। কত খোঁজাখুঁজি, কত ধরাধরি; শেষমেষ চোর মহাশয় নায়িকার বাবার হাতে পাকড়াও হলেন। তেলী পাড়ার বিশ্বনাথ! ভাবা যায়? পলাশ রহস্যের হাসি হেসে বল্লো, মজার ব্যাপার হল চিঠিগুলো বিশ্বনাথ লিখতো না, লিখতাম আমি। কথাশুনে আসাদের তো আক্কের গুড়ুম! বলিস কি? তলে তলে তাহলে তুমি এই? ড্রিংকিং আন্ডার ওয়াটার! পলাশ মাথা ঝাকালো। আসল ব্যাপার হল, আমি এখনো তাকে চিঠি লিখি। আসাদ মুখ বাকিয়ে বল্লো, আর বলিসনি; নিতে পারছি না। তা আছে কেমন শ্রীমতি? আছে, স্বামী সংসার নিয়ে ভালই আছে। সামনের এপ্রিলে মেয়ের বয়স একবছর হবে। আসাদ আরো অবাক হয়ে বল্লো, মানে? তুই ওকে তোর পরিচয় দিসনি? পলাশ কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে বল্লো, পরিচয় দিইনি তবে, দেওয়ার কথা ছিল। একদিন আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু.. কিন্তু কি? পলাশ হাসলো। তোকে তো বলা হয়নি, আমার একটা রোগ হয়েছে। ক্রোনিক পেনথিয়াটাইটিস। রোগটা এমনিতেই খারাপ কিন্তু আমার বেলায় আরো বেশি খারাপ। পাকস্হলি কোন খাদ্য নিতে পারেনা, শুধু তরল খেয়ে বেঁচে আছি। এখন তো তাও সহ্য হচ্ছেনা। আমি আর বেশিদিন বেঁচে থাকবো না রে! আসাদ এতক্ষনে বুঝতে পারলো পলাশের চেহারার এই অবস্হা কেন। দুজনেই দুদিকে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর আর আলাপ তেমন জমলো না।

পলাশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসাদ আবার হাটা শুরু করে। পলাশের মতো সুন্দর মনের একজন মানুষ এভাবে দুনিয়া ছেড়ে চরে যাবে, মানা যায়না। আসাদের ভীষন খারাপ লাগার কথা। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারনে তার খারাপ লাগছে না। বরং খানিক আগে সে আত্নহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছির সে কথা মনে করে তার রাগ হচ্ছে। জীবনটা তো মন্দ নয়! তার এমন কোন রোগ নেই যে কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে। পেটে এখনো লোহা পড়লেও হজম হয়ে যায়। মায়ের হাতে চিংড়ি মাছ দিয়ে কঁচু শাক রান্না খাওয়ার জন্যে কবর থেকেও উঠে আসা যায়। ছোট বোনটির কথা মনে পড়লো। ঢাকা থেকে আসাদ বাড়ি গিয়ে যখন তার ব্যাগ খোলে বোনটি বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ব্যাগ থেকে একটি চুলের ক্লিপ বের করেও যদি ওর হাতে দেওয়া যায়, খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। বালিশের নীচে গুজে রাখা কবিতার খাতাটির কথা মনে পড়ে। পারুল নামে একটি মেয়ের কথা মনে পড়ে। তার বড় বড় দুটি চোখ বিশাল পর্দায় যেন সামনে ভেসে আসে। আসাদের কাছে সবকিছু ভাল লাগতে শুরু করে, রেল ক্রসিংয়ে যাওয়া বাদ দিয়ে। তার চেয়ে ফিরে গিয়ে একটি কতিা লিখলে বেশ হয়। কিন্তু তার আগে আরো কিছুদূর হাটা যাক। এই অপরিচীত মানুষের পরিচীত ভীড়ে গন্তব্যহীন হাটতে খুব ভাল লাগছে আজ।
ধিম করে একটা আওলা বাতাস তার বিশাল হাতের দুমুঠো সুখ ঢেলে দেয় আসাদের গায়ে। আসাদের গা বেয়ে সুখ গড়িয়ে পড়ে রুক্ষ কংক্রিটের উপর। কংক্রিটে জীবন এসে বসে। নগরের ক্লান্তি মুছে যায় গা থেকে গড়িয়ে পড়া সুখস্নানে। আসাদের মন জুড়িয়ে যায়। অনেকদিন পর আসাদের মনে হয় সে বেঁচে আছে। জীবনে প্রথমবার সে উপলব্ধি করতে পারে, বেঁচে থাকার মধ্যে একটা আলাদা সুখ আছে।        

০ Likes ১ Comments ০ Share ৩৪১ Views