Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Azimul Haque

৯ বছর আগে

বিষাদময় প্রান্তর

 

সন্ধার কিছুটা আগে দিয়ে দু’টো জেলাশহর সংযোগকারী একটা রাস্তা দিয়ে চলে ঢাকায় ফিরছিলাম । যানের বামপাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাড়ীগুলোর দিকে । কুঁড়েঘর বলতে বাল্যকালে যা বুঝতাম আমরা, যেমন ছনের ঘর, সেরকম ছনের ঘর দেখতে পাওয়া যায়না আজকাল । সহযাত্রীর কাছে জানতে পারলাম, ছনের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে এঁদের আজকাল । বাসাগুলো টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা এবং উপরেও ঐ টিনই । অনেক বাসা চাটাইয়ের, কিছু আবার বাঁশের তরজা দিয়ে ঘেরা । কোথাও বিস্তীর্ন সবুজ মাঠ, মাঠ ছাড়িয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করলে আরো করূন চিত্রের অনেক বাড়ী দেখা যায় । মাঝে মাঝে নারিকেল গাছ, সুপারি গাছের এলোমেলো সমারোহ অথবা সারিবদ্ধ বিন্যাস । চোখ জুড়ানোর কী নেই গ্রামে!

বাড়ীগুলো থেকে সকালে বের হয় নীল ফ্রক আর সাদা পায়জামা পরা কিশোরী আর সাদা হাফ শার্ট পরা কিশোরেরা । দল বেঁধে ওরা স্কুলে যায় । না, এখানে ওদের যাওয়ার জন্য শহরের শিশু-কিশোরদের মতো কোন গাড়ী নেই, সাহায্যকারী হিসেবে ড্রাইভারও নেই যে, ধরে বইশুদ্ধ ব্যাগটা, পানির বোতলটা উঠিয়ে দেবে গাড়ীতে । তবে শহরের শিশু-কিশোরদের মতো নিষ্প্রান  হয়ে চলেনা এরা স্কুলের পথে । শক্ত হাতে বইগুলি ধরে ছোট ছোট দল হয়ে পাখির মতো কিচির-মিচির করতে করতে হেঁটে হেঁটে এরা স্কুলে যায় । বড়ই মধুর এই দৃশ্য ।

এরা একদিন বড় হবে । স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে যাবে, তারপর আরো উচ্চ শিক্ষায় যাবে অনেকে । সবার ভাগ্যে হবেনা অবশ্য উচ্চশিক্ষা । কারন এদের বাবারা, ভাইয়েরা  অতি দরিদ্র, উচ্চশিক্ষা দেওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছা থাকলেও কুলিয়ে উঠতে পারবেনা । এভাবে অন্তরে একরাশ ব্যথা-বেদনা নিয়ে ঝরে পড়বে অনেকে, লেখাপড়া হবেনা ওদের আর, চুকে যাবে সেই পাঠ সারাজীবনের মতো । বন্ধুরা, বান্ধবীরা এগিয়ে যাবে । পারবেনা তারা, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া পারবেনা কিছু করতেও । বিষাদে ভরা এক একটি জীবন হয়ে উঠবে ওদের ।

আর যারা এগিয়ে যাবে, কতটুকু এগিয়ে যেতে পারবে তারা ! শহরের ছেলেরা যেখানে কোচিং সেন্টারের বদৌলতে ভাল রেজাল্ট করে হয়ে যাবে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপক-গবেষক, গ্রামের ওরা কী পারবে হতে তা ? এক-দু’জন ব্যতিক্রমী ছাড়া পারবেনা কেউ । তবে ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই ।

বাড়ীগুলির মতো এর মানুষগুলোও অবহেলিত । কারন এই বাড়ীগুলোর মানুষের টাকা নেই । সুযোগের অভাবে ওরা শিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে । অধিকাংশই ওরা নিম্ন আয়ের মানুষ ।  নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত ভাগকৃত শ্রেণির মানুষ । ছোটখাট ব্যবসা অথবা চাকরী-ই করেন ওরা । গ্রামের বাজারেও করেন, বড়-ছোট অফিস-আদালতেও করেন । ওদের ব্যবহার করেই, কমপক্ষে ওদের ভোট নিয়েই তো নেতারা আসেন সামনে । এসে ওদের ভুলে যান । ভোটের সময় ছাড়া কোনরকম যোগাযোগ তো থাকেইনা, দেখাই পাওয়া যায়না ওনাদের । টেলিভিশনের তাৎক্ষনিক জনমত জরীপের অনুষ্ঠানে, অর্থাৎ তাৎক্ষনিক মতামত গ্রহনের অনূষ্ঠানে সংখ্যাধিক্যতার কারনে এসমস্ত বাড়ীর মানুষেরাই সাক্ষাতকারে এসে পড়েন । এদেরই মতামত প্রতিফলিত হয় জাতীয় মতামতে, তাই এঁদের মতামতই হয়ে ওঠে ‘জাতীয় মতামত’, কান পেতে যে মতামত কেউ শোনেনা । আর তাই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে সময় লাগেনা  একসময়কার প্রচন্ড জনপ্রিয় মানুষগুলোকে । অজানাও নয় এগুলি তাদের কাছে যে, ওদের অবজ্ঞা করলে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয় । তবুও এরকমই হয়, হয়ে আসছে । কারন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না ।

মনে বড় প্রশ্ন জাগে, আর কত ? কতকাল আর থাকবে এরকম ওদের জীবন? কারন সম্পদ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত । আপনি যদি কাউকে না ঠকান, তবে আপনি সম্পদশালী হতে পারবেননা । আপনি টেন্ডারবাজী করে সাধারন ঠিকাদারকে না ঠকালে আপনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবেন কেমনে, আপনি ঘুষ খেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের মান খারাপ করলে আপনি সরকার তথা জনগনকে ঠকাচ্ছেন এবং এজন্য আপনি অঢেল অর্থের মালিক হচ্ছেন, আপনি ঘুষ খেয়ে চাকরীতে নিয়োগ দিচ্ছেন, আপনি ঠকাচ্ছেন এসমস্ত বাড়ীর বেকার অতিদরিদ্র ছেলেমেয়েদেরকে । আপনি অতি-দরিদ্রদের জন্য সরকার যে খাদ্যশস্য, টাকা দিয়ে থাকে, সেটা মেরে খান এবং এভাবে গ্রাম-বাংলার অসহায় গরীব-দুঃখী মানুষকে আরো গরীব-দুঃখী বানিয়ে দেন বলেই না আপনি বড়লোক ।   

এমনকি আমাদের প্রায় সকল বুদ্ধিজীবি মানুষও মনে করেন, এভাবেই চলবে সবকিছু, এটাই ওদের নিয়তি । এভাবেই অন্যায়-অবিচারের মধ্য দিয়েই দেশ চলবে এবং এটাই স্বাভাবিক ।

এভাবে চলতে না দিলে কি হবে প্রিয় পাঠক ?

মহাসড়কের পাশের বিস্তীর্ন প্রান্তরগুলোর দিকে চেয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম বাংলাদেশের বিশাল প্রান্তরে । 
০ Likes ০ Comments ০ Share ৩৩৯ Views

Comments (0)

  • - লুৎফুর রহমান পাশা

    লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক বিপিনচন্দ্র পালের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।