Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন অসীম সাহসী রমণীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈয়ের ১৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি


ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী নেতা এবং ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের অন্যতম পথিকৃত হিসেবে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ।
অন্যায়-অবিচার আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক হিন্দু নারীর অসাধারণ প্রতীক হয়ে আছেন ঐতিহাসিক নারী চরিত্র ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ। সর্বসাধারণের কাছে তিনি ঝাঁসীর রাণী বা ঝাঁসী কি রাণী হিসেবেও ব্যাপকভাবে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন মোটামুটি প্রথম সফল নারী যোদ্ধা। সিনেমার কাহিনীর মতই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এই মহিয়সী নারীর বীরত্বগাঁথা। শাসনকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে লক্ষ্মীবাঈ উপলব্ধি করেন এ দেশে ব্রিটিশদের অন্যায়মূলক ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কঠিন চাপ। প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। একজন অতি সাধারণ মেয়ে মানু থেকে হয়ে ওঠেন রানি লক্ষ্মীবাঈ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি, লড়াই ঘোষণা করেন, নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নেন এবং অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেন তাঁর মতো লড়াইয়ে অংশ নিতে। রাণী লক্ষ্মী বাঈ ভারতীয় তথা হিন্দু মেয়েদের সাহসীকার প্রতীক। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় এই নারী ১৮৫৮ সালের আজকের দিনে শহীদ হন। আজ তাঁর ১৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ঝাঁসীর রাণীর মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


(১৮৫০ সালে রানির ১৫ বছর বয়সে তোলা দূর্লভ ছবি)
লক্ষ্মী বাঈ ১৮৩৫ সালের ১৯ নভেম্বর তার জন্ম বারানসীর কাশীতে মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার প্রকৃত নাম মণি কর্ণিকা এবং ডাক নাম মনু। তাঁর পিতা মরোপান্ত তাম্বে এবং মাতা ভগীরথি বাঈ তাম্বে। বিথুরের পেশোয়া আদালতে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন তার পিতা। সেখানে পরবর্তীতে নিজ কন্যাকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে থাকেন মরুপান্ত তাম্বে। বাড়িতেই তার পড়াশোনা। মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান লক্ষ্মীবাঈ। শৈশবে তার বয়সী মেয়েদের চেয়ে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। বাবা কোর্টের কাজ-কর্মে জড়িত থাকায় রাণী লক্ষ্মী বাঈ ঐ সময়ের অধিকাংশ নারীদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিলেন। আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া চালনা, আর্চারী শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি তার বান্ধবীদেরকে নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।


১৮৪২ সালে ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও নিওয়াকরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মণি কর্ণিকা। বিয়ের পরই তাঁর নতুন নামকরণ হয় লক্ষ্মী বাঈ এবং ঝাঁসীর রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮৫১ সালে তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়। নাম রাখা হয় দামোদর রাও। কিন্তু চার মাস পর ছেলেটি মারা যায়। পুত্রশোক ভুলতে রাজা-রানী উভয়ই আত্মীয়র ছেলেকে দত্তক নেন। ১৮৫৩ সালে গঙ্গাধর রাও মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর কম বয়সেই তাকে ঝাঁসির রাজত্বভার গ্রহণ করতে হয়। ক্টিন্তু আত্মীয়র ছেলেকে দত্তক নেয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির দখলস্বত্ব বিলোপনীতির কারণে তার সিংহাসনারোহণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ডালহৌসি জানান, ঝাঁসির সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নেই এবং ঝাঁসিকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীনে নেয়া হবে। ১৮৫৪ সালে রানীর নামে বার্ষিক ৬০ হাজার ভারতীয় রূপি ভাতা মঞ্জুর করা হয় এবং তাকে ঝাঁসির কেল্লা পরিত্যাগ করতে হুকুম জারি করা হয়। লক্ষ্মী বলেছিলেন, ‘আমি দিব না! আমি আমার ঝাঁসি ছেড়ে দিব না! কেউ আমার ঝাঁসি কেড়ে নিতে পারবে না; যার সাহস আছে সে চেষ্টা করতে পারে!’ ঝাঁসির দুঃসাহসী রানী এ আহ্বানের মাধ্যমেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। তার পর ইংরেজদের বিতাড়িত করে ঝাঁসির রানী শুরু করেছিলেন তার রাজ্য শাসন।


সাধারণত তিনটের সময় পুরুষের পোশাকে তিনি দরবারে যেতেন। গাঢ় নীল রঙের জামা, পায়জামা ও মাথায় একটি সুন্দর পাগড়িসদৃশ টুপি পরতেন। কোমরে জড়িয়ে রাখতেন একটি নকশা করা দোপাট্টা, যার পাশে থাকত মূল্যবান রত্নখচিত তলোয়ার। এই বেশভূষায় তাকে গৌরীর মতো দেখাত। মাঝে মাঝে তিনি নারীর পোশাকও পরতেন। তার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আর কখনো নথ অথবা সেরকম কোনো অলংকার পরেন নি। তার হাতে থাকতো হীরার বালা, গলায় মুক্তার ছোট মালা এবং কনিষ্ঠ আঙুলে একটি হীরার আংটি। তার চুলগুলো পিছনে বাঁধা থাকতো। সাদা অন্তর্বাসের সাথে তিনি একটি সাদা শাড়ি পরতেন। এভাবেই তিনি কখনও পুরুষবেশে, কখনও নারীবেশে দরবারে উপস্থিত হতেন। দরবারে সমবেত ব্যক্তিরা কখনই তার সাক্ষাৎ পেত না। কেননা তার বসার কক্ষটি ছিল আলাদা এবং এটি দিয়ে শুধু দরবারের সভাকক্ষেই প্রবেশ করা যেত। স্বর্ণালঙ্কিত দরজাগুলো সুতি ছিট কাপড়ের সোনালি পর্দায় ঢাকা থাকতো। প্রখর বুদ্ধিমতী রানী তার সামনে আনা যে কোনো বিষয় খুব দ্রুত উপলব্ধি করতে পারতেন এবং তার আদেশগুলো হতো স্বচ্ছ, নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত। মাঝে মাঝে তিনি নিজেই আইন প্রণয়ন করতেন। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন এবং অধিকার ও অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে যোগ্যতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।


১৮৫৭ সালের ১০ মে মিরাটে ব্রিটিশদর বিরুদ্ধে ভারতীয় বিদ্রোহের সূচনা হয়। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, লি ইনফিল্ড রাইফেলেরআচ্ছাদনে শুকরের মাংস এবং গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়। এরপরও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী রাইফেলে শুকরের মাংস এবং গরুর চর্বির ব্যবহার অব্যাহত রাখে। তারা বিবৃতি দেয় যে, যারা উক্ত রাইফেল ব্যবহারে অসম্মতি জানাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এবং আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও শুরু করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। এই বিদ্রোহে সিপাহীরা অনেক ব্রিটিশ সৈন্যসহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে নিযুক্ত কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করে। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব চূড়ান্ত আকার ধারণ করলে সমগ্র ভারতবর্ষে প্রবল গণ-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। রানীও তাতে অংশ নেন। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের সময়েও তাঁর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে ঝাঁসীর পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সেই সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা লর্ড স্ট্রাথনায়র্নের নেতৃত্বে ঝাঁসীর কাছেই ঘাঁটি গেড়ে বসে। অবশেষে ১৮৫৮ সালের ২৩শে মার্চে ঝাঁসী অবরোধ করে ফেলে ব্রিটিশরা। লক্ষ্মী বাঈ কাপুরুষের মত চুপ করে এই ভাবে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার মত মানুষ ছিলেন না। তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ইংরেজদের সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁকে সহায়তা করতে বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাতিয়া তোপে নামক আরেক বিদ্রোহী এগিয়ে আসেন। খুব অবাক করা বিষয় হল ইংরেজ সৈন্যসংখ্যা ছিল এই তুলনায় খুব কম, মাত্র পনেরশ। কিন্তু সৈন্য কম হলে হবে কী, ওরা ছিল অনেক বেশি দক্ষ আর উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সেই তুলনায় অনেক বেশি অনভিজ্ঞ সৈনিকদল নিয়ে তাতিয়া তোপে সুবিধা করতে পারে নি। কম সৈন্য নিয়েও তাই ৩১শে মার্চ অবস্থা পুরোপুরি ইংরেজদের আয়ত্ত্বে চলে যায় এবং তারা ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের তিন দিন পর ঝাঁসীর দুর্গের দেয়ালে ফাটল ধরে এবং ব্রিটিশরা অনায়াসেই পুরো শহরের দখল নিয়ে নেয়।


আগেই বিপদের আঁচ করেছিলেন লক্ষ্মী বাঈ। এই চরম মুহূর্তে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অন্যত্র মনোযোগের চেষ্টা চালায়। তাদের অমনযোগের সুযোগে সন্তানকে বুকে নিয়ে রাতের আঁধারে দুর্গের দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে পালান রাণী লক্ষ্মী বাঈ। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে লক্ষ্মী বাঈয়ের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণে নিরাপদে তাঁর সৈন্যরা ঝাঁসী ত্যাগ করতে পেরেছিল। এ সময় তাঁর নিরাপত্তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েদের একটি দল তাঁকে পরম মমতায় ঘিরে রেখেছিল। এরপর রাণী আনন্দ রাওকে সাথে নিয়ে তার বাহিনী সহযোগে বাণিজ্যিক বিনিয়োগের উর্বর ক্ষেত্র কাল্পীতে যান। ব্যবসা-বাণিজ্যে এই শহরটি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। সেখানে তিনি তাতিয়া তোপেসহ অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেন। রাণী এবং তাতিয়া তোপে গোয়ালিয়রের দিকে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে তাদের যৌথবাহিনী গোয়ালিয়রের মহারাজার বাহিনীকে পরাজিত করে। পরাজিত এই সৈন্যরা পরে রাণী ও তাতিয়ার যৌথবাহিনীতে যোগ দেয়। এই বাহিনীতে অন্যতম নেতৃত্বপ্রদানকারী হিসেবে লক্ষ্মী বাঈ গোয়ালিয়রের কেল্লা দখল করে নেন।


(ভারতের ঝাঁসী/গোয়ালিয়রে স্থাপিত ব্রোঞ্জ নির্মিত লক্ষ্মী বাঈএর ভাস্কর্য)
১৮৫৮ সালের ১৭ই জুন ভারতের গোয়ালিয়রের ফুলবাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে নামক জায়গায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে বীরবিক্রমে লড়াই করে নিহত হন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈ। তার মৃত্যুর তিনদিন পর ব্রিটিশরা গোয়ালিয়র দখল করে।মৃত্যুর পরে রানী লক্ষ্মী বাঈ ভারতবর্ষের 'জাতীয় বীরাঙ্গনা' হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান। তাঁকে ভারতীয় রমণীদের সাহসের প্রতীক ও প্রতিকল্প হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে, ২০১১ সালের ২১ জুলাই লক্ষ্মী বাঈকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ডানপিটে রমণীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা তাদের স্বামীদের কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তালিকায় ঝাঁসীর রাণীর অবস্থান ছিল ৮ম। ( ডানপিটে শব্দটিকে নেগেটিভ অর্থে নয় বরং গুনবাচক বিশেষণে ব্যবহ্রত হয়েছে। ডানপিটে শব্দের আভিধানিক অর্থ বিণঃ অসমসাহসী, দূর্দান্ত (সংসদ বাঙ্গালা অভিধান ২৮৮ পৃষ্ঠা দৃষ্টব্য) টাইম ম্যাগাজিনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। আজ এই মহীয়সী নারীর ১৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ঝাঁসীর রাণীর মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
০ Likes ১ Comments ০ Share ৯৮৩ Views

Comments (1)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    বেশ কিছু দিন পর কবিতা পড়লাম

    খুব ভাল লাগল

    ভাল থাকুন

    • - পিয়ালী দত্ত

      অসংখ্য ধন্যবাদ...

    - সুমন সাহা

    খুব ভালো লাগলো লেখা।

    বেশ আবেশ আছে কথাগুলোতে।

    শুভেচ্ছা জানবেন।

    • - পিয়ালী দত্ত

      অসংখ্য ধন্যবাদ...