Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

সেলিনা ইসলাম

৮ বছর আগে

বিমোহিত সরোবরে (সৃজনশীল-ব্লগিং-প্রতিযোগিতা-২০১৬-৪র্থ পর্বঃ-ক্যাটাগরী-২)



জানালার কাছে বসে চাঁদের সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। আসলে ঠিক যেন কথা না! অনেক দিনের জমানো ব্যথার যে আলোড়ন মনে আজ। ঐ আকাশ আর চাঁদই যেন জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছুর একমাত্র সাক্ষী। মৌ এই জানালায় কত রাত জেগে জেগে কাটিয়েছে! কত কথা বলেছে আনমনে ঐ দূরের পাণে চেয়ে। কত হিসাব নিকাশ আর পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণায় কাটিয়েছে,এক একটা নিঃসঙ্গ দীর্ঘ রাত। যদি আগে একটু কঠিনভাবে ভাবতে পারত সবকিছু? তাহলে কী আজ দুঃখ ভুলাতে মধ্যরাতে গুনগুন করে তাকে গান গেয়ে,মনের তৃষ্ণা মেটাতে হত!? খুব ইচ্ছে জাগে...। ইচ্ছে জাগে জানালা খুলে বাতাসে নাম না জানা,কোন ফুলের সুবাসে নিঃশ্বাস নিতে। পরমুহুর্তেই মনে হয়-এখানকার সবকিছুতে যেমন একটা সুখ সুখ ভাব আছে কিন্তু সুখ নেই। ঠিক তেমনি ফুলের সৌন্দর্য আছে কিন্তু কোন সুগন্ধ নেই! মায়াভরা সবার মনে কিন্তু আদৌতে তার ছিটেফোঁটাও মনের গহীনে আছে কিনা সন্দেহ! কেমন আদর করে করে জন্তুগুলোকে আগলে রাখছে বুকে! অথচ সন্তানরা একটু বুঝতে শিখলেই হয়ে পড়ছে ঘরছাড়া! মৌ'য়ের কাছে সবকিছুই কেমন যেন মেকি মনে হয়।

-"নাহ এত ঠাণ্ডা পড়েছে আজ!"মৌ কথাটা বলেই মুখ বাড়িয়ে জানালার কাঁচে মাথা রাখে। চোখ মেলে দেখে চারিদিকে সাদা পেঁজা পেঁজা মেঘের মত স্নো ভাসছে। কতদিন স্নো ধরে দেখেনি সে! বুক চীরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। আজ কোনভাবেই মন বসাতে পারছে না তার মনের রাজ্যে। পাশের ঘর থেকে টুং টাং গ্লাসের শব্দ আর হাসির সাথে,ইংরেজি গানের সূর ভীষণভাবে মনে জ্বালা ধরাচ্ছে। কানে হাত দিয়েও নিজেকে এসব কিছু শোনা থেকে বিরত রাখতে পারছে না। রাগে গলা ছেড়ে যত জোরে সম্ভব সে এবার গান গায়তে চেষ্টা করল। কিন্তু তা কেবল চিৎকারই মনে হল। রেকর্ড করা গানের সিডিটা হাতে কিন্তু বাজাতে পারছে না। ভীষণ অস্থির লাগছে আজ তার। মনে পড়ে মায়ের বলা কথা-"শোন মা,গাড়ী যখন ভাঙা রাস্তায় আটকে যায়? তহন পিছন দিক থাইকে,খালি একটু ধাক্কা দিতি হয়। তালিপরে গাড়ি আবার চলতি শুরু করে! কোন সময় ধাক্কাটা এট্টু আস্তে,আবার কোন সময় এট্টু জোরে দিতি হয়। ধাক্কা না দিলি গাড়ী আর আগে যায় না! তহন হয় চালকের কষ্ট। নিজে ধীরে ধীরে টাইনে টাইনে সামনে নিতি গেলি দেখা যাবে, নিজেই ক্লান্ত হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর গাড়ীখানা জং ধরে একই জায়গায় পড়ে আছে। "

-তাহলে কী এখন একটা ধাক্কার প্রয়োজন!? চেষ্টা করতে তো কোন দোষ নেই! সে এখনো বেঁচে আছে...

মৌ নানা কথা ভাবতে ভাবতে শুনতে পায়,পিছনে পাশের ঘরের দরজা খোলার শব্দ-

-মা তুমি এভাবে চিৎকার কেন করছ? আমার বন্ধুদের কাছে কেন আমাকে এভাবে এম্ব্রেসিং করছ?

-তোকে আমি লজ্জায় ফেলছি,না তুই আমাকে?

তমাল মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে- লিসেন মা,আজকে আমার জন্য একটা গর্বের দিন। আজকে একুশে ফেব্রুয়ারী, ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে। একজন বাঙালি হিসাবে এটা আমার জন্য অনেক গর্বের। বিদেশি বন্ধুরা এই দিনটি সেলিব্রেট করে আমাদেরকে,মানে বাঙালিদেরকে খুশি করতে চায়ছে। আর তুমি...!?

মৌ ছেলের দিকে ঘুরে তাকায়...বুকটা ভেঙে কষ্টরা সব বিদ্রোহ করতে চায়। নিজেকে অনেক কষ্টে সংবরণ করে। ধীরে ধীরে বলে-

-বাংলা ভাষা নিয়ে তুই কেন গর্ব করবি? তুই তো আর বাঙালি নেই। ইংরেজি বলছিস,আজকের দিনে শ্যাম্পেন খেয়ে ইংরেজি গান শুনে পার্টি করছিস। এতে তোর গর্বের কিছু নেই তমাল।

-মা প্লিজ আমাকে আমার মত এই দিনটিকে সেলিব্রেট করতে দাও...প্লিজ...!

একটু থেমে আবার বলে- আমাকে তোমার যা বলার তা ওরা চলে গেলে বল।  

মৌ কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় একজন বিদেশি বন্ধু আসে ওখানে। বলে -

- টম এনি প্রব্লেম?

-নো নো… ডোন্ট ওয়ারী এভ্রিথিং ইজ ফাইন ম্যান...!

কথাটা বলে তমাল এক রকম ঠেলেই বন্ধুকে নিয়ে ভীতরে চলে যায়। মৌ চিৎকার দিয়ে বলে উঠে-  

-নাহ...কিছুই ঠিক নাই...! আমাকে মিনারে নিয়ে যা। আমি মিনারে ফুল দিয়ে একফোঁটা পানি ঝরিয়ে প্রায়শ্চিত্তের আগুন নেভাব। আমাকে নিয়ে যা তমাল...

"প্রায়শ্চিত্তের আগুন"কথাটায় যেন তমাল কিছুটা থমকে গেল। মৌ আবার আকাশের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করতে করতে স্মৃতির সাগরে সাঁতার কেটে কেটে ভাবনার অতলে ডুবে যায়। মনে পড়ে তমালের বাবা আদর করে ওর নাম রেখেছিল তমাল। অথচ মাত্র এই কয়েকদিন আগে থেকে,সেই তমাল এখন বন্ধুদের কাছে তম থেকে টম হয়ে গেছে! "নাকি অনেক আগেই হয়েছে? হয়ত সে ঠিক খেয়াল করে শোনেনি কখনো। হবে হয়ত..." তমালের কয়েকজন বাঙালি বন্ধুও আছে! মৌয়ের মনে হয় "ওদের বাবা মায়ের কী ওর মতই মনের অবস্থা?" কথাটা ভাবতেই মনের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

মনে পড়ে তমালের ছোট বেলায় ওর বাবা কাজ থেকে এসে যত ক্লান্তই থাকুক না কেন? ওকে নিয়ে ফুল দিতে ছুটে যেত প্রবাসীদের করা অস্থায়ী শহিদ মিনারে। শত তুষার ঝড়,হিম ঠাণ্ডাও দমাতে পারেনি কোন বাঙালিকে! দমাতে পারেনি একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে। সেই সময়ে তমালের বাবার আসার আগে যদি ফুলের দোকান বন্ধ হয়ে যায়? এই ভয়ে তমাল মাকে নিয়ে বিকালেই ঠাণ্ডার মধ্যে বের হয়ে কিনে নিয়ে আসত নিজের পছন্দনীয় ফুল। বাসায় এসে সেই সন্ধ্যা থেকে প্র্যাকটিস করত টেলিভিশনের কেউ যদি কোন প্রশ্ন করে ওকে? তাহলে সে কী বলবে তাই নিয়ে। ওকে একবার একটা টিভি চ্যানেল থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল-

- আচ্ছা বাবু আজকে কী যে,তুমি আজকের দিনে ফুল দিতে এসেছো?

সেদিন একেবারে শুদ্ধ বাংলায় মায়ের কাছ থেকে শিখে নেয়া কথাগুলো বলেছিল-

-আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি তাই শহিদদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দিতে এসেছি!

প্রশ্নদাতা অনেক খুশি হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন-

- আচ্ছা বেশ ভাল বলেছ। তো বাবু তুমি কী জানো কেন আজ এই দিনটিতে শহিদদেরকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান হয়?

সেদিন তমাল কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। খুব আমতা আমতা করে বলেছিল

-এই দিনেই তো আমাদের মায়ের ভাষার জন্য রফিক,সালাম,বরকত রক্ত দিয়েছিল। আর আর...!

আর কিছু মনে করতে পারছিল না বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিল সে। কিন্তু চ্যানেলের ছেলেটা বুদ্ধি করে বলল-

- বাবু তুমি তো অনেক কিছু জানো দেখছি...তো আজ তো আব্বু আম্মুর সাথে এসেছ। বড় হয়ে কি একা একা আসবে?

সেদিন তমাল কিছুই বলেনি। কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে "হ্যাঁ" বলেছিল। আর ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল! তারপর থেকে যতবার মিনারে যাবার প্রস্তুতি নিয়েছে? ততবার ওর মাঝে ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে জানার আগ্রহ বেড়েছে অনেক।

তারপর...! তারপর প্রকৃতির নিয়মেই জীবন কেটেছে...। তমালও ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেছে। আশ্চর্য...! ও এখন আর মিনারে যায় না। পড়াশুনা শেষে ভাল একটা চাকুরী করে...। এই বিদেশের মাটিতে বাবা মা হিসেবে যতটা করা সম্ভব, যতটা সুযোগ আছে ততটাই ওরা চেষ্টা করে গেছে। বাংলা স্কুলে নেয়া,বাংলা শেখানো সবই করেছে। কিন্তু তমালের বাংলা চর্চাটা ঠিক যেভাবে করা দরকার ছিল,সেভাবে করা হয়নি। সারাদিন ইংরেজি বলে বলে ও একরকম  অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর তাই স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরোতে একটা সময় এসে বাংলা লিখতে এবং পড়তে গেছে ভুলে! কিন্তু ও বাংলা বলতে পারে...। খুব সুন্দর করে বাংলা ভাষাও বোঝে...। হয়ত মৌ এখনো ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না বলে। আসলে সে ভাল করে ইংরেজি বলতে পারে না...। শেখার অনেক সুযোগ ছিল কিন্তু ইচ্ছে হয়নি কখনো। তমাল আসলে বাধ্য হয়ে মায়ের সাথে বাংলা কথা বলে।

এখন ও ওর মাতৃভাষা দিবস নিয়ে গর্ব করে যে উৎসব পালন করছে? তা ওর বাবাকে দেখে যেতে হয়নি। ছেলে যেন মায়ের ভাষাটাকে সম্মান দিতে ভুলে না যায়। এই ভাষার জন্য যারা নিজেকে উৎসর্গিত করেছে,বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতিকে গর্বিত জাতি হিসাবে স্থান করে দিয়েছে। পিতা হিসাবে সে সব সময় চেয়েছে সন্তান যেন ভিন্ন পরিবেশে,ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতেও কোনদিন তা ভুলে না যায়। আর তাই তো হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেঁটে এসেও,সন্তানকে নিয়ে ছুটে গেছে। ছুটে গেছে প্রবাসে স্বদেশীদের সংস্পর্শে গড়ে তোলা একখণ্ড বাংলার পদতলে। যখন সারি সারি বাঙালিদের মাঝে সন্তানের হাত ধরে সবাই,সমস্বরে লাল সবুজের পতাকা তলে দাঁড়িয়েছিল! যখন প্রাণের বর্ণমালায় ঘেরা মিনারে মাথা উঁচু করে এক সূরে সূর মিলিয়েছিল "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কী ভুলিতে পারি..." হাজার মাইল দূর থেকেও যেন সবাই তখন,সোঁদা মাটির স্পর্শে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। গর্বভরা মাতৃভূমির মায়ায় প্রতিটা বাঙালিই ভিজে গিয়েছিল। সবার হৃদয়ের পরতে পরতে হয়েছিল তখন,অসীম রক্তক্ষরণ।

কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে সেই স্পর্শ থেকে মৌ বঞ্চিত। অসুস্থতার কারণে সে চাইলেও এখন মিনারের কাছে গিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধরাতে পারে না! তবুও সে এতোগুলো বছর ফুল দিয়েছে...! দেশ থেকে আনা লাল সবুজ পতাকা মাঝে শহিদদের স্মরণ করে সে ফুল দিয়েছে...! দোয়া পড়েও দিয়েছে...। তমালের বাবা এইদিনে আরও একটা কাজ করত! শহিদদের স্মরণে দেশে টাকা পাঠিয়ে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে বলত। এ সবকিছুই সে অনেক আনন্দ নিয়েই করে গেছে।

অথচ আজ...! আজ দীর্ঘ বছর পরে মৌ জানে না কীসের ভুলে? সেই একী দিনে চার দেয়ালের মাঝে সে বন্দি থাকে? কেন সেই গর্বিত সন্তান আজ মাতৃভাষায় শহিদদের শ্রদ্ধা জানাবার গুরুত্ব হারায়! কেন বন্ধুদের সাথে শ্যাম্পেনের স্বাদে মনে নেশা ধরিয়ে,এই দিবসটিকে সেলিব্রেট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। মৌ কোনদিন এইদিনটি দেখতে চায়নি...

মনের মাঝে চিনচিন করে ব্যথা করে...। সে জানে না এর শেষ কোথায় বা আদৌ শেষ হবে কিনা। ওর কাছে এই বরফ ঘেরা রাত,জ্যোৎস্না ঝরা আকাশ,সবকিছুই মিথ্যে মনে হয়...। মনের কোণে ভেসে উঠে মেঠো পথ আর সবুজ ঘেরা এক টুকরো ভূমি! যেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একটি শহিদ স্মৃতি স্তম্ভ...। যেখানে বাবার হাত ধরে মৌ ফুল দিয়েছে। যে মাটিতে দাঁড়িয়ে সবার সাথে নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে অন্যরকম একটা শক্তি সারা জীবন পেয়ে গেছে। আর সে শক্তি হচ্ছে মাকে ভালবাসার,জন্মভূমিকে ভালবাসার। যে শক্তি মনে উদ্দীপনা জাগায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষায়!

এভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে মৌয়ের মনে হয় যেন তমালের বাবা ঠিক ওর পাশে। ক্লান্ত সূরে সে যেন বলছে-"মৌ ছেলেটাকে হাত ধরে আরেকটু পথ চল...ও পথ ভুলে গেছে। তুমি ওকে পথ দেখাও!" মৌয়ের দুচোখে টপটপ করে পানি ঝরে ।

-নাহ এভাবে ভেঙ্গে পড়া চলবে না! আরও শক্ত হতে হবে। বেঁচে থাকতে এভাবে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাওয়া চলবে  না...!

হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে সোজা ঢুকে যায় পাশের রুমে। রিমোট কন্ট্রোলটা নিয়ে মিউজিক বন্ধ করে দিতেই,ঘরের সবাই থমকে যায়। মৌ কারো দিকে না তাকিয়ে হাতের সিডিটা যথাস্থানে রাখে। রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে প্লে দিতেই...সূরের মূর্ছনায় ঘরের চারিদিক আন্দোলিত হয়। মৌ নিজের সিনাটাকে সামনে এগিয়ে,মাথা উঁচু করে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠে-"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কী ভুলিতে পারি...ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি,আমি কী ভুলিতে পারি..." তমালের চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠে বাবার হাত ধরে মিনারে যাওয়ার সব স্মৃতি! ওর যে কী হয়! সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়  মায়ের পাশে। বুকের ভেতরটা কেউ যেন শক্ত কিছু দিয়ে প্রচণ্ডভাবে বাড়ী মারছে। কিছু একটা দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে আসে। চোখ ভরে পানি পড়তে চায়। সে বুঝতে পারে বড় ভুল হয়ে গেছে তার। বন্ধুদেরকে সে আজকের দিনের করণীয় কর্তব্য কী? তা বললে নিশ্চয় ওরা আনন্দিত হয়ে নিজেরাও দিনটির গুরুত্ব জেনে নিত? যার যেতে ইচ্ছে হত না,হয়ত সেও সবার সাথে যেতে বাধ্য হত!

তমালের মনে পড়ে কোথায় যেন পড়েছিল! আজকে সে যে "ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে" সেলিব্রেট করছে? তার  মূল উদ্যোক্তা রফিক এবং সালাম নামে দুজন কানাডা নিবাসী। যাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের মাতৃভাষা দিবসের দিনটিই আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে নির্ধারিত করা হয়েছে। দেশ ও জাতিকে  সাহসী জাতি হিসাবে পরিচয় দিয়ে,দুজন প্রবাসীই বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে! অথচ সেও কিনা একজন প্রবাসী বাঙালি হয়ে আজ...আর  ভাবতে পারে না! সে ভুল করেছে,অনেক বড় ভুল!   


একে একে সবাই হাত থেকে গ্লাস নামিয়ে রাখে। তমালের দেখাদেখি টেবিলে রাখা ফুলদানি থেকে ফুলগুলো একটা একটা করে সবাই হাতে তুলে নেয়। তারপর সবাই ঘিরে ধরে মাকে। ফুলগুলো রাখে মায়ের কোলের উপর রাখা পতাকা মাঝে
...! "মনে রেখ বাবা...জীবনের একটা ভুল সিদ্ধান্ত তোমাকে শেষ করে দিতে পারে! আবার তোমার একটা সঠিক সিদ্ধান্ত তোমাকে নিয়ে যেতে পারে স্বর্গীয় চুড়ায়!" বাবার বলা কথা ভেবে তমালের হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি খেলে যায়...! আজকে মাকে শহিদ মিনারে নিয়ে যায়নি বলে সে মনে মনে আফসোস করে। প্রতিজ্ঞা করে মা যতদিন বেঁচে থাকবে,সে এই ভুল আর কোনদিন করবে না। "চেহারা নয়,এই ভাষাই আমাকে বাঙালি জাতি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেবে!"সে অনুভব করে এভাবে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে টিকে থাকা যায় না! সে উপলব্ধি করে ট্র্যাডিশন,কালচার এ সবকিছুই তার শিকড়কে পরিচয় করিয়ে দেবে। সে যদি তার শিকড়কে সম্মান না দেয় তাহলে অন্য কেউ দিবে না। এভাবে সে নিজের শিকড়ে পচন ধরাতে দেবে না...। এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে মায়ের হাত ধরে...মায়ের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলায়।
মৌ শুনতে পায় একে একে ঘরের সবাই বাঁধো বাঁধো সূরে গেয়ে যায়
-"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কী ভুলিতে পারি..." ওর মনে হয় একঝাঁক পায়রা এই মাত্র সারা ঘরে এসে ঠায় নিয়েছে...! ও বুঝতে পারছে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ ওর চারপাশটা ঘিরে ধরেছে...

 

                                                                        !! শেষ !!










০ Likes ২ Comments ০ Share ৩১৩ Views