Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহসান কবির

৯ বছর আগে

বাংলাদেশকে ভালোবাসি তাই গোলামদের ঘৃণা করি

দোযখের প্রবেশদ্বারে কর্মরত প্রহরী অবাক হলেন। বিস্ময়ের ভাব লুকোতে না পেরে প্রহরী দৌড়ে গেলেন তার কর্তার কাছে। বললেন এক জীবনে এমন মানুষ দেখি নাই! তাকে এখন কোথায় রাখবো? কর্তা বললেন, খুলে বলো। প্রহরী বললেন, গো আযম নামের এক লোক এসেছে । হাতে তার বাংলাদেশের পাসপোর্ট । লোকটির হৃদয়ে ঢুকে দেখলাম সেখানে লেখা ‘হৃদয়ে পাকিস্তান‘!  

পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের গোলাম আযমের জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর, তার নানাবাড়িতে। পূর্বপুরুষের আবাস ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বীরগাঁওয়ে। কানা ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন হতে পারে তেমনি বীরগাঁওয়ের কোনও কাপুরুষ জন্মাতে পারে লক্ষ্মীবাজারের অলক্ষ্মী হয়ে! আজীবন গোলাম আযম কাপুরোষোচিত এবং মানবতা ও বাংলাদেশবিরোধী কাজই করে গেছেন। তার এই ন্যাক্কারজনক ও নিকৃষ্ট কাজ তিনি করেছেন কথিত ধর্মীয় মোড়কে! বাংলাদেশ যখন জন্ম নিচ্ছিল, কোটি মানুষের স্বপ্ন যখন যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্রের মুখে, লাখো শহীদের রক্ত আর মা বোনের সম্ভ্রম যখন স্বাধীনতার স্লোগান, তখন এই নরাধম গোলাম আযম ছিলেন বাংলাদেশবিরোধী, পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর দোসর! গো. আযমের মরণকালে তার কিছু বয়ান তুলে ধরা যাক, মানুষ যেন তাকে শুইয়ে রাখে ঘৃণার যাদুঘরের নিকৃষ্ট থুথুখানায়!  

১. গোলাম আযম পড়তেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। রাজাকার কূল শিরোমণি শাহ আজিজ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেখানে পড়তেন, একদা তারা তিনজন বেকার হোস্টেলে থাকতেন। (প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানের বইতে এই তথ্য আছে) পরে পুরনো ঢাকার তৎকালীন ঢাকা ইসলামিক কলেজ (বর্তমানে নজরুল কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে গোলাম আযম ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজ ও ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রথমে তাবলীগের প্রতি তার খানিকটা ভালোবাসা জন্মেছিল! এই ভালোবাসাটা প্রকট হলেও বেঁচে যেতেন গোলাম আযম ।   যাই হোক, ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি মনোনীত হয়েছিলেন, ভিপি হয়েছিলেন অরবিন্দ বোস। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান এলে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৪৮ এর ২৭ নভেম্বর লিয়াকত আলী খানকে স্বাগত জানিয়ে এক অনুষ্ঠানের আযোজন করা হয় যেখানে মানপত্র পাঠ করার কথা ছিল ভিপি অরবিন্দ বোসের। মাত্র পনের ষোল মাস আগে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া দুই দেশের সাম্প্রদায়িক উসকানি কিংবা ক্ষত তখনও শুকায়নি। তাই মুসলিম লিগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে মানপত্র পাঠ করবেন একজন হিন্দু এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। তাই এই সুযোগটা পেয়ে যান সিলেক্টেড ডাকসু জি এস গোলাম আযম। ওই মানপত্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার অনুরোধ ছিল। এ প্রসঙ্গে একটু পরে ফিরে আসছি।  

২. ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাস করে বেরিয়ে যাবার আগেই মাওলানা আবুল আলা মওদুদির (অনেকের কাছে এই ভদ্রলোক ইসলামের দুশমন হিসেবে পরিচিত) ভক্ত হতে শুরু করেন গোলাম আযম । পাস করে বেরিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬-৫৭ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন এমন তথ্য মেলে তার লেখা বই থেকে। ততদিনে মওদুদি তাকে পরোপুরি আছর করে ফেলেছে। কলেজের চাকরি ছেড়ে (তিনি ছিলেন লেকচারার। আজীবন নিজের নামের আগে লিখেছেন অধ্যাপক!) পুরোপুরি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে নেমে পড়েন গোলাম আযম ।   আসলে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত দুই সহোদর। কিছুদিন পরে সংগঠনটি তাদের কাছ থেকে একরকম ছিনতাই করেন আবুল আলা মওদুদি। মওদুদির জামায়াতে ইসলাম ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে থাকে। মুসলিম লীগের হয়ে পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনা কায়েদে আযম মো.আলী জিন্নাহ পাকিস্তানকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতির সবচেয়ে সংক্রামক রোগ সামরিক শাসনের হাত ধরে পাকিস্তান হয়ে যায় ইসলামী রাষ্ট্র।   মওদুদির জামায়াতে ইসলাম এটাকে তাদের বিজয় বলে প্রচার করে। এরপর ১৯৫৩ সালে স্বাধীন পাকিস্তানে কাদিয়ানীরা কাফের ঘোষণা দিয়ে জামায়াত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায় এবং জামায়াত নিষিদ্ধ ও মওদুদীর ফাঁসির হুকুম হয় যদিও পরবর্তীকালে তা রদ করা হয়েছিল।  
৩. ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর তখন গোলাম আযম ছিলেন মানুষের স্বপ্ন ও বাংলাদেশের বিপক্ষে! তিনি তখন পূর্ব বাংলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের শুক্কুরে আঞ্জুমানে ইয়ারানের পক্ষ থেকে এক সম্বর্ধনা দেওয়া হয় গো. আযমকে। সেখানে তিনি বলেন, বাংলা ভাষা আন্দোলন ভুল হইয়াছিল! সেখানে তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এতো বড় রাজনৈতিক ভুল আর হবে না বলেও তিনিও প্রতিশ্রুতি দেন!  

৪. ৭১ সালেও তিনি তার ভুল না করার প্রতিশ্রুতি রেখে মানুষের স্বপ্নের বিপরীতে যেয়ে নৃশংস কাজ করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন তার কাছে ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন দুষ্কৃতিকারী ও ভারতের অনুচর (৭১ সালে তার এমন হাজারো বিবৃতি পাওয়া যাবে)।   পঁচিশে মার্চের কালো রাতের পর পূর্ব পাকিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন এই গোলাম আযম। রাজাকার, আল বদর, শান্তি কমিটি আর আল শামস গঠন করে পাকিস্তানি হানাদারদের সর্বময় সহযোগিতা করার কারণে তার দলকে পুরস্কৃত করেছিল পাকিস্তানিরা। তার দল থেকে দুজনকে (এই মন্ত্রিসভা ঠ্যাটা মালেক মন্ত্রিসভা হিসেবে পরিচিত। দুজনের একজন ছিলেন জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির আব্বাস আলী, যিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন) মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল! তবে গো. আযমকে কেন প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি সেটা নিয়ে দলগতভাবে উষ্মা প্রকাশ করেছিল জামায়াতে ইসলামী! লাখো শহীদের মৃত্যু, হত্যা, লুটপাট আর সম্ভ্রমহানির মাস্টারমাইন্ডদের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান।   তবে আল বদর,আল শামস,রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি দিয়েও পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে পারেননি গোলাম আযম ও তার পাকিস্তানি প্রভুরা। শেষ রক্ষা হবে না বুঝতে পেরে একাত্তর সালের ২২ নভেম্বর গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গোলাম আযমসহ আটত্রিশ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।  

৫. গোলাম আযম ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে বসে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠন পয়দা করে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের দাবি তোলেন এবং রিয়াদে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব সম্মেলনে যেয়েও এই দাবির প্রতিধ্বনি তোলেন। ওআইসির সম্মেলনে যেয়েও গোলাম আযম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে অনুরোধ জানান। ৭৩ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত সৌদি বাদশার কাছে গোলাম আযম সাহেব সাত সাতবার এই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ৭৩ সালে লন্ডনে যেয়েও গো. আযম নামের নরাধম বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখেন এবং একাধিক প্রতিষ্ঠানকে জড়িত করেন বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায়। মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন গোলাম আযম। তিন মাসের ভিসা ছিল তার।  

৬. ১৯৮১ সালের শুরুর দিনটা যে কোন ইংরেজি নববর্ষের দিনের চেয়ে ব্যতিক্রম। হাজার বছর পরেও এর দ্যোতনা বজায় থাকবে। এদিন অর্থাৎ ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদে ফিলিস্তিনে শহীদ দুই বাংলাদেশির নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন প্রকাশ্যে, প্রথম কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন গো. আযম । নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময়ে তাকে জুতাপেটা করেন মুসল্লিরা। দুটো ছবি তুলতে পেরেছিলেন রশীদ তালুকদার। পরের দিন তা সংবাদসহ আরও কয়েকটি দৈনিকে ছাপা হয়। এই ‘জুতাপেটা’টা সাহস হয়ে থাকুক প্রজন্ম থেকে থেকে প্রজন্মে।  

৭. জিয়াউর রহমান পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন। এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে গিয়েছিল জামায়াত! ১৯৯১ সালে আবারও বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে তারা এবং বিএনপি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যায়। ১৯৯১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী তাকে আমীর হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর তার নাগরিকত্ব মামলা দেওয়া হয় তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার জন্য! খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে গো.আযম তার নাগরিকত্ব ফিরে পান। তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যারা যারা চেষ্টা করেছিলেন তাদের একজন ইকবাল সোবাহান চৌধুরী! বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণমাধ্যম উপদেষ্টা।   এরপর ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়া বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা গোলাম আযম ,নিজামী, মুজাহিদদের সঙ্গে নিয়েই আন্দোলন করেছিলেন! জামায়াত তার জন্মলগ্ন থেকেই এমন মেরুদণ্ডহীন! জন্মই তাদের আজন্ম পাপ!  

৮. মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গো.আযম গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই তার নব্বই বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। সাজা খাটার এক বছর তিন মাসের মাথায় গো.আযম মারা গেলেন।  

যার প্রকাশ্যে ফাঁসি বরণ বা ফায়ারিং স্কোয়াডে যাওয়ার কথা, সে জেলে বসে ডিভিশন পেয়ে ভালোই ছিলেন। বাইরে থেকে হয়তো আসতো তার বিছানা, পাখা এবং খাবার। সকালে মধু আর দুপুরে ঘি খেয়ে, বিকেলে ঢেকুর তুলে অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে খোশ গল্প করে সুখেই ছিলেন গো. আযম নামের নরাধম!  
এদেশটা সম্ভবত নরাধমদের জন্যই। এদেশের রাজনীতির চোরাগলি তাকে ও তার দলকে নিয়ে বহুবার লুকোচুরি খেলেছে। যারা শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে গোলামদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কিংবা মেলাবে, মহাকাল গো. আযম দের মতো তাদেরও নিক্ষেপ করবে ঘৃণা নামের যাদুঘরের থুথুখানায়!!
০ Likes ২ Comments ০ Share ৪৫৯ Views

Comments (2)

  • - সুলতানা সাদিয়া

    অন্যরকম অতৃপ্তিতে শেষ হল গল্প। ভাল লাগলো। গল্প আরও চাই।