Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কবীর কবীর

৯ বছর আগে

বর্ণ দিয়েই ছড়া

 

‘জীবনস্মৃতি’ আর ‘ছেলেবেলা’ দুটো বইয়েই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের ছোট বয়সের অনেক কথা লিখে গেছেন তিনি। সে সব পড়লে দেখি, রবি নামের ছোট ছেলেটি তার পড়ারবই একেবারেই পড়তে চাইত না। মাস্টারকে ফাঁকি দেওয়ার দুটো বেশ পাকাপোক্ত উপায় সে বের করেছিল- মাথাব্যথা করছে আর পেট কামড়াচ্ছে। দুটোই বাইরে থেকে দেখে বুঝবার কোনো উপায় নেই। জ্বরের কথা বলত না, কেননা জ্বরে তো গা গরম হবে, গায়ে হাত দিলে বুঝতে পারা যাবে যে জ্বর এসেছে। মাস্টারের হাত ফস্কে পালানোর এ ছিল এক কায়দা। পালানো কেন? পিটুনি খাওয়ার ভয়ে। আগের আমলে মাস্টারদের বিশ্বাস ছিল- ছাত্রদের মারধর না করলে তাদের মগজে কিছু ঢোকানো যায় না। ফলে রবি অসুখের অজুহাত তুলে পালিয়ে গিয়ে মার আঁচলের তলায় লুকাত।

এ ছেলেটিই বড় হয়ে যখন কবিতা, গল্প-উপন্যাস-নাটক-গান লিখবে, গান গাইবে, ছবি আঁকবে, তখনও সে নিজের ছেলেবেলাকার কথা ভোলেনি।

কিন্তু সে ঠিকই মনে রেখেছিল- পড়া ভালো না লাগার কারণটা কী? কারণ খুবই সহজ ও সোজা। লেখাগুলো এমন যে পড়ে মজা পাওয়া যায় না, ভালো লাগে না পড়তে।  তখন তাঁর মনে হয়েছিল ছোটদের জন্য এমন বই লিখতে হবে যা তাদের পড়তে কষ্ট হবে না, পড়ে আনন্দ পাবে। শুধু তাই নয়, বই লেখাই নয় কেবল, সে ছোটদের জন্য স্কুলও খুলেছিল- যেখানে কোনো ছেলেকে বকা চলবে না, মারধর করা যাবে না, একেবারে কড়া নিয়ম, বেতাল কিছু ঘটলে মাস্টারের চাকরিই চলে যাবে।

বই তিনি লিখেছিলেন 'সহজ পাঠ' নাম দিয়ে। ছোট ছোট চারটি চটি বই: 'সহজ পাঠ- প্রথম ভাগ', 'সহজ পাঠ- দ্বিতীয় ভাগ', 'সহজ পাঠ- তৃতীয় ভাগ'। পরে 'সহজ পাঠ- চতুর্থ ভাগ'ও বেরিয়েছিল, তবে তিনি তা লেখেননি, তার ইশকুলের মাস্টারমশাইরা সেটি লিখেছিলেন। বাংলা ভাষার বর্ণপরিচয় জানা হয়ে গেলে তার পরে যেমন বই পড়লে মজা লাগবে, তেমন ধরনের বই এগুলো। অর্থাৎ অ-আ থেকে ও-ঔ পর্যন্ত আর ক-খ থেকে হ পর্যন্ত সব কটি বর্ণ জানা হয়ে গেলে, তখন এ বইগুলো পড়তে মজা লাগবে। সব বর্ণ দিয়েই ছড়া তৈরি করা হয়েছে। যেমন, অ-আ দিয়ে :
ছোট খোকা বলে অ আ
শেখেনি সে কথা কওয়া।
হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
বসে খায় ক্ষীর খই।
হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ
ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ।
ঘন মেঘ বলে ঋ
দিন বড়ো বিশ্রী।
বাটি হাতে এ ঐ
হাঁক দেয় দে দৈ।
ডাক পাড়ে ও ঔ
ভাত আনো বড়ো বৌ।
ব্যঞ্জনবর্ণ অর্থাৎ ক-খ থেকে হ পর্যন্ত বর্ণগুলো নিয়েও এ রকম ছড়া রয়েছে। যেমন-
ক খ গ ঘ গান গেয়ে
জেলে-ডিঙি চলে বেয়ে।
চ ছ জ ঝ দলে দলে
বোঝা নিয়ে হাটে চলে।
ট ঠ ড ঢ করে গোল
কাঁধে নিয়ে ঢাক ঢোল।
বলে মূর্ধন্য ণ
চুপ করো, কথা শোনো।
রেগে বলে দন্ত্য ন
যাব না তো কক্ষনো।
শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ
কোণে ব'সে কাশে খ ক্ষ।

এইভাবে স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ শিখে ফেলার পরে ছড়া কিংবা কবিতা বা গল্প পড়া তো কঠিন কোনো কাজ নয়। সবাই পড়তে পারবে। যেমন ধরা যাক এই কবিতা :
কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি-
বোঝাই-করা কলসি হাঁড়ি
গাড়ি চালায় বংশীবদন,
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।
হাট বসেছে শুক্রবারে
বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে।
জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে
গ্রামের মানুষ বেচে কেনে।
কবিতাটি বেশ বড়, কিন্তু খুবই মজার। শেষ হয়েছে এভাবে:
পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে।
জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে।

'সহজ পাঠ-দ্বিতীয় ভাগ' বইটাতেই রয়েছে সেই মজার কবিতা:
একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু-
'চেয়ে দেখো' 'চেয়ে দেখো' বলে যেন বিনু।
চেয়ে দেখি, ঠোকাঠুকি বরগা-কড়িতে,
কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।
ইটে-গড়া গণ্ডার বাড়িগুলো সোজা
চালিয়েছে, দুদ্দাড় জানালা দরোজা।
রাস্তা চলেছে যত অজগর সাপ,
পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্ধাপ।
শেষ পর্যন্ত কী হল?
লক্ষ লক্ষ লোক বলে, 'থামো থামো,
কোথা হতে কোথা যাবে, একি পাগলামো'।
কলিকাতা শোনে নাকো চলার খেয়ালে;
নৃত্যের নেশা তার স্তম্ভে দেয়ালে।
অবশেষে-
কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যেই-
দেখি, কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই।
রবীন্দ্রনাথের 'সহজ পাঠ'-এর মতো বই আর লেখা হয়নি, ছোটদের বর্ণমালা শেখানোর জন্য এর চেয়ে ভালো বই আর হয় না। শান্তিনিকেতনে এখনও এ বই পড়ানো হয়। আমাদের এখানে স্কুলে পড়ানো হয় না। না হোক, কিন্তু বাড়তি আনন্দপাঠ হিসেবে এ বই ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে ঘুরলে তাদের খুবই উপকার হবে।

০ Likes ০ Comments ০ Share ৬৫৯ Views