Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

রাজীব নূর খান

৭ বছর আগে

বদরুল এবং হিমু

সকালে ঘুম ভাঙতেই হিমু নিজেকে সরকারি হাসপাতালে আবিস্কার করলো। কে বা কারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে কিছুই সে জানে না। তার শুধু মনে আছে, সে দুই দিন ধরে না খেয়ে ছিল। হঠাৎ সে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। যারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে, তাদের প্রতি এক আকাশ কৃতজ্ঞতা বোধ করল। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, হিমু মনে মনে ভাবলো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে এখনও মানুষের মধ্যে মায়া-মমতা ভালোবাসা আছে। একজন নার্স এর কাছে চাইতেই পাওয়া গেল- খবরের কাগজ। হিমু খবরের কাগজের প্রথম পাতার শিরোনাম দেখে অবাক। প্রচন্ড অবাক! হেড লাইনটি এই রকম- ''নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষগুলোর কাছে আমি সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া কেউ আপন নয়।''


হাসপাতাল থেকে হিমুকে সকালে নাস্তা দেওয়া হয়েছে- একটি ছোট কলা, দু'টো পাতলা রুটি আর ভাজির মতোন কিছু একটা। হিমুর খুব ক্ষুদা পেয়েছে। সে খুব আরাম করে নাস্তা খেল। আর দু'টা রুটি হলে ভালো হতো। হিমুর আশে পাশে বেডের রুগীরাও খুব আয়েশ করে নাস্তা খাচ্ছে। হিমুর ঠিক পাশের বেডে একজন রোগা যুবক শুয়ে নাস্তা খাচ্ছে, তার চোখ মুখ ফুলে আছে, বুঝাই যাচ্ছে- তাকে অনেক পিটুনি দেওয়া হয়েছে। তার ডান হাতে হাতকড়া বেড এর সাথে লাগানো। পাশে একজন রোগা পুলিশ বসা। তার মানে সে একজন আসামী। রোগা যুবকটি হিমুর দিকে তাকিয়ে বলল, হিমু ভাইজান আপনি কেমন আছেন? হিমু পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে রোগা যুবকটির দিকে তাকিয়ে বলল- আমি এখন ভালো আছি বদরুল। এবং তুমি শুনলে অবাক হবে- আমি পত্রিকাতে তোমার ঘটনাটিই পড়ছিলাম। যাই হোক, তুমি আমাকে চিনলে কি করে? বদরুল হেসে বলল- আপনার হলুদ পাঞ্জাবী দেখে।


বদরুল বলল, হিমু ভাই আমি কি ছাড়া পাবো? নাকি ওরা আমাকে ফাঁসি দিয়ে দেবে? আমার দলের লোকজন কি আমার মুক্তির ব্যবস্থা করবে না। ফুলের মালা পরিয়ে আমাকে হাজত থেকে বের করবে না? হিমু বলল, আস্থা রাখো, অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। যখন কিছু ঘটে, খুব দ্রুত'ই ঘটে। বদরুলকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে শিস দিয়ে একটা গানের সুর তোলার চেষ্টা করছে। হিমু বলল, বদরুল ছোটবেলায় তোমার প্রিয় খেলা কি ছিল? বদরুল বলল, আলমারি থেকে সমস্ত কাপড় মাটিতে ফেলে দিয়ে আলমারির মধ্যে বসে থাকতাম। তখন আমার বয়স চার/পাঁচ হবে। এখনও মাঝে মাঝে এই খেলাটা খেলতে খুব ইচ্ছা করে। ধোয়া কাপড় মেঝেতে ফেলার জন্য মা খুব বকা ঝকা করতো। হিমু, ভাই আমি কিন্তু আমার মাকে অনেক লাভ করি। মা'র চোখে সমস্যা। ইদানিং সে সব কিছুই ঝাপসা দেখে। মা'র চিকিৎসা করাতে হবে।


 বদরুলের চোখে জল। সে হিমুর দিকে তাকিয়ে বলল- হিমু ভাই, আমি জানি আপনার অনেক ক্ষমতা। আমি যদি আপনার কাছে কিছু চাই, তাহলে কি পাবো? হিমু বলল, আগে কি চাও শুনি। বদরুল বলল- এই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমাকে ঢাকার স্কায়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আমার ভালোবাসার মানুষ আছে। দুইজন একই হাসপাতালে থাকব, ভাবতেই অনেক আনন্দ হচ্ছে! বদরুল এর চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে। হিমু ভাইজান, যদি ছাড়া পাই এবং মেয়েটা যদি বেঁচে যায় তাহলে আমি মেয়েটাকে বিয়ে করবো। অনেক ভালোবাসবো তাকে। বোকা মেয়েটা আমার স্বচ্ছ এবং পবিত্র ভালোবাসাটা বুঝতেই চাইল না। কত্ত ভাবে বুঝাতে চাইলাম। আমি ফোন দিলে ধরে না, বরং অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলে। খুব রাগ লাগল, নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হলো, ক্ষুদ্র মনে হলো- অসহায় মনে হলো। বোকা এবং নির্বোধ এর মতোন রাগের মাথায় পকেটে যে কয় টাকা ছিল-একটা ছোট ছুরি কিনে নিলাম। তারপর... নিজের ভালোবাসার মানুষকে মারতে, আমার কষ্ট হয়নি(?) খুব কষ্ট হয়েছে। কলিজাটা ছিড়ে গেছে। সত্যি বলছি হিমু ভাই, ওকে আমি খুন করতে চাইনি। ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করে আহত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাত কি থেকে কি হয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ও পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হবে, আমি ডাব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ... হিমু ভাই, জীবনানন্দ দাশের কবিতা আমার অনেক ভালো লাগে। রাত জেগে-জেগে আমি জীবন বাবুর কবিতা মুখস্ত করতাম। খাদিজাকে শোনাবো বলে। হিমু বলল, কোন কবিতাটা। বদরুল চোখের পানি মুছতে মুছতে আবৃত্তি করল- ''এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;/সারারাত দক্ষিনা বাতাসে/আকাশের চাঁদের আলোয়/এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি,/-কাহারে সে ডাকে!''


ডাক্তার এসে হিমুকে বলল, আপনি এখন সুস্থ। আপনি বাসায় চলে যান। হিমু বলল, শরীর খুব দুর্বল লাগে ডাক্তার, আমি আর কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাই। হিমুর কথা শুনে ডাক্তার মেয়েটি হেসে ফেলল। সুন্দর হাসি। হাসি দেখে হিমুর রুপা'র কথা মনে পড়ল। অনেকদিন দেখা হয় না রুপা'র সাথে। হিমু বদরুলকে বলল, মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। পৃথিবীতে একেকজন মানুষের মনমানসিকতা একেক রকমের। প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন জগৎ এবং প্রত্যেকটি মানুষের পছন্দ ও নিজস্ব চিন্তাভাবনা আলাদা। কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেকে আহত বা নিজের ক্ষতি করে অথবা কোনো প্রিয় জনকে। কিন্তু তাদের আসলে মৃত্যুবরণ করার কোনো প্রকৃত ইচ্ছা নেই। একে বলে প্যারাসুইসাইড। মানুষের জন্যই মানুষ। সংকটে, বিপদে মানুষই ছুটে এসে সাহায্য করবে এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। না হলে মানব-জন্ম অনেকটাই অসম্পূর্ন থেকে যাবে।


সন্ধ্যা সাত টায় হিমু হাসপাতাল থেকে বের হলো। সে কোথায় যাবে- জানে না। মেসে ফিরতে ইচ্ছা করছে। রাস্তায় চলাচলরত মানুষের দারুন ব্যস্ততা। মানুষের ব্যস্ততা দেখতে ভালো লাগছে। হিমু লক্ষ করে দেখেছে- প্রতিটা মানুষ সন্ধ্যায় অস্থির বোধ করে। কারণ সারাদিন কর্ম ব্যস্ততায় ভর সন্ধ্যায় ছুটে যেতে ইচ্ছা করে প্রিয় মানুষের কাছে। রুপা ছাড়া হিমুর প্রিয় মানুষ আর কে আছে! হিমু এখন যাবে রুপার কাছে। রুপাকে বলবে- ইলিশ মাছের দিম ডিয়ে ভাত খাবো। সাথে ঘন ডাল। হিমু আগ্রহ নিয়ে খাবে, রুপা পাশে বসে থাকবে। হিমু গপ গপ করে খাবে। রুপা বলবে, এই আস্তে খাওতো। খাবার খেতে হয় আরাম করে। হিমু বলবে, আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি। এই কথা শুনে রুপার চোখ কি ভিজে উঠবে না!


সুন্দর জোছনা আজ। চাঁদের আলোতে হিমুর লম্বা ছাড়া পড়েছে। হিমু বদলরুলের কথা ভাবতে-ভাবতে রুপা'র বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বাস্তব বড় কঠিন। বাস্তবতার কাছে বদরুল'রা পরাজিত হয়। মেধাবি ছাত্র বদরুল। দু'বার বৃত্তি পেয়েছে। বাবা ছিলেন কৃষক। বদরুল টিউশনি করে নিজের লেখা পড়ার খরচ চালাতো। টিউশনি'র টাকা থেকে মাকে কিছু দিত। পরিবারের জন্য তার ছিল অনেক ভালোবাসা। মাকে বলতো- আর কিছু দিন কষ্ট করো মা, চাকরিটা পেলেই তোমাকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে চোখের চিকিৎসা করাবো। পরিবারের জন্য আমার যতটুকু দায়িত্ব তার থেকে অনেক বেশি আমি করতে চাই। বড় ভাই দারিদ্রতার কারনে লেখা পড়া করতে পারে নি। সে একজন দর্জি। খুব যত্ন নিয়ে ছোট ভাই বদরুলের জামা বানিয়ে দেন। বদরুলের মা'র স্বপ্ন ছেলে মাস্টার্স শেষ করে বড় চাকরি করবে। তার চোখের চিকিৎসা করবে। ছোট বোনটাকে ঝাঁকজমক অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেবে। পরিবারের সবাই তাকিয়ে আছে বদরুলের দিকে। বদরুলের একটা ভুলের জন্য- একটা দুঃখী পরিবার তছনছ হয়ে গেল।


হলে সিট না পাওয়ার কারনে খাদিজাদের বাসায় থাকতে হয়েছিল বদরুলকে। একদিন এক বড় ভাই তাকে বুদ্ধি দিলো- ছাত্র রাজনীতি করো, তাহলে হলে সিট পেতে সুবিধা হবে। তাছাড়া ছাত্রলীগ করলে সব ছেলে-মেয়েরা তোমাকে খাতির করবে। অনেক সুযোগ সুবিধা পাবে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবি ছাত্র বদরুল তার মেধা দিয়ে ছাত্রলীগে জায়গা করে নেয়। একজন মানুষকে অন্য একজনের ভালো লাগতেই পারে। খাদিজাকে তার ভালো লাগে। খাদিজা যদি বদরুলের ভালোবাসায় সম্মতি জানাতো- তাহলে বদরুল খুব মন দিয়ে তার লেখা পড়া শেষ করে, ভালো একটা চাকরী করত। তারপর তাদের বিয়ে হতো। তাদের ঘরে একটা বাবু আসতো। হাসি খুশি আনন্দময় একটা জীবন।


এখন, বদরুলের ভুলের জন্য গোটা ছাত্রলীগকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। দোষ যদি দিতেই হয়, কাউকে দায়ী যদি করতেই হয়- তাহলে এই সমাজ এবং সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। ছাত্রলীগ তো আর বলে নাই- যাও বদরুল খাদিজাকে কোপাও। ইচ্ছে মতো কোপাও। আমি যদি আজ কোনো অপরাধ করি, তাহলে কি আমার বাবা-মাকে দোষ দেয়া ঠিক হবে? পৃথিবীর ইতিহাস বলে, অনেকেই তার প্রেমিকাকে খুন করেছে। হিটলার তার প্রেমিকা কে না পেয়ে কি করেছে তা তো আজ সারা দুনিয়া জানে। মেধাবী ছাত্র গুলো আজ জঙ্গী হচ্ছে। ছেলে তার বাবাকে হোন্ডা না কিনে দেয়ায় শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সমাজের এই পচন আমাদের রোধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে। সমস্যা থাকলে, তার সমাধানও আছে। সব কিছুর সাথে সব কিছুর সামঞ্জস্য আছে। বদরুলের এই কর্ম কান্ডের জন্য আপনিও কোনো না কোনো ভাবে দায়ী। 


০ Likes ০ Comments ০ Share ২৩৫ Views

Comments (0)

  • - এই মেঘ এই রোদ্দুর

    সুন্দর চিঠি। ভোট দিলাম

    • - প্রলয় সাহা

      ধন্যবাদ দিভাই