ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো...
ফেসবুকেই হঠাৎ করেই বন্ধু লোকমানকে পেয়ে গেলাম একদিন। আমার ৩০ বছর আগের ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বন্ধু! ওর মাধ্যমেই আবার আমাদের ২১ তম ইন্টেকের সকলের সাথে ফেসবুকে এবং কয়েকটি গ্রুপে অ্যাড হলাম। জানতে পারলাম ২১ তম ইন্টেকের ৩০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে মিলনমেলা হতে যাচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর। আমি আশচর্য হয়ে জানতে পারলাম আমার অন্য বন্ধুরা এতদিন জানত আমি মারা গেছি সেই ১৯৮৪ ইং সালে। আমি অসুস্থতার জন্য যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে খুব সিরিয়াস কন্ডিশনে ছিলেম সেই সময়ে। পরবর্তীতে কলেজ কতৃপক্ষের সাথে একটা সমঝোতার দ্বারা আমি সি.এম.এইচ থেকেই একেবারে চলে গেলাম। তবে আমার বন্ধুরা এসব জানত না। তাই বন্ধু লেঃ কর্ণেল বিপ্লব বেনজীর সহ অন্যরা আমাকে এই মিলনমেলায় আসার জন্য খুব শক্তভাবে ধরল। আর বেনজীর যে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ ছিল, ওর এটাই শেষ বছর। জানুয়ারীতে চলে যাবে ঢাকা হেডকোয়ার্টারে। তাই এবারের মিলনমেলাটির গুরুত্ব একটু বেশীই ছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম যাবো।
২২ ডিসেম্বর বিকেলের বাসে করে সরাসরি খুলনায় আমার বাড়িতে রওয়ানা হলাম। সেখানে রাতটি কাটিয়ে পরেরদিন বিকেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। গড়াই নামের কুষ্টিয়াগামী একটি বাসে করে একেবারে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ২নং গেটে নেমে গেলাম। ওখানে বন্ধু বেনজীর এবং রেজা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ত্রিশ বছর পরে শৈশবের সেই চেনা মুখগুলোকে আলিঙ্গনের দ্বারা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চাইলাম। গেস্ট হাউসে সেই ২৩ তারিখের রাতটি আমি, বেঞ্জীর এবং রেজার কাটলো এই কলেজ নিয়ে স্মৃতিকাতর কিছু মুহুর্ত রোমন্থনে।
২৪ তারিখ সকালে রওয়ানা দিয়ে লোকমান সহ সামি, মোস্তাক, সাজ্জাদ, নুরুজ্জামানের দুপুরের আগেই কলেজে পৌঁছানোর কথা ছিল। এদের ভিতরে নুরু, সামি ও সাজ্জাদ ফ্যামিলিসহ আসবে। আমি, মঞ্জুর ও রেজা অপেক্ষা করছিলাম। তবে ওরা একটু দেরীতে রওয়ানা করেছিল বিধায় আসতে আসতে একেবারে বিকেল হয়ে গেলো। এদিকে দুপুরের দিকে অনুষ্ঠানের 'প্রধান অতিথি' Major Genaral Md. Mahfuzur Rahman , rcds,ndc,afwc,psc,phd (Chairman, Governing Bodies of Cadet Colleges & Adjutant General, Bangladesh Army) হেলিকপ্টারে করে কলেজ ফিল্ডের হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। আমি ও মঞ্জুর সেই সময় মাঠের কাছেই ছিলাম। রেজা মেসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এভাবে বিকেল পর্যন্ত আমরা তিনজন বিচ্ছিন্নভাবে সময়টা কাটালাম।
পড়ন্ত বিকেলে নুরু, সামি, মোস্তাক আর সাজেদ এলে সবাই বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের দিকে চলে যাই। সেখানে বাকী বন্ধুদের সাথে ৩০ বছর পরে আমার দেখা হয়... সে এক অদ্ভুদ অনুভূতি!! জীবনের অধিকাংশেরও বেশী বছর পার করে এই বেলাশেষের অবেলায় এদের সাথে হল দেখা... পুরস্কার বিতরণ শেষ হলে মেজর জেনারেলের সাথে এক সৌজন্য চা-চক্রে সকলে মিলিত হলাম। বেশ উপভোগ্য ছিল ঐ সময়টুকু।
এরপরে জেনারেলের সাথে ডিনার এবং ক্যাডেটদের অংশগ্রহনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান... এই দুটোই ছিল ২৪ তারিখের সর্বশেষ ইভেন্ট।
আমি, নাসের, নুরুজ্জামান এবং রেজা এক ফাঁকে এবারের চ্যাম্পিয়ন হাউস হুনায়নে গিয়ে ঘুরে এলাম। আমি ছাড়া ওরা বাকি তিনজন ছিল এই হাউসের। সেখানে বন্ধুদের সাথে কিছু নস্টালজিক মুহুর্ত কাটালাম...
২৪ ডিসেম্বর রাতটা ছিল আমাদের সকল বন্ধুদের জন্য একান্তে পুরনো দিনের স্মৃতিকাতরতায় ভোগার... আমাদের সাথে আমরা পেয়েছিলাম দুজন সিনিয়র ভাইকে। আনোয়ার ভাই এবং নজরুল ভাই। খুব সুন্দর কিছু মুহুর্ত গল্পে গল্পে কেটে গেলো, সেই ভোর ৪ টা পর্যন্ত।
ডিসেম্বর ২৫, ২০১৪ ইং... এইদিন ছিল ২১তম ইন্টেকের ৩০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে মিলনমেলা। সকাল থেকেই আমাদের ইভেন্ট শুরু হল। কখনো আমরা দলবেঁধে পুরো কলেজ ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ালাম... নিজেদের ভিতরে মৃদু খুনসুটির সাথে চলল 'পিছনে ফিরে দেখা'... এভাবে কখন দুপুর হয়ে গেল টেরই পেলাম না। আসলে 'কোয়ালিটি টাইম' খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
দুপুরে ছিল বেনজিরের বাসায় আমাদের লাঞ্চ। বেনজির ভাবি আমাদেরকে খুব সুন্দরভাবে আপ্যায়ণ করেছিলেন (যদিও খাবারের ছবি পোষ্ট করাটা আমার কাছে সবসময়েই কেন জানি দৃষ্টিকটু লাগে, এরপরেও হয়তো দু'একটি এই অ্যালবামে চলে আসতে পারে )। তার আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাবিকে সেজন্য অনেক ধন্যবাদ ।
এরপরে আমাদের ১০০ মিটার স্প্রীন্ট হল। বেনজির সেখানে প্রথম হয়। বিকেল পর্যন্ত চলে এই বাংলোয় আমাদের ফটোসেশন।
সন্ধ্যায় হুনাউন হাউসের সামনের ফিল্ডে চলে মনোমুগ্ধকর 'ফায়ারওয়ার্ক্স'।আতশবাজির প্রদর্শন সত্যিই আমাদের সকলকে যারপরনাই আনন্দিত করে।
Gym 21st উদ্বোধন করেন বেনজির ভাবি। খুবই আনন্দঘন মুহুর্ত ছিল সেটি! এই জিমনেশিয়ামটি আমাদের ২১তম ব্যাচের বন্ধুরা সম্পুর্ণ নিজেদের খরচে করে দিয়েছে।
ডিনারের পরে অডিটরিয়ামে 'কালচারাল ইভেন্টে' সকল ক্যাডেটদেরকে সাথে নিয়ে আমাদের ইনটেক অংশগ্রহন করে।তুহিন ভাইকে খুব ভালো লাগলো কীবোর্ডে দেখে।বেনজির তিনটি অসাধারণ গান গেয়েছিল। 'আবার এলো যে সন্ধ্যা' গানের সাথে আমরা সবাই নেচে গেয়ে আনন্দে উল্লসিত হয়েছিলাম।
এরপরে ডিজে পরী স্টেজে আসে। মধ্যরাত পর্যন্ত চলে সকল ক্যাডেটদের স্বতঃস্ফুর্ত নাচের সাথে ডিজে নাইট।
অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে আমি এবং রেজা নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসে জমাট বাঁধা শীতকে উপেক্ষা করে আমার হাউসের আমার ডর্মে (ডর্ম-৯) গিয়ে ঘুরে আসি। দুইতলায় উঠতে গিয়ে এক একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন উপরে উঠছিলাম... মনে হচ্ছিল ৩০ বছরের ঝাপসা অতীত এক একটি বছরকে ভেদ করে আমার মন-মননে কুয়াশা ভেদ করে আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছিল... আমি ক্রমশঃ প্রগলভ হয়ে পড়ছিলাম... কিছুটা আনন্দ... কষ্ট... না পাওয়ার বেদনা-এসব কিছুর মিশেলে আরো অন্য কিছু যেন! আমার শৈশব আমাকে ডেকে কি যেন কি বলতে চাইছিল... কিন্তু বাস্তবে আমি এমন ভাবে অনুভূতিতে জমাট পাথরে পরিণত হয়েছিলাম যে, ওর ডাক শুনলেও কিছু অনুধাবন করতে পারি নাই।
জানি না, আর কখনো ওখানে যাওয়া হবে কিনা। ইটপাথরের নগরজীবনে জীবন-জীবিকা আমাকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে, দ্বিতীয়বার যেতেই আমার ৩০ বছর লেগে গেল! হয়তো আরো এমন এক ৩০ বছর পরে এমন কিছু স্মৃতি আমায় ডেকে নিয়ে যাবে... হয়তো না। কিন্তু আশাটা মনের গভীরে জিইয়ে রইলো।
” দাগ মুছে যায় ধীরে ধীরে
দিন যত চলে যায়
ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো
বাসা বাঁধে মনেরই ছায়ায়...”
অনেক ভালোবাসা রইলো প্রিয় ‘জে সি সি’।
Comments (22)
থ্যাংকু
সুন্দর । ভালো লাগলো ।