Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

প্রজাপতি প্রেম.....

হাজেরা বেগম সেই সকাল থেকে অস্থির হয়ে আছেন, কি রান্না করবেন না করবেন, মানুষটা আবার এই গনগনে রোদ্দুরের মধ্যে কই গেল।
ঘরে তেমন কিছু নেইও, সকাল বেলা পাশের বাসার ছেলেটা দিয়ে একটা মোরগ আনিয়েছেন। মোরগ পোলাও রান্না করবেন। মানুষটা খেতে খুব পছন্দ করত, বিশেষ করে হাজেরা বেগমের হাতের মোরগ পোলাও। আগের অবস্থা থাকলে এই দিনটাতে একটু পায়েসও রান্না করতেন। কিন্তু মাসের শেষ এই সামান্য খরচটুকুও তাদের জন্য এখন অনেক। আয় বলতে এখন শুধু বুড়ো মানুষটার পেনশনের টাকা

রান্না প্রায় শেষ মানুষটা গেল কই? সেই যে বলে গেল একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি, আর কোন খবর নাই। ৫০ বছর আগে এদিনে উনি মানুষটার সংসারে বউ হয়ে আসেন। কতই বা বয়স ১৫/১৬। শশুর, শাশুড়ি, ননদ দেবর ভাসুর, ঘর ভরতি মানুষ ছিল। দিনশেষে মানুষটার সাথে দেখা হত সেই রাত্রিবেলা। চুপচাপ স্বভাবের আব্দুর রহমান মিয়া অপেক্ষায় থাকতেন। প্রায়ই সবার চক্ষু এড়িয়ে নিয়ে আসতেন কাঁচের, চুড়ি, লাল ফিতে, আচার। আস্তে আস্তে সেটা ভাটা পড়ল ছেলে মেয়ে আসার পর। খরচ গেল বেড়ে, বড় ভাই শহরেই স্থায়ী হলেন। বোনদের বিয়ে দিতে দিতে একে একে জমি জমা বিক্রি করে যা ছিল ছোট ভাই তার প্রায় সবটুকুই দখলে নিল শুধু বাবা মার ভাগটা দিয়ে গেল রহমানকে।

আজ হাজেরা বেগম আর আব্দুর রহমান দুজনেই নি:স্ব আর নিসংগ , শশুর, শাশুড়ি চলে গেছেন অনেক বছর হল। ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে ভিটে, জমি সব কিছুর মায়া ছাড়তে হল। মিয়া বাড়ির ছেলে এখন পাশের শহরে টিনশেড ভাড়া নিয়ে থাকেন। ছেলে মেয়েরাও আর গেয়ো অশিক্ষিত বাবা মাকে শহরে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ৫০টা বছর, মানুষটার কি আদৌ মনে আছে, সেই দিনটির কথা। কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলেন, প্রচন্ড ভয় আর আতংক নিয়ে সেদিন পালকিতে উঠেছিলেন।

আর রহমান সাহেব, জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে নিজেকে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনে করেন। নাহ ছেলে মেয়ে, ভাই বোনের উপর তার কোন অভিযোগ নেই। শুনেছেন ছোট ভাই এলাকায় এম পি হয়েছে, সহায় সম্পত্তি অনেক বেড়েছে। নাহ অন্তত মিয়া বাড়ির নামটা আছে। আর তার আছে ভালবাসার মানুষ, হেলান দেয়ার জন্য একটা বিশাল আশ্রয়। দিন শেষে তাই রহমান সাহেবের নিজেকে অনেক বড় আর সম্পদশালী মনে হয়।

কষ্ট শুধু একটা, সেই ১৫ বছর বয়স থেকে মানুষটা খালি দিয়েই গেল। কোনদিন মুখ ফুটে কিছু চাইনি, নাহ কোন অভিমান, অভিযোগ। রহমান সাহেব সব সময়ই তাকে একটা বট বৃক্ষের ছায়ার মত পেয়েছেন। শত কষ্টেও আজও ঠিকে আছেন শুধুই ওই মানুষটা জন্য।

তার ঘরে যখন আসে, কি ফুটফুটে লাজুক, আলতা পড়া, লাল রংয়ের জরি পাড়ের শাড়ি পড়া ছিল মেয়েটা এখনও চোখে ভাসে। কত দিন তার জন্য আলতা, চুড়ি আর আচার কিনে নিয়ে যান না। আজ যেভাবেই হোক একটা কিছু নিয়ে যেতেই হবে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে তাদের সংসার শুরু হয়েছিল। কিন্তু মানুষটার কি মনে আছে?

কিন্তু মাসের শেষে কি কিনবেন, তার আবার ধার কর্জ চাইবার অভ্যেস নেই। একটা শাড়ি, একটা আলতা, এক গোছা কাঁচের চুড়ি হলে খুব ভাল হত। কিন্ত মাস শেষে তার হাতে এত টাকা নেই।
অস্থির হয়ে সারাটা সকাল, প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল, কিছুই কিনতে পারলেন না। ঘেমে নেয়ে একটা বড় গাছের নীচে একটু দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন একটা ফুলের দোকান, একটা ছেলে কিছু ফুল কিনে একটা মেয়েকে দিতেই সে খুশিতে ঝলমল করে উঠল।

কোন কিছু না ভেবেই পকেটের কটা টাকা দিয়ে বেলীর মালা কিনলেন। ফেরার পথে নিজেকে একটু কেমন উজবুক লাগল। এই বয়সে ফুল, কে জানে হাজেরা বেগমের দিনটার কথাই মনে আছে কিনা আর ফুল। ভাগ্যিস সাদা পাঞ্জাবী পড়া ছিল। তারই পকেটে মালা কটা লুকিয়ে নিয়ে বাসায় ঢুকলেন। ততক্ষণে হাজেরা বেগম গোসল করে বিয়ের শাড়িটা পড়লেন, ভাবলেন রহমান মিয়া আসার আগেই বদল করে ফেলবেন। মানুষটার আজকের দিনের কথা মনেই নেই। কি লজ্জার ব্যাপার হবে দেখলে।

হঠাৎ করে জানালার পর্দাটা বাতাসে নড়ে উঠতেই, হাজেরা বেগম আয়নায় রহমান মিয়ার ছায়া দেখতে পেয়ে একটু কেঁপে উঠেন। পাঞ্জাবীর আড়াল থেকে খুব সংকোচে মালা কটা বের করে দিতেই হাজেরা বেগমের মুখটা দোকানে দেখা ওই কিশোরীর মত ঝলমল করে উঠে।

০ Likes ০ Comments ০ Share ৫৩৪ Views