Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহসান কবির

৮ বছর আগে

পুরাণে লিখিত শয়তান নাকি সন্ন্যাসী?

আহসান কবির

হুমায়ূন আহমেদকে নতুন করে মনে পড়ার কারণ হচ্ছে পুলিশ। বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম এই লেখকের বাবা ফয়জুর রহমান পুলিশে চাকরি করতেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। পুলিশকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রসিকতা বোধ করি এমন- পুলিশের পোশাকে এত পকেট থাকে কেন? উত্তর হচ্ছে- পাবলিকের টাকা জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার পর সেগুলো রাখার জায়গা করার জন্য।

হুমায়ূন আহমেদ অবশ্যই সেটা জানতেন। এ কারণেই তিনি তার প্রিয় চরিত্র হিমুর হলুদ পাঞ্জাবিতে একটিও পকেট রাখেননি। সাধু পুরুষদের নাকি টাকা লাগে না! এক সময়ে পুলিশ বানান নাকি দুইভাবে লেখা হতো। একটা পুলিশ। কেউ কেউ এটাকে ব্যঙ্গ করে বলতো- পুলিশের পূর্ণরূপ- পুরাণে লিখিত শয়তান! অন্যটা 'পুলিস'। এই পুলিসের পূর্ণরূপ-পুরাণে লিখিত সন্ন্যাসী!

পুলিশ শয়তানও নয়, সন্ন্যাসীও নয়। পুলিশ তাহলে কী? অনেকে হয়তো প্রচলিত কথাটাই বলবেন- মাছের রাজা ইলিশ আর জামাইয়ের রাজা পুলিশ। দিন যত যাবে পুলিশ নিয়ে মানুষের পক্ষে-বিপক্ষের মতামত বাড়বেই। দেশ-বিদেশের পুলিশ নিয়ে তাই কিছু তথ্য প্রথমেই জেনে নিই-

এক. জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ব্রিটিশদের পাশাপাশি ভারতীয় পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও অংশ নিয়েছিলেন, যারা গুলি ছুড়েছিলেন স্বজাতিদের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাতেও বাঙালি পুলিশ গুলি ছুড়েছিল, শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে!

দুই. গ্রিক শব্দ পুলিশিয়া থেকে পুলিশ শব্দটার উৎপত্তি, পুলিশ শব্দটা প্রথম ব্যবহৃত হয় মধ্য ফ্রান্সে।

তিন. প্রাচীন গ্রিসেই প্রথম দাসদের ব্যবহার করা শুরু হয় পুলিশি কাজে। এরা রাজাদের জনসভা পাহারা দিতো, পাহারা দিতো অপরাধীদের। রানীদের অন্দরমহল পাহারাতে ব্যবহার করা হতো খোজাদের, যাদের যৌন ক্ষমতা ছিল না।

 

চার. রোমান সাম্রাজ্যে পুলিশি দায়িত্ব পালন করতো রাজার সৈন্যরা। পরে পুলিশের জন্য আলাদা লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। যুদ্ধ ও দেশ রক্ষার জন্য সৈন্যদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয় যা এখনও কোনও না কোনওভাবে বিভিন্ন দেশ অনুসরণ করছে।

 

পাঁচ. স্পেনে বারশশতাব্দীতে পুলিশি কাজের জন্য আলাদা লোক নিয়োগ করার রেওয়াজ ছিল। সেসময় ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্পদ পাহারা, রানী বা হেরেমের নিরাপত্তা, অপরাধীদের গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণসহ আরও অনেক কাজে লোক নেওয়ার প্রবণতা ছিল এবং এদের বিভিন্ন নাম দেওয়া হতো। যেমন- ট্রুপারস, শেরিফস, কন্সট্যাবলস, রেঞ্জার্স কিংবা পিস কিপার্স।

 

ছয়. মধ্য ফ্রান্স থেকে এই পুলিশ শব্দটা ইংল্যান্ডে যেন চলে আসে ১৮শশতাব্দীতে। ১৮০০ সালে অনেকটা বর্তমান পুলিশের আদলে প্রফেশনাল পুলিশের যাত্রা শুরু হয় ইংল্যান্ডেই। ১৮২৯ সালে সেখানে মেট্রোপলিটন পুলিশের যাত্রা শুরু হয় যা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাযজ্ঞের মতো ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচার শুরু থেকেই চোখে পড়ে। এদেশে তাই এমন প্রবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা। ১৮৫০ সালে ওয়েলসে পুলিশ না রাখার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে ওঠে। পুলিশ বিপত্তি ঘটায়নি সম্ভবত এমন কোনও রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া যাবে না!

 

সাত. ইংল্যান্ডের পুলিশকে প্রথম হেলমেট পড়িয়ে ডিউটি করানো হয় ১৮৬৩ সালে। পরের বছর তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বাঁশি।

 

আট. পুলিশ দিয়ে শাসন করার এই কলোনিয়াল সিস্টেমের আইডিয়াটা ইংল্যান্ড ধার নিয়েছিল ফ্রান্সের কাছ থেকে। এ কারণেই ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের পুলিশের আদল, ভাবভঙ্গি এবং আইন-কানুন প্রায় একইরকম। ব্রিটিশ আমলের সেই পুলিশ আইনের প্রায় পুরোটা এখনও বহাল আছে!

 

নয়. জন্মই আমার আজন্ম পাপের মতো পুলিশের ওপর মানুষের বিরূপ ধারণা রয়েছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হিসেবে পেটোয়া ও দমন পীড়নের জন্য পুলিশের এমন ব্যবহার সহসা কমবে বলে অনেকেই মনে করেন না। সে কারণেই টিকে থাকবে বিশেষ ক্ষমতা আইন, যেটিকে সম্বল করে পুলিশ যখন-তখন যেকাউকে গ্রেফতার করতে পারবে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে টর্চারও করতে পারবে! আর যে সরকারই আসুক বিসিএসের নামে তাদের সমর্থকদের চাকরি দেওয়া হবে পুলিশে!

 

দশ. অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ সেদেশের আদিবাসীদের ওপর দীর্ঘদিন দমনপীড়ন চালিয়েছে। একসময় আদিবাসীদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছে অস্ট্রেলিয়ান সরকার। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পুলিশ অভিবাসী বা কালো মানুষদের ওপর যতটা খড়গহস্ত, সাদাদের ওপর তার দশ ভাগের এক ভাগও না। ১৯৬৫ সালে আমেরিকার ওয়াটস রায়টের পর পুলিশের ওপর সেদেশের প্রায় সব নাগরিক ক্ষেপে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে আমেরিকার লস-অ্যাঞ্জেলস এ পুলিশ কর্তৃক এক ব্যক্তিকে নির্মম অত্যাচারের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আমেরিকাজুড়ে তোলপাড় হয়। সারা পৃথিবীতে পুলিশের অত্যাচারের এমন লাখ লাখ উদাহরণ আছে।

 

সিরাজ সিকদার থেকে শুরু করে মেধাবী ছাত্র রুবেল হত্যা, বিমানের পার্সার নুরুজ্জামান হত্যা থেকে শুরু করে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র কাদেরের ওপর নির্যাতন (ছেলেটা বিসিএসে কোয়ালিফাই করেছে। তার জন্য শুভ কামনা) বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা রাব্বীকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কিংবা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে মেরে অজ্ঞান করে দেওয়া এদেশের পুলিশেরই কাজ! আর স্বাধীনতার পর থেকে পুলিশকে ক্রমাগত রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার আপাত শেষ পরিণতিটা এদেশের মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এ বিষয়ে বেশি কিছু না বলাই বোধ করি ভালো।

 

তবে পুলিশকে নিয়ে গল্প, উপন্যাস, নাটক আর সিনেমার যেন শেষ নেই। ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের যখন পুলিশ ছিলামযদি কেউ পড়েন তাহলে আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগের পুলিশি বাস্তবতা বুঝতে পারবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলে পুলিশ স্টোরি প্রচারিত হয়। কেউ নাম দেয় ক্রাইম পেট্রোল, কেউ দেয় অপরাধ গল্প, কেউ নাম দেয় সাবধান ইন্ডিয়া। পুলিশি গল্প যেন কখনওই শেষ হবে না। পুলিশকে নিয়ে কত সিনেমা যে তৈরি হয়েছে তারও কোনও হিসেব নেই। দেবতা অসুর, নায়ক ভিলেন কিংবা ভালো-মন্দের মতো প্রত্যেক ছবিতে থাকে খারাপ আর ভালো পুলিশের দ্বন্দ্ব। পুলিশ নিয়ে প্রায় সব ছবির গল্পও যেন একইরকম! শেষদৃশ্যে পুলিশের ছুটে আসা এবং চিরাচরিত সেই ডায়ালগ- আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না!

 

আছে হাজারও কৌতুক। পুলিশ নিয়ে আমেরিকার এক সময়কার জনপ্রিয় কৌতুক ছিল এমন- আগুন লেগেছে ফাস্টফুড শপে। দমকল বাহিনী এসেছে আগুন নেভাতে। পুলিশও এসেছে। আগুন নিভছে না দেখে এগিয়ে গেল পিটার। সে নিজেই ছয়জনকে আগুন থেকে উদ্ধার করলো। পুলিশ এসে গ্রেফতার করলো পিটারকেই। আশেপাশের লোকজন এসে জানতে চাইলো পিটারকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে? পুলিশ উত্তর দিলো- পিটার যাদের উদ্ধার করেছে তারা সবাই দমকল বাহিনীর কর্মী!

 

আছে লক্ষ-কোটি মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। যেমন- তিনজন মোটরসাইকেল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। গ্রিন রোডের মোড়ে তাদের থামালো পুলিশ। বললো- জানেন না তিনজন নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো নিষেধ? তিনজনের একজন উত্তর দিলো- স্যার আমরা জানতাম না। সোনারগাঁর মোড়ে আমাদের পুলিশ ধরেছিল, তখন জানলাম। এখন আমরা তিনজনের একজনকে মোটরসাইকেলে করে বাসায় রেখে আসতে যাচ্ছি!

 

পুলিশ নিয়ে এত কিছুর মিছিল হয়তো কখনওই বন্ধ হবে না। যতদিন যাবে পুলিশ হয়তো তত মানুষ কিংবা নাগরিক ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করবে। সবসময়েই বলার চেষ্টা করবে যে- পুলিশ মানুষের বন্ধু। তারপরও হয়তো বেশিরভাগ মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। খুব সাধারণ কোনও এক কাদেরকে আবারও হয়তো পুলিশ নির্যাতন করবে, হয়তো রাব্বীদের পকেটে ইয়াবা রেখে তাদের জেলে পাঠিয়ে দেবে। মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়ে কেউ হয়তো পুরোপুরি বা আংশিক পঙ্গু হয়ে যাবে। যে সরকারই আসুক সবাই হয়তো ক্ষমতার রক্ষাকবচ হিসেবে পুলিশের ডাণ্ডাটাকেই ব্যবহার করবে।

 

পুলিশের তাতে কিছু যাবে-আসবে না। আনুষ্ঠানিকতা আর বইয়ের পাতায় থাকবে একাত্তরের পচিশ মার্চ কালো রাতের সেই বীরত্বমূলক প্রতিরোধ গাঁথা। যে রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের অনেক সদস্য। প্রতিরোধের পর যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুরের পাড়ে তাদের দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

 

খুব জানতে ইচ্ছে করে এই পুকুরের পাড়ে এলে কিংবা রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতি সৌধের কাছে গেলে পুলিশ সদস্যদের বুক এখনও গর্বে ভরে ওঠে কিনা। তাদের বুকে পুরো বাংলাদেশ জেগে ওঠে কিনা।

 

পুলিশ বাহিনীর যেসব সদস্যদের বুকে জেগে ওঠে পুরোটা বাংলাদেশ তাদের সংখ্যা কত? শুধু তারাই পারেন পুলিশকে বদলে দিতে, বাংলাদেশটাকে বদলে দিতে!

 

 

বাংলা ট্রিবিউনে পূর্ব প্রকাশিত

 

১ Likes ০ Comments ০ Share ৪৮৯ Views

Comments (0)

  • - মাসুম বাদল

    খুব খুব ভাললাগা জানালাম,

    বড়ভাই... emoticons

    • - গোখরা নাগ

      খুব ভাল লাগল ভাই...!!! 

    - রচনা পারভিন

    দারুণ লেগেছে আপনার লেখা। লেখায় প্রাণ আছে। ভালো থাকবেন। 

    • - মেঘা নওশীন

      চমৎকার...!!!