Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

৯ বছর আগে

নুহাশপল্লী ভ্রমণ

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের নুহাশপল্লীর কথা কম বেশি সবারই জানা আছে । হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত বিভিন্ন নাটক ও টেলিফিল্মে নুহাশপল্লীর আকর্ষণীয় দৃশ্যগুলো দেখে তা সরাসরি দেখার বাসনা জেগেছিল মনে । যা ইতিমধ্যে পূরণ হল ! নুহাশপল্লী কর্তৃপক্ষ দর্শনার্থীদের জন্য কিছু নিয়মাবলী এবং দর্শনের কাল (মাস) নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন । যা সম্পর্কে পূর্বে অবগত হওয়া বাঞ্ছনীয় । অন্যথায় ভিতরে প্রবেশ করতে না পারার হতাশা নিয়ে নুহাশপল্লীর গেইট থেকে ফিরে আশা অসম্ভব কিছু নয় । ভাগ্যক্রমে সেই হতাশা থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছিলাম । প্রিয় পাঠক, আপনাদের যেন সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয় সে চেষ্টা করবো ।  

গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম । সেখানে নুহাশপল্লী ভ্রমণের পরিকল্পনাটি ব্যক্ত করার পর ভাতিজি তাসমিয়া ও বড় ভাবী বায়না ধরলো তাদেরকেও নিয়ে যেতে হবে । ছোট আপু শ্বশুরবাড়ী থেকে আগেই সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল । সেও বায়না ধরতে ভুল করলো না । অবশেষে ভ্রমণের মোট সদস্য হল ছয় জন । ছোট আপু, আপুর মেয়ে আমার একমাত্র ভাগ্নি রাইমা (বয়স ৬ মাস), বড় ভাবী (পটল ভাবী), ভাতিজি তাসমিয়া (৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে), ভাতিজা তামিম (নার্সারীতে পড়ে) এবং আমি ।  

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ইং সকাল ৯ টায় আমরা টঙ্গী থেকে রওনা হলাম । টঙ্গীর বাসিন্দা আমার বন্ধু সায়েম গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল । অফিস খোলা থাকার কারণে সে আমাদের সাথে যেতে পারে নি । আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে । প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পর আমরা হুতাপাড়া এসে পৌঁছি । হুতাপাড়া থেকে পশ্চিমে বাক নিয়েছে একটি শাখা রাস্তা । এই এবড়ো-খেবড়ো শাখা রাস্তা দিয়েই আমাদের গাড়ি চলতে থাকলো । আমি সাইনবোর্ড পড়ে অবগত হলাম, আমরা উপস্থিত হয়েছি গাজীপুর জেলার সদর উপজেলাস্থ পিরুজালী ইউনিয়নে । মনে বড় কষ্ট পেলাম, যে এলাকায় নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শায়িত রয়েছেন সে এলাকার নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে ।

আমরা পৌঁছে গেলাম নুহাশপল্লীর গেইট সম্মুখে । হুতাপাড়া থেকে নুহাশপল্লী পৌছাতে প্রায় ২৫ মিনিট সময় লেগেছিল । গেইটের সামনে খোলা আকাশের নিচে দুটো অস্থায়ী চায়ের দোকান । সেখানে ভাল মানের কোনো নাস্তা ছিল না । বন আর চা দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করলাম । একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয় । ইনটেক পানির বোতল কিনে আমরা পানি পান করার পর তেমন তৃপ্তি পেলাম না । কারণ দোকানে ফ্রিজ ছিল না । পানি ছিল গরম । দোকানদার আমাকে অনুরোধ করলেন মাটির পাত্রে রাখা তাদের এলাকার নলকূপের পানি একটু পান করে দেখার জন্য । তিনি জানালেন তাদের এলাকার এই পানি খুবই ঠাণ্ডা, তৃপ্তিদায়ক এবং আয়রনমুক্ত । আমি তাঁর অনুরোধে ঐ পানি পান করলাম । সত্যিই মন জুড়ানো তৃপ্তিদায়ক সে পানি ! দোকানদারের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তাকে বললাম, “চাচা জমি যা আছে রেখে দিন, এই এলাকায় হুমায়ূন আহমেদ শায়িত, এই এলাকার মাটি স্বর্ণের সমতুল্য হবে । জরাজীর্ণ এই এলাকায় একদিন বড় বড় আবাসিক হোটেলসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে । সেদিন আর দূরে নয়” ।

 

আমরা মাথাপিছু ২০০ টাকা দামে টিকেট কিনে নুহাশপল্লীর ভিতরে প্রবেশ করলাম । চারপাশে তাকিয়ে দেখি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ! গেইট দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশে চোখে পরলো একটি ভাস্কর্য । মা তার ছেলের হাতটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আর ছেলেটি তার আরেকটি হাত বাড়িয়ে কাকে যেন ডাকছে ! এর আরেকটু ডানে রয়েছে টাইলস করা সুইমিংপুল । তার পাড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল আকৃতির মনুষ্য কঙ্কালের মস্তক ।

 

সুইমিংপুলের পাশে একতালা একটি বাড়ি । এ বাড়িতেই থাকতেন হুমায়ূন আহমেদ । একটু সামনে এগুতেই বড় একটি দাবাঘর চোখে পরলো । রয়েছে বিশাল মাঠের মত খালি জায়গা যা সবুজ দুর্বা ঘাসের চাদরে ঢাকা । এর ঠিক মাঝ বরাবর বড় একটি গাছের ঢালের উপর নির্মাণ করা হয়েছে ছোট ছোট দুটি ঘর ! মাঠের (খালি স্থানটির) সর্ব বাঁয়ে পশ্চিম পাশে লিচু তলায় হুমায়ূন আহমেদের সমাধি আর সর্ব ডানে “বৃষ্টি বিলাস” নামক টিনের চালা ঘর । এতে অনেকগুলো বড় আকারের রুম রয়েছে । প্রত্যেক রুমে রাখা হয়েছে ২/৩ টি করে খাট । প্রতি রুমে আছে বাথরুম । দর্শনার্থীদের বিশ্রাম ও ফ্রেশ হওয়ার সুবিধার্থেই এ ব্যবস্থা । ভাবী আর ছোট আপু রেস্ট নিচ্ছিল । তাসমিয়া তামিম তখন গাছের উপর নির্মাণ করা ঘরে উঠা নিয়ে ব্যস্ত । আমি বৃষ্টি বিলাসের বারান্দায় রাখা সোফায় এসে বসলাম । সেখানে দেখা মিললো নুহাশপল্লীর কেয়ারটেকার ফজলু চাচার সাথে । তাঁর কাছে আমার পরিচয় পেশ করলাম । এরপর দু’জনে জমে উঠে আড্ডা । ফজলু চাচা আমাকে নুহাশপল্লী সম্পর্কে অনেক তথ্য দিলেন । এই লিখাটি শুরু করার পূর্বে এসকল তথ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুল সাহেবের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি । তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত আমাকে বিভিন্ন তথ্য নিশ্চিত করেন এবং আরোও কিছু নতুন তথ্য প্রদান করে সহযোগিতা করেন । তথ্যসমূহ প্রিয় পাঠকগণের জন্য তুলে ধরলাম ।  

 

ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই ৪ মাস পিকনিক দলের জন্য এবং এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য নুহাশপল্লী ভ্রমণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে । সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য মাথাপিছু টিকেটের মূল্য ২০০ টাকা । দশ বছরের কম বয়সীদের জন্য টিকেটের প্রয়োজন নেই । আর পিকনিক দলের ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা । সরকারী ছুটির দিন ৬০,০০০ (ষাট হাজার) টাকা । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) টাকা । সরকারী ছুটির দিন ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা । নির্ধারিত এই চার্জের বিনিময়ে ৩০০ (তিন’শ) জন প্রবেশ করতে পারবে । তিন’শ জনের অধিক হলে প্রতি ১০০ (একশত) জনের জন্য অতিরিক্ত ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা পরিশোধ করতে হবে । উল্লেখ্য, একদিনে একটি পিকনিক দলকেই বুকিং দেওয়া হয় । বুকিং থাকাকালীন অন্য কোন দল বা ব্যক্তি নুহাশপল্লীতে প্রবেশ করতে পারবে না । ভাগ্যক্রমে আমরা সেদিন প্রবেশ করতে পেরেছিলাম । কারণ, সেদিন কোন দলের বুকিং ছিল না । তা না হলে চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে নুহাশপল্লীর গেইট থেকেই ফিরে আসতে হতো । ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই ৪ মাস যেহেতু পিকনিক দলের জন্য নির্ধারিত সময়, তাই এসময়ের মধ্যে যেদিন কোন দলের অগ্রিম বুকিং থাকবে না শুধুমাত্র সেদিনই সাধারণ দর্শনার্থী প্রবেশের সুযোগ পাবে । পিকনিক দলের জন্য নুহাশপল্লীর অভ্যন্তরে রান্নার সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে । নির্ধারিত চার্জের বিনিময়ে সেগুলো ব্যবহার করা যায় । প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা নুহাশপল্লী ভ্রমণে যেতে ইচ্ছুক তাঁদের সুবিধার্থে সংগ্রহ করেছি নুহাশপল্লী কর্তৃপক্ষের মোবাইল নাম্বার ।    

মোঃ সাইফুল ইসলাম (বুলবুল)

ম্যানেজার, নুহাশপল্লী ।

মোবাইলঃ ০১৭১২-০৬০৯৭১, ০১৭৩৮-৭০৪০১০

 

ঢাকা অফিসঃ

পাপন খান- ০১৭২২-৪৩৭৮৮৩

 

ফজলু চাচা আরোও জানালেন, মোট ৪০ বিঘা জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে নুহাশপল্লী । এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন ১২ জন কর্মকর্তা/কর্মচারী । নুহাশপল্লী থেকে অর্জিত আয়ের পুরোটাই এর রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, এবং হুমায়ূন আহমেদ কর্তৃক নেত্রকোনার কুতুবপুরে প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এর যাবতীয় খরচ মেটানোর জন্য ব্যয় করা হয় । দর্শনার্থীরা সকাল ৮ টা থেকে মাগরিবের আযান পর্যন্ত নুহাশপল্লীতে অবস্থান করতে পারে । যেহেতু নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ শায়িত আছেন, তাই সেখানকার ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার্থে উচ্চস্বরে মিউজিক সিস্টেম বা শব্দযন্ত্র বাজানো নিষেধ ।  

 

ভাবী আর ছোট আপুর রেস্ট নেওয়া শেষ হল । ফজলু চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নুহাশপল্লীর বাকি অংশ দেখতে বের হলাম । গাছের ঢালের উপর নির্মিত ঘরে উঠে ভিন্ন এক অনুভূতি গ্রহণ করতে ভুল হল না ।

 হুমায়ূন আহমেদ তাঁর স্বপ্নের ক্যানভাসে আঁকা ছবির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নুহাশপল্লীতে। সাজিয়েছেন নানান প্রজাতির জীবের ভাস্কর্য দিয়ে । নুহাশপল্লীর প্রতিটি স্থান এতোই চমৎকার ভাবে সাজানো হয়েছে যে, বড় ভাবী-আপু-তাসমিয়া-তামিম এলোমেলো ভাবে ছুটোছুটি করা শুরু করলো । ধৈর্য হারা হয়ে পরলো; কোনটার আগে কোনটা দেখবে !

 

 

বড় ভাবী উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে ডাকতে লাগলো, “দেখ দেখ; দারুণ এক মৎস্যকন্যা” ! আমি ছুটে গিয়ে দেখি একটি জলাশয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে দারুণ একটি মৎস্যকন্যা ! আর তাকে গ্রাস করার জন্য হা করে আছে বিশাল এক রাক্ষস ! 

 

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ । নিজ হাতে রোপণ করেছেন শত শত বৃক্ষ । এদের মধ্যে ঔষধি বৃক্ষই বেশি । প্রত্যেকটি বৃক্ষের গাঁয়ে রয়েছে তার নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড । হঠাৎ চোখে পড়ে হুমায়ূন আহমেদের একটি ভাস্কর্য । অন্যদিন পরিবার হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা স্বরূপ এটি উপহার দিয়েছিল ।

 

 

এদিকে তাসমিয়া আর তামিম ব্যস্ত হয়ে পরেছে দোলনায় চড়া নিয়ে । ছোট বাচ্চার মত ভাবী আর আপুও যোগ দিল তাদের সাথে । আমি আর বাকি রইলাম না । শুরু করলাম দোলনায় চড়া । আমরা দেখতে পেলাম নুহাশপল্লীর এককোণে রয়েছে একটি টিনের ঘর, একটি মাটির গুদাম ঘর, আর একটি কবর । এগুলোর আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখি একটি একতালা বাড়ি, নাম “ভুত বিলাস” । আমাদের ধারনা শুটিং এ ব্যবহারের জন্য এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে । 

 

শৈল্পিকমনা হুমায়ূন আহমেদ “দিঘি লীলাবতী” নামক বিশাল দিঘির মাঝ বরাবর নির্মাণ করেছেন ছোট্ট একটি দ্বীপ । দ্বীপের উপর আবার বড় নারিকেল গাছ এবং বসার জন্য আছে বেঞ্চ ! কত চমৎকার ছিল তাঁর চিন্তা জগত !

 

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর হৃদয়ে কত সুন্দর স্বপ্ন লালন করতেন, স্বপ্নের ক্যানভাসে তিনি কত সুন্দর ছবি আঁকতেন এবং একজন মানুষ কতটা স্বপ্নবাজ হতে পারে এর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুহাশপল্লী !

 

শফিক সোহাগ

চট্টগ্রাম

shafiq_shohag@yahoo.com

১ Likes ১৫ Comments ০ Share ২৩৫৫ Views

Comments (15)

  • - নিষান দে

    ভাল লাগল.............

    • - মুন জারিন আলম

      আপাতত শুভেচ্ছা।পরে মন্তব্য।