আজ (০২-০২-২০১৬) সকাল ৮:১১ মিনিটে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একটা সংবাদ শিরোনাম পড়েই আঁতকে উঠলাম ! শিরোনামটি ছিল এরকম- “নবজাতককে ফেলে দেয়া হলো পাঁচতলা থেকে!”
পুরো সংবাদটি পড়ে যা বুঝলাম তাতে যিনি সেই ছেলে শিশুটিকে জন্ম দিয়েছেন তিনি একজন গৃহকর্মী । রাজধানীর বেইলি রোডের একটি পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলারই কোন এক ফ্ল্যাটে কাজ করতো সে ! পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সেখানকার এক কাপড়ের দোকানের কর্মী গতকাল (০১-০২-২০১৬) দুপুরে তার দোকানের উপর ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পান । দোকানের ছাঁদে গিয়ে তিনি দেখেন যে, রক্তাক্ত অবস্থায় একটি শিশু কাঁদছে । এ অবস্থায় তিনি তার দোকান মালিক ও পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে শিশুটিকে উদ্ধার করে মগবাজারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে । শিশুটির বাঁ পা ভেঙ্গে গেছে । দোকানের পাশের একটি পাঁচতলা ভবনে পুলিশ তল্লাশি করে পঞ্চম তলায় ওই শিশুর কিশোরী মাকে খুঁজে পায় যিনি এখন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । পুলিশি সূত্রে আরো জানা যায়, গতকাল সকালে ঐ ফ্ল্যাটেই অন্য এক গৃহকর্মীর সহায়তায় শিশুটির জন্ম হয় । ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই মেয়েটি শিশুটিকে ব্যাগে ভরে ঐ ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেয় । শিশুটিকে ফেলে দেয়ার কারণ হিসেবে মেয়েটি পুলিশের কাছে জানায় যে, তার ভগ্নিপতি তাকে ধর্ষণ করায় সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে । তাই ক্ষোভ, লজ্জা ও অভিমানে সে শিশুটিকে ফেলে দেয় ।
এমন করে রাস্তায়, রেল লাইনের বস্তিতে, ডাস্টবিনে কিংবা ঝোপঝাড়ে পড়ে থাকা কত নবজাতকের খবর প্রায়ই ভেসে আসে আমাদের কানে । এইতো কিছুদিন আগেই (১৫-০৯-২০১৫) শেওড়াপাড়ার পুরাতন বিমানবন্দর এলাকা থেকে কয়েকজন নারী কুকুরের মুখ থেকে উদ্ধার করলো এক শিশুকে যাকে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল সিমেন্টের বস্তায় করে । এতক্ষণে হয়তো সবাই চিনে গেছেন শিশুটিকে ?হে, শিশুটি আর কেউ নয়-ফাইজা (বিজয়িনী) !
দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধনের ভঙ্গুর অবস্থা, যান্ত্রিক মানসিকতা আর মানুষের পৈশাচিক সুখ লাভের মোহের বলি হয়ে এভাবেই একের পর এক নাম না জানা কত শিশু পৃথিবীতে আসছে আবার পরক্ষণেই নির্মমভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে তার কোন হিসেব নেই । সবাই তো আর ফাইজা কিংবা এই নবজাতকের মতো অলৌকিকভাবে বাঁচে না, বাঁচতে পারেও না ! যতটুকু জানি, পৃথিবীতে সন্তানের কাছে মা-ই সবচেয়ে আপন হয় । বিপরীতভাবে বললে- মায়ের কাছে তার সন্তান । একটা সন্তানের জন্য যে মা নীরবে ১০ মাস অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে, সে মা-ই সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর কি করে পারে নিজ হাতে সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে ?? নিজের পাপকর্মের ফল হিসেবে হোক কিংবা নিজের অসহায়ত্ব বা দুর্বলতার কারণেই হোক যদি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেই ফেলে তাকে মেরে ফেলতে হবে কেন ? নিশ্চয় অনেকে বলবেন- সমাজের ভয়ে, আত্মসম্মানের ভয়ে ! যদি তাই হয়, তবে অবৈধ সুখের মোহে তার সমাজের ভয় কোথায় ছিল ? কোথায় ছিল তখন আত্মসম্মান ? নিজের অসহায়ত্ব বা দুর্বলতার কারণে যদি কোন অনাচারের স্বীকার সে হয়েই থাকে তবে সেটা সমাজের সামনে উন্মোচন করে কেন প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি দাড় করানো হলো না ? এখানেও সেই আত্মসম্মান কিংবা সমাজের দোহাই দেবেন অনেকে ! কিন্তু এভাবে চুপ করে আর কতদিন ? সমাজ আর আত্মসম্মানের দোহাই দিয়ে আর কতদিন সহায়তা করা হবে সমাজের মানুষরূপী পশুদের ? নিশ্চুপ থেকে আর কতদিন মুখোশ পরা এ সব ভদ্রলোকদের সমাজে সম্মানের চোখে দেখতে মৌন সহায়তা দেয়া হবে ?? মুখোশ উন্মোচন ছাড়া এদের দমানোর আর কোন পথ কি খোলা আছে ???
এসব নিষ্পাপ শিশুর অকাল মৃত্যুতে আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের দায়ও নেহাত কম নয় ! একজন নারীর যে সামাজিক নিরাপত্তা দরকার তা কি নিশ্চিত করতে পেরেছে আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ? পারেনি ! আর পারেনি বলেই প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে শিরোনাম হয় নারীদের বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হবার খবর ! অবশ্য এসব ঘটনায় যে শুধু সমাজের পুরুষ, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রেরই দায় আছে এমন নয়, অনেক ক্ষেত্রে দায় আছে নারীদেরও ! পেছনে কারণ যাই থাক- একজন ‘মা’ কি করে পারে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখার সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে ? এরা কি সত্যিই মা ??
মাঝে মাঝে ভাবতেই অবাক লাগে যে- আমরা মানুষ ! আমরা নিজেদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে দাবী করি ! যদি তাই হয়, তাহলে নিজের পাপকর্ম কিংবা অসহায়ত্বের শাস্তি কেন পাবে এমন অবুঝ আর নিষ্পাপ শিশুরা ? কেন নিজের পাপকর্ম ঢাকার জন্য কিংবা সমাজের আড়াল করার জন্য প্রাণ যাবে ফাইজার মতো অগণিত নিষ্পাপ শিশুদের ? সুন্দর এই পৃথিবী কেন পৃথিবীর আলো দেখার সাথে সাথেই মৃত্যুকূপ হয়ে উঠবে এদের জন্য ? এই পৃথিবীতে আসার জন্য কি তাদের কোন রকমের কোন ভুমিকা ছিল ? তবে কেন পৃথিবীতে তাদের বেঁচে থাকার আর বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা থাকবে না ? এভাবে আর কতদিন এই নবজাতকের মতো করে নিজের ভুল আর অসহায়ত্বের দায়ে অবুঝ শিশুদের পৃথিবীর বাইরে ছিটকে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ? এ ব্যাপারে কি আমাদের সমাজ কোন ভূমিকাই রাখতে পারে না ? আমরা কি পারি না আমাদের এ সমাজটাকে শিশুদের জন্য আরো সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে ? শিশুদের এ অবস্থার জন্য দায়ী প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি দাড় করাতে ?
"..এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ অঙ্গীকার..."
সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই অঙ্গীকার কি আদৌ পূরণ করতে পারছি আমরা ???
Comments (2)
প্রণাম...