Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

নারী দিবসের চেতনা ও ভাবনা।

নৃ-তত্ত্ববিদদের গবেষণা ও আবিস্কারের বদৌলতে আমরা জানতে পারি, মনুষ্যজাতী গঠনের গোড়ার দিকে এবং একটি সময় পর্যন্ত মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এমনকি ধর্ম গঠনের শুরুর দিকে এবং একটি সময় পর্যন্ত নারী ঈশ্বরের প্রমাণ পাওয়া যায়। কেতাবী ধর্ম (ইহুদি, খ্রীষ্টান, মুসলিম) চালু হওয়ার পর নারীর দেখা মিলে পুরুষের অধস্তন হিসেবে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, এ্যাডম ও ঈভ (আদম ও হাওয়া) কে দিয়েই মনুষ্য জীবন শুরু হয়েছে নাকি মনুষ্য জীবনের এক পর্যায়ে এসে এ্যাডম-ঈভ এর ঘটনার বা কাহীনির উৎপত্তি হয়েছে? নাকি পুরুষ কর্তৃক নারীর যে অধস্তন অবস্থান তৈরী হয়েছে তাকে বৈধ ও যৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য এই ঘটনা বা কাহিনীর তৈরী হয়েছে? ঘটনা যাই হোক ঐ কাহিনীর মাধ্যামে যে নারীর অধস্তন অবস্থাকে চিরতরে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কেননা ঐ কাহিনী যুগে যুগে মানুষকে শিক্ষা দেয়, পুরুষের বাম পাজরের হাড় থেকে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে অতএব নারীর সৃষ্টি পুরুষ হতে, স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত, স্বামীর সেবাই স্ত্রীর পরম ধর্ম, পুরুষ সবসময় নারীর উপর কর্তৃত্ত্ব করবে, নারী থাকবে পর্দার ভিতরে, পুরুষ তার পছন্দমত নারী নির্বাচন ও ভোগ করবে, নারী শষ্যক্ষেত্র স্বরুপ আর পুরুষ তার কৃষক তাই পুরুষ স্বামী বা মালিক, ইত্যাদি ইত্যাদি। আগে যেমন বিবাহ প্রথা ছিল না তেমনি ছিল না যৌনসঙ্গীর সীমাবদ্ধতা, ছিল বহুগামীতা। আধিপত্য বিস্তারকারী পুরুষ সম্পদ বন্টণের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ধোয়া তুলে নারীকে একগামীতায় বাধ্য করে অথচ নিজেদের জন্য বহুগামীতার পথ সুমসৃণভাবে খোলা রাখে। আধুনিক যুগে এসেও পুরুষের বহুগামীতা বৈধ। এই বৈধতা যুগ যুগ ধরে জিইয়ে রাখতে পুরুষকে সহযোগিতা করে আসছে কেতাবী ধর্ম। তাই ভবিষ্যতেও এই ব্যবস্থা সুন্দরভাবেই বহাল থাকবে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারা যায়না তাদের যারা ধর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পুরুষ প্রজন্মের জন্য নারী দমনের এমন ডালা সাজিয়ে রেখে গেছেন। তবে উল্লেখ্য যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নারীকে কিছুটা হলেও উপরে টেনে এনেছেন। যেখানে নারীর বাঁচার অধিকারই ছিল না সেখানে তিনি বাঁচার অধিকার, মায়ের সম্মান এবং সম্পত্তির অংশীদার পর্যন্ত করেছেন। এটা সে সময়কালের জন্য নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবীদার। সবকিছুই কাল, স্থান ও প্রয়োজনভেদে সংশোধন সংযোজন বিয়োজন ও সময়াপযোগী করার প্রয়োজন দেখা দেয় এবং সময়ই তা বদলে নেয়। কিন্তু যে প্রেরিত পুরুষ নারীকে এতদুর উপরে টেনে আনলেন তিনিই আবার কিছু কড়া বিধি-নিষেধের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিলেন। নারী পুরো মানুষ হতে পারলো না, পুরুষের ভোগের বস্তু রমনী হিসেবে তার অবস্থান পাকাপোক্ত হলো। নারীরাও তা খুশিতে-অখুশিতে নিজের গলায় ঝুলিয়ে নিলেন অলংকার হিসেবে।

 

পুরুষের কাছে নারী মানুষ নয় শুধু শরীর সর্বস্ব পন্য মাত্র। কারো উপরে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে তার ফল ভাল বা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ভাল ফল পেতে হলে প্রয়োজন তার একটি তাত্বিক বিষয়। তাই নারীকে পর্দার আড়ালে ঘরকোণে করে রাখার জন্য তার উপরে আরোপ করা হয়েছে সতীত্ব। সতীত্বহীন নারীর সমাজে কোন অবস্থান নেই। তাই নারী সর্বদা তার সতীত্ব রক্ষার জন্য নিজেকে অদৃশ্য কারাগারে বন্ধী রাখে। গুটিয়ে রাখে সকলের থেকে। সতীত্বজ্ঞান তাকে সবসময় কুড়েকুড়ে খায়। নিজেকে বিকশিত করার চাইতে নিজেকে পর্দার আড়ালে, ঘরকোণের অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখতেই বেশী উদগ্রীব থাকে। যাতে কোনক্রমেই সতীত্ব চলে যেতে না পারে। কারণ বাইরে রয়েছে তার সতীত্ব হরণকারী পুরুষ। বাঘ-হরিণ খেলা, মন্ধ নয়?

 

আমি বলছি না যে নারী তার অবস্থার উন্নয়নের জন্য একদম নীরব। সময়ে সময়ে অনেক মহিয়সি নারী মুক্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম বিদ্রোহ করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদেরকে ডাইনী খ্যাতি দিয়ে হত্যা, পীড়ণ, দমন করেছে। নারী চেতনা ও বিপ্লবী আন্দোলনে ক্লারা, রোজা, আলেক্সান্ড্রাদের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। প্রথমে ১৮৫৭ সালে ও পরে ১৯০৮ সালে ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের বিরাট সফল বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। তার স্মরণে ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তজার্তিক নারী সম্মেলনে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন ক্লারা। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী এরপর থেকে প্রতি বছরই এই দিবসটি পালিত হচ্ছে।

 

বাঙ্গালী নারী আন্দোলনে পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত ১৯০৪ সালে যখন নারীপ্রশ্ন বাংলা ও ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সামাজিক চেতনার মধ্যে কোন স্থান করতে পারেনি, যখন ইউরোপেও নারী আন্দোলন মূলত ভোটাধিকারের আন্দোলনে সীমিত হয়ে আছে তখন মাত্র ২৪ বছর বয়সে সে ধর্মের সঙ্গে নারী অধস্তনতার সম্পর্ক নির্দেশ করেছেন দৃঢ়পত্যয়ী ভঙ্গিতে, অত্যন্ত স্বার্থকভাবে। ধর্মের প্রতি নারীবাদী এই দৃষ্টির নজির তখন সারা বিশ্বেই খুব বিরল। এই বিষয়টি তিনি লিখেছিলেন ‘আমাদের অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে। সামাজিক চাপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে লেখাটি পরে গ্রন্থভুক্ত হয়।

 

সেই বাদ দেয়া অংশটি এখনো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ: ‘যখনই কোন ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চুর্ণ হইয়াছে।… আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।… আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।…পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিংবা ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। …ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি পাইয়াছে সেইরূপ পয়গাম্বরদিগকে (অর্থাৎ ঈশ্বর প্রেরিত মহোদয়দিগকে) এবং দেবতাদিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায়!!’

‘তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছু নহে। মুণিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুণির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। …ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর প্রেরিত কিনা, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধহয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের অযথা প্রভূত্ব সহা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।…’

‘কেহ বলিতে পারেন যে, ‘তুমি সামাজিক কথা কহিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?’ তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভূত্ব করিতেছেন। তাই ‘ধর্ম’ লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম’ [রোকেয়া, কাদির ১৯৭৩, ১১-১৩]।* একশত বছর পূর্বে রোকেয়ার যে নারীমুক্তির চেতনা ছিল তা আধুনিক নারীদের মধ্যে শক্ত অবস্থানে নেই। তাদের মধ্যে যা প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায় তা হলো, পুরুষের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার অদম্য প্রতিযোগিতা।

 

বাজারে নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যত রকমের প্রসাধনী পন্য পাওয়া যায় তার চাহিদাও তেমনি অত্যাধিক। সেই পন্য ব্যাবহার করে নিজেকে উৎকৃষ্টমানের আকর্ষণীয় পন্য হিসেব তৈরী করে আবার ঐ পন্যের বিজ্ঞাপনেও পন্য সাজে। নিজেকে পন্য সাজানোর কাজে নারী যতটুকু সময় ব্যয় করে তার সামান্য অংশও যদি নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য ব্যয় করত তবে নারীমুক্তি আন্দোলন আরো অনেক বেশী বেগবান হতো, অন্তত এমন মুখ থুবরে পড়ে থাকতো না। উন্নতমানের পন্য হওয়ার প্রতিযোগিতা শিক্ষাক্ষেত্রেও বেশ লক্ষণীয়। বেশিরভাগ মেয়েদের স্কুল কলেজে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য বিয়ের বাজারে মূল্য বৃদ্ধি করা, ভাল স্বমী জোগাড় করা। আবার অনেকে মেধা থাকা সত্বেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায় না বিয়ে হতে সমস্যা হতে পারে বলে। পারিবারিক অবস্থানের উপর মেয়েদের শিক্ষা স্তর সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ আমাদের সমাজে বিবাহ হচ্ছে মেয়েদের একমাত্র লক্ষ্য। ভালো বিয়ে মানে নিশ্চিন্ত, থাকা খাওয়া নিরাপত্তার আর কোন ঝামেলা রইলো না। যাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, পরনির্ভরশীলতা অর্জণ। তাদের মুক্তি এত সহজে কিভাবে আশা করা যায়?

 

বর্তমানে নারী আন্দোলনের নামে কিছু উগ্রতা এবং আদিমকালের পোষাক পরিচ্ছেদ লক্ষ্য করা যায়। যা নারীমুক্তির সাথে আদৌ সামঞ্জস্য নয়। এহেন আচরণ নারী মুক্তিকে এগিয়ে না নিয়ে বরং কলুশিত করে। তাই নারীমুক্তির আন্দোলনকে তরান্বিত করার লক্ষে প্রয়োজন নিজেকে জানা এবং নিজেকে একজন মানুষ রূপে তৈরী করা। পরনির্ভরশীলতার ভাবনা বাদ দিয়ে আত্মনির্ভরশীলতাই হোক নারীমুক্তির প্রথম সোপান।

 

* নারী, পুরুষ ও সমাজ -আনু মুহাম্মদ

০ Likes ০ Comments ০ Share ৬৫৬ Views