Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ইফ্ফাত রুপন

৮ বছর আগে

ত্রিভুজ

হঠাৎ করেই বেশ সকালবেলা রাফিনের ঘুমটা ভেঙে গেল।

সকাল না বলে এখনের সময়টাকে ভোর বলাই চলে। সূর্য মাত্র উঠি উঠি করছে। এমনিতে রাফিনের বেশ ভালোই ঘুম হয়। সে প্রায় অনেকের কাছ থেকেই শুনেছে রাতে নাকি তাদের ভালো ঘুম হয় না। রাফিন তার ২৪ বছরের জীবনে এরকম কখনো অনুভব করে নি। রাতে তার বেশ ভালোই ঘুম হয়। তবে তার সমস্যাটা হয় সকালে। যখন কোন কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত থাকে কিংবা কোন কারণে তার ভীষণ মন খারাপ থাকে তাহলে বেশ সকালে তার ঘুম ভেঙে যায়। আজও সে যথেষ্ট চিন্তিত। চিন্তিত হবেই বা না কেন? আজ তার মা আসছে তাকে দেখতে।

মা প্রতি মাসেই একবার করে রাফিনকে দেখতে আসেন। রাফিন বার বার তার মাকে মানা করে বলে যে প্রতি মাসে তোদেখতে আসার দরকার নেই, তোমার যদি আমাকে দেখতে ইচ্ছা হয় তাহলে আমি যাব বাড়িতে। কিন্তু তার মা কোনদিনও তার কথা শুনে নি।

বাবা মারা যাবার পর থেকে তার মা ই তাদের সংসারটাকে আগলে ধরে রেখেছে। রাফিনের বাবা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। রাফিন মনে করার চেষ্টা করলো। এইতো আগামী মাসে বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। কতো বছর পূর্ণ হবে? প্রায় ১৮ বছর। হ্যাঁ ১৮ বছরি তো। অথচও রাফিনের এখনো মনে আছে সেদিনও তো সে বারান্দার রেলিং ধরে সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন বাবা আসবে? বাবা প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কিছু না কিছু রাফিনের জন্য নিয়ে আসতো। হঠাৎ করেই একদিন রাফিন বুঝতে পারলো যে তার আর কোনদিন সন্ধ্যাবেলা বাবার জন্য বারান্দার রেলিং ধরে আর অপেক্ষা করতে হবে না।

পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে যখন রাফিন ইউনিভার্সিটি লাইফ শেষ করলো তখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রথম সে উপলব্ধি করতে পারলো, তার জীবনটা নাহয় তার সৃষ্টিকর্তা তাকে দান করেছেন, কিন্তু সে এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে একমাত্র তার মার জন্যই।

রাফিন হাতমুখ ধুলো। ৮ টার দিকে মা এসে ঢাকা নামার কথা। ফোনে কথা বলে জানতে পারলো কিছুক্ষণ আগে বাস ফেরিঘাট পার হয়েছে। ঢাকা পৌঁছাতে আর সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা লাগার কথা। নাস্তা করে বের হবার সময় হঠাৎ মানিব্যাগটা নিতে গিয়ে রাফিন থমকে দাঁড়ালো। আজও তার এই মানিব্যাগ চেঞ্জ করা হয়ে উঠে নি। অথচ কি আশ্চর্য আজ থেকে প্রায় ২ বছর আগে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার দেয়া কোন কিছুই সে আর ব্যাবহার করবে না কিন্তু সব কিছু ফেলে দিলেও এই মানিব্যাগটি তার এতোটাই প্রিয় ছিল যে সে সেটা আর তখন ফেলে দিতে পারে নি। আজ ফেলে দিব কাল ফেলে দিব করে আজ প্রায় ২ বছর হয়ে গেল। আজও সে তার স্মৃতি সবসময় পকেটে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ যার দেয়া স্মৃতি সে হয়তো কোনদিনও এই কথা জানবে না। রাফিন মানিব্যাগটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বাস এসে পৌঁছালো সকাল ১০টায়। রাফিনকে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হোল না বাস স্ট্যান্ডে। মাকে নিয়ে সিএনজি করে রাওনা দিল তার বাসার উদ্দেশ্যে। নতুন মাত্র বাসাটা নিয়েছে সে। তবে তার মার অনেকগুলো অভিযোগের মধ্যে একটি হোল কেন সে এতো বড় একটা বাসায় একা থাকে। রাফিন শত চেষ্টা করেও তার মাকে বুঝাতে পারে নি কিছু। আজ ২ মাস হোল সে তার বাসায় একা থাকছে। রাফিনের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। খুব শিগগিরি তার সিঙ্গেল লাইফ থেকে ডাবল লাইফে যাবার সম্ভাবনা আছে। জীবনের এই সময়টাতে রাফিন কিছুদিন একটু একা থাকতে চায়। কেন থাকতে চায় তা সে নিজেও জানে না। হয়তোবা পুরনো স্মৃতিগুলো থেকে...... থাক...... তার আর এসব কিছু এখন আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না।

গাবতলী থেকে যখন সিএনজি মিরপুর ১০ এর মোড়ে এসে পৌঁছেছে তখনই মা বলে উঠলো, “তোর ঘরের জন্য টুকটাক কিছু জিনিস কিনতে হবে। এখন বাসায় যাব না। একবারে কেনাকাটা করে তারপরেই যাব।”

অগত্তা সিএনজি ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। রাফিন কখনো তার মার কথার অবাধ্য হয় নি।

ঘুরাঘুরি করতে করতে প্রায় দুটা বেজে গেল। এখন বাসায় যাবার পালা। রাফিনের বাসাটা কচুক্ষেতের দিকে। এপাশ থেকে রিকশা কিংবা সিএনজি নেবার কোন সুযোগ নেই তাই তাকে বাধ্য হয়ে মাকে নিয়ে ১০ নাম্বারের সেই বিখ্যাত ওভারব্রিজের উপর উঠতে হোল। নিতান্ত বিপদে না পরলে রাফিন এসব ওভারব্রিজের উপর উঠতে চায় না। ব্রিজ পার হয়ে যখন নিচে নামতে যাবে ঠিক তখনি সিঁড়ির গোঁড়ায় গিয়ে তার থমকে দাঁড়াতে হোল।

সিঁড়িতে সাদা শাড়ি পরে অবনী দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে বেশ বড় ধরণের একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ। ২ বছর আগে শেষবারের মতো অবনীকে দেখেছিল রাফিনকিন্তু গত ২ বছরে একবারের জন্য হলেও তার সাথে অবনীর কোথাও দেখা পর্যন্ত হয় নি। কিন্তু আজ এতো বছর পর হঠাৎ।

কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যাবি না?

মার কথায় সম্বিৎ ফিরে এল রাফিনের। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। নামার সময় দেখতে পেল অবনীও তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ব্রিজ থেকে নেমে সাথে সাথে রাফিন তার মানিব্যাগটি ফেলে দিল।



 

 

 

জানালায় হঠাৎ ঠক ঠক শব্দ শুনা গেলো

এতো রাতে তো কেউ বাসায় আসার কথা না। আর আসলেও জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ করবে না। তাহলে এলোটা কে? অবনী খুব সাবধানে পা টিপে টিপে বারান্দার দিকে রওনা হোল। বাসা ভর্তি এখন মানুষজন। কেউ টের পেয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

অবনী যা ভেবেছিলো তাই। বারান্দার রেলিং ধরে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। অবনী কতবার মানা করেছে তাকে যেন রাতে কখনো তাদের বাসায় না আসে কিন্তু তবুও আজ পর্যন্ত সে অবনীর কথা শুনে নি। এইতো সেদিনই মাত্র অবনীর সাথে মৃদুলের পরিচয় হয়েছিল। অথচ এরি মাঝে কতোটা সময় কেটে গেছে। অবনী মনে করতে চেষ্টা করলো। আজ প্রায় ২ বছর হবে হয়তো।

মৃদুলের সাথে অবনীর প্রথম পরিচয় পর্বটা একটু অদ্ভুতই ছিল। অবনী ক্লাস শেষ করে একদিন বাসায়ফিরছিল। প্রতিদিনই দুপুর বেলা তার ক্লাস শেষ হয়। দুপুরের এই সময়টা বেশ ভালো লাগে অবনীর। কেমন যেন একটা শুন্যতা বিরাজ করে চারদিকে তখন। সবকিছুই থাকে আশেপাশে, কর্মব্যস্ততা, মানুষজনের ছোটাছুটি কিন্তু তারপরও দুপুরের দিকে এই শহরটাকে কেমন যেন নিষ্প্রাণ বলে মনে হয় তার কাছেতখন এই শহরের রাস্তা ধরে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে তার।

সেদিনও অবনী তেমনি ক্লাস শেষ হবার পর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলঅবনী সবসময় একটি ছাতা ব্যবহার করে। রোদ বৃষ্টি যাই হোক না কেন ছাতা ছাড়া সে কখনো বাসা থেকে বের হয় না। সে প্রায়ই লক্ষ্য করে আশপাশের মানুষগুলো তার দিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেসেটা কি কারণে সে আজও তা বের করতে পারে নি।

হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডি লেকের পারে এসে থামল সে। পানি খাওয়া দরকার। তার বোতলের পানিও শেষ হয়ে গেছে। আশপাশে যখন সে তাকাচ্ছিল তখন হঠাৎ কোথা থেকে যেন হুট করে একটি ছেলে এসে অবনীর সামনে উপস্থিত হোল।

শুনুন আপনার সাথে একটু কথা ছিল।

অবনী বেশ ভরকে গেলো। কোন বখাটে ছেলে নয়তো? আশেপাশে মানুষজনও তেমন একটা নেই। তারপরও চোখমুখ শক্ত করে সে বলল,

হ্যাঁ বলুন।

আপনি আপনার ছাতাটা আর ব্যাবহার করবেন না।

আশ্চর্য। কেন?

ছেলেটি মাথা নিচু করে বলল, আমি প্রায় প্রতিদিনই আপনাকে দেখি। আমার বাসার ছাদ থেকে এই রোডের প্রায় সবটুকুই দেখা যায়।

অবনী মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। এই ছেলে প্রতিদিনই তাহলে তাকে ফলো করছেঅথচও একদিনের জন্য হলেও সে সেটা বুঝতে পারে নি।

আপনি কি আমাকে এই কথা বলার জন্য এসেছেন?

না।

তাহলে?

আমি আসলে বলতে চাচ্ছি আপনি আপনার ছাতাটা আর ব্যবহার করবেন না। ছাতার কারণে প্রায়ই আমি আপনার মুখ দেখতে পারি নাআপনি দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু আপনার ছাতাটার কারণে আপনার সৌন্দর্য অনেকাংশেই ঢাকা পরে যায়।

অবনীর কেন জানি তখন এই ছেলেটিকে বেশ ভালো লেগে গেলো। জীবনের খারাপ লাগাগুলো খুব আস্তে আস্তে আসে আর ভালো লাগাগুলো নাকি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। তেমনই কিছু একটা হবে হয়তো।

অবনী হালকা একটা হাসি দিয়ে ছেলেটিকে বলল, আপনি একটা কাজ করতে পারবেন?

হ্যাঁ বলুন।

আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন?

সেই ঘটনার পর কিভাবে যে আজ প্রায় ২ বছর কেটে গেছে তা অবনী কিংবা সেই ছেলেটি যার নাম মৃদুল তারা কখনোই টের পায় নি। একসাথে এতোটাই ভালো ছিল তারা যে সামনে কি বিপদ আসতে যাচ্ছে তার ব্যাপারে কখনও চিন্তা করার সময়ও পায় নি তারা। কিন্তু যখন হুট করে অবনীর বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেললেনতখন আর কিছু করার ছিল না তাদেরকাল অবনীর বিয়ে। এখন পর্যন্ত অবনীর সেই কথা বিশ্বাসই হচ্ছে না। অবনী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বলল,

কেন এসেছ?

মৃদুল কোন কথা না বলে তার পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজ অবনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কাল সকালে মিরপুর ব্রিজের উপরে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। বলেই আর কোন কথা না বলে মৃদুল নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।

অবনী কাগজটি না খুলে তার ব্যাগে রেখে দিল। সে তার বাবা মাকে কষ্ট দিতে পারবে না আবার মৃদুলকে ছাড়াও কিভাবে থাকবে সে?

পরদিন বেশ ভোরবেলা নিজের হালকা টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে অবনী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যাবার আগে তার বাবার পা ছুয়ে সালাম করতে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সাহস আর সে করতে পারলো না।

এতক্ষণে তো চলে আসার কথা কিন্তু এখনো কেন আসছে না মৃদুল, অবনী তা বুঝতে পারছে না। কাল রাতে সে যে কাগজটি দিয়েছিল তাতে নতুন একটি মোবাইল নাম্বার লিখা। নিশ্চয়ই মৃদুল তার সিম কার্ড চেঞ্জ করেছে। কিন্তু সেই নাম্বারটিও অবনী বন্ধ পাচ্ছে। প্রায় ১ ঘণ্টা হোল সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবনী সিঁড়ির গোড়ার দিকে এগিয়ে গেল। এখান থেকে নিচটা বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু সিঁড়ির কাছে গিয়েই রীতিমত থমকে দাঁড়াতে হোল অবনীকে।

সিঁড়ি বেয়ে রাফিন নিচে নেমে আসছে। তার সাথে তার মা। অবনীর হঠাৎ কেমন যেন মাথা ঘুরে উঠলো। গত ২ বছরে একদিনের জন্য হলেও তো অবনী তাকে দেখে নি তাহলে আজ কেন?

২ বছর আগে ঠিক এরকমই কোন একটা পরিস্থিতিতে অবনী রাফিনের হাত ছেড়ে দিয়েছিল। খুব কষ্ট হয়েছিল অবনীর। কিন্তু নিজের কথা চিন্তা করে রাফিনকে ছেড়ে চলে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে নি সে। রাফিন তাকে কিচ্ছু বলে নি। শুধু সে চলে আসার সময় তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমার দোষটা কোথায় সেটা অন্তত আমাকে বলে যাও”।

অবনী সেদিন রাফিনের প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় নি। কিংবা দিতে পারে নি।





 

 

আঙুল দিয়ে খট করে দরজার নিচের ছিটকিনিটা খুলে ফেলল মৃদুল।

মৃদুল অনেকদিন ধরেই এই কাজ করে আসছে। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরে তখন আস্তে করে উঠে গিয়ে দরজার নিচের ছিটকিনিটা বাহির থেকে লাগিয়ে বের হয়ে যায় সে। অবনীদের বাসার সামনে গিয়ে বারান্দার রেলিং ধরেদাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আবার চলে আসে। সে জানে অবনীর জন্য অনেক রিস্ক হয়ে যায় ব্যাপারটা কিন্তু তারপরও আজ পর্যন্ত কোন বিপদতো আর হয় নি। আর সামনে হবারও কোন সম্ভাবনা নেই।

মৃদুল বাসায় ঢুকে বেশ ব্যাস্ত হয়ে পরল। অনেক কাজ বাকি আছে তার। কাল অবনী হয়তো সারাজীবনের জন্য তার কাছে চলে আসবে। অবনীকে কোথায় নিয়ে রাখবে কি করবে কিছুই চিন্তা করে দেখে নি মৃদুল। আর চিন্তা করার সময়টাও পাবে কোথায় সে? অবনীর বাবা যে তার মেয়ের জন্য বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে এই কথা একটিবারের জন্য হলেও তার মেয়েকে ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেন নি তিনি। মৃদুল আর অবনীর ব্যাপারটা কোনভাবে জেনে ফেলেছিলেন তিনি। তাই বিয়ের ব্যাপারে কোন কথাই বলেননি তিনি অবনীর সাথে। মাত্র দুই দিন আগে হঠাৎ অবনী তার কাছে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল যে তাকে আজকে দেখতে এসেছিল, দেখতে এসে আংটি পরিয়ে গেছে তারা। পরশুদিন অবনীর বিয়ে।

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে ছিল মৃদুল। কিছুক্ষণ আগেও তো সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ করে এসব কি বলছে অবনী।

গত দুই দিন ধরে পাগলের মতো ছুটাছুটি করছে মৃদুল। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। বন্ধুবান্ধব প্রায় সবার সাথেই কথা বলে দেখেছে সে কিন্তু কেউই কোন সমাধান দিতে পারছে না তাকে। কেউ সাহায্যের জন্যও এগিয়ে আসছে না। অবনীকে নিয়ে কোথাও না কোথাও তো তারউঠতে হবে কিন্তু সেই মাথা গোজার জায়গাটুকুও এখনও পর্যন্ত ঠিক করতে পারে নি মৃদুল

মৃদুল পা টিপে টিপে বাবার রুমের কাছে গেল। বাবার ড্রয়ারের চাবিটা নিশ্চয়ই টেবিলের উপর রাখা আছে। অবনীর সাথে ঘুরতে যাওয়ার আগের রাতে কতবার বাবার ড্রয়ার থেকে এভাবে টাকা চুরি করেছে সে। বাবা একটিবারের জন্য হলেও বুঝতে পারেন নি। তবে কাল নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে তিনি অফিসে যাওয়ার সময় যখন তার ড্রয়ারে হাত দিবেন তখন ঠিকি বুঝতে পারবেন। কারণ আজ মৃদুল শুধু টাকা চুরি করবে না।

মৃদুল আস্তে করে চাপ দিয়ে ড্রয়ারটা খুলে ফেলল। টাকা পয়সা তেমন একটা নেই। তবে তার মার গয়না আছে কিছু সেখানে। এগুলোই তাদের এখন শেষ ভরসা। মৃদুলের বাবা একজন সামান্য সরকারী চাকরিজীবী। চার ভাই বোনের এই সংসারটিকে তিনি একা কিভাবে চালান তা আজ পর্যন্ত মৃদুল জানে না। কোনদিন জানতেও চায় নি। উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার পর বাবাকে না জানিয়েই সে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায় সেবাবার কাছে যখন সে টাকা চাইতে গিয়েছিল তখন তিনি একটি কথাও বলেন নি তাকেশুধুমাত্র শুন্য চোখে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে

মৃদুলের ভার্সিটি জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। পর পর তিন সেমিস্টার রেজাল্ট খারাপ করার কারণে তাকে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়া হয়। তার জীবনেরএই কঠিন সত্যটা তার বাবা মা আজও জানে না। জানে না অবনীও।

আজও সে প্রতি সেমিস্টারের শুরুর দিকে বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়। বাবা প্রতিবারই শুকনো মুখে তার হাতে টাকাগুলো তুলে দেনমৃদুলের বাবা তার ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনদিনওতার সাথে কথা বলেন নি। মৃদুল এটিকে এক দিক থেকে সুবিধাই বলে মনে করে। জীবনে কোনদিন তাকে কারো কাছে কোনকিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হয় নি। এমনকি নিজের বাবা মার কাছেও না।

মৃদুল টাকা পয়সা আর তার মার গয়না নিয়ে বাবার রুম থেকে বের হয়ে এলো। রাতের মধ্যে থাকার জন্য কোন একটা ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। অবনীকে নিয়ে পরে কি করবে কোথায় যাবে সে চিন্তা নাহয় পরে করা যাবে। ভোর হবার আগেই মৃদুল বাসা থেকে বের হয়ে পরল।

অবনীকে দেখা যাচ্ছে।

রীতিমত পরীর মতো লাগছে তাকে। সাদা শাড়ীতে বেশ মানিয়ে গেছে তাকে। ওভারব্রিজের সিঁড়ির রেলিং ধরে শুন্য দৃষ্টিতে বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে।

মৃদুল সামনে এগুতে চেয়েও আর এগুতে পারলো না। কি দরকার জেনেশুনে এই মেয়েটির জীবন নষ্ট করার। অবনী তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে আজ পর্যন্ত যা বলেছে অবনী তাই বিশ্বাস করেছে। অবনী এতোটাই সরল মনের মেয়ে যে কোনদিনও তার কোন কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলে নি। কিন্তু আজ, আজ কিভাবে এই মিথ্যাগুলো নিয়ে সে অবনীর সামনে যাবে?

মৃদুল আবার উপরে তাকাল। সিঁড়ি দিয়ে তার মতোই একটি ছেলে একজন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে নিচে নামছে। অবনী কোন একটা কারণে বেশ অস্বস্থি অনুভব করছে। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুল রাফিনকে চিনে না। জানেও না এই ব্যাপারে কিছু। অবনীও কিছুটা জিনিস মৃদুলের কাছ থেকে গোপন করে রেখেছে।

মৃদুল চলে আসার জন্য পা বাড়াল। অবনীকে দেয়ার মতো কিছুই নেই আজ তার কাছে। শুধু আছে কিছু মিথ্যা।

                                      

 

 

 

 

 

 

 

 

 

০ Likes ০ Comments ০ Share ৪৬৩ Views