Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তৃষিত হিয়া............

মা হওয়া একজন নারীর জন্য সম্মানের, এ এক অন্যরকম সুখ, আনন্দ, গর্ব। নিজের ভিতর অন্য একটা প্রানের অস্তিত্ব, সেটা আবার প্রিয় মানুষের, এ এক অপার্থিব অনুভূতি। তার জন্য অপেক্ষা করা, তার জন্য পুরো পৃথিবীটাকে সাজানো, তার জন্য বাঁচতে চাওয়া, তার জন্য কষ্ট করার সেও এক অপার সুখের অনুভূতি। তার জন্য অপেক্ষা করা, মিথিলা বাচ্চা খুব পছন্দ করে আর তাই বিয়ের প্রায় দুবছরের মাথায় ও বেবি নিয়ে নেয়। হাসান আর মিথিলা মিলে কত স্বপ্ন দেখছে কত উচ্ছাস, কতরকম পরিকল্পনা। মিথিলার উচ্ছাস টা সত্যি দেখার মত। মিথিলার এখন সারাদিন কাটে তার বাবুর সাথে কথা বলে। বেশ গল্প করে সে তার বাবুর সাথে। হাসানতো ফিরে সেই রাত নয়টায়। কতরকম কথা হয় মা মেয়ের। হ্যা মিথিলা মেয়ে চায়। হাসান খুব অবাক, বলে সব মেয়েরা ছেলে সন্তান চায় আর বাবারা মেয়ে সন্তান, আমার দেখা একমাত্র নারী তুমিই, যে মেয়ে সন্তান চায়। মিথিলা মুচকি হেসে হাসানের বুকে নাক ঘষে,  এটা তাদের প্রিয় একটা আদর। কিন্তু মিথিলা হাসানকে বলেনা কেন সে মেয়ে সন্তান চায়। হাসান কতবার জিজ্ঞেস করেছে, মিথিলা বারবারই বলে মেয়ে হউক পরে বলব।।

মিথিলা আর হাসানের বিয়েটা পারিবারিকভাবেই কিন্ত ওদের ভালবাসা দেখলে মনে হবে যে কতবছরের প্রেম ছিল। মিথিলার প্রতিহাসানের সীমাহীন প্রেম মিথিলাকে কখনোই বুঝতে দেয়নি সে অন্য একটা চেনা পৃথিবী, মা বাবা, ভাইবোন, প্রিয় বিছানা, ছাদ, বাগান সবকিছু ছেড়ে এসেছে।  হাসান সারাক্ষণ মিথিলাকে তার ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখে, নতুন সংসার, নতুন একটা পৃথিবী, অচেনা মানুষ সব কিছুই সহজ হয়েছে হাসানের জন্য। প্রতিটা মুহূর্ত হাসান তার পাশে আছে ছায়ার মত। মিথিলার নতুন বাসাটা ছোট হলেও বেশ গোছানো, ছোট ছোট দুটি ব্যলকনি, একটাতে আবার লতা পাতার বাহার। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলতে একেবারেই নেই। সাজানো ছিমছাম সংসার। হাসান অনেক হিসেবি, পরিশ্রমী ছেলে। ক্যারিয়ারে বেশ সফল, কদিন পরে নিজেই ফ্লাট কিনবে ভাবছে।

আজকের বিকেলটা কেমন যে অন্যরকম, স্নিগ্ধ একটা বাতাস বইছে বাইরে,ঘরের ভেতরটা বেশ আরামদায়ক উঞ্চতায় ভরে আসছে। এবারের ঢাকার শীতটা বরাবরের মতই জমেনি। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসতেই মিথিলার হঠাৎ করে বিয়ের রাতের কথা মনে পড়ে যায়। বিয়ের রাতে মিথিলা লাল উড়না মাথায় দিয়ে ড্রেসিংটেবিলে আয়নায় নিজেকে দেখছিল আর হাসান পিছন থেকে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে আর মিথিলা বলে, "বউ পছন্দ হয়েছে"? আর হাসান মুচকি,রোমান্টিক হেসে মিথিলার কাঁধে চুমু খায়। মিথিলার খুব ইচ্ছে, হাসান ওকে খুব রোমান্টিক একটা নামে ডাকুক কিন্তু লজ্জায় বলতে পারে না। ড্রেসিংটেবিলের একটা কোনায় কালকের বেলীর মালাটা এখনও ঝুলে আছে। বেলী মিথিলার প্রিয় ফুল, তাই হাসান প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে এক গুচ্ছ বেলী এনে চুপচাপ ড্রেসিংটেবিলে  রেখে দিবে।
 
মিথিলা তার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে, তার সমস্ত চিন্তা,ভাবনা আর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আছে যে প্রাণ তার একটা নামও ঠিক করে ফেলেছে। কদিন ধরেই ভাবছে হাসানের সাথে শেয়ার করবে, আবার ভাবে হাসান যদি অন্য নাম ঠিক করে ফেলে তাহলে মিথিলা সেটাই রাখবে। কিন্ত যখন মা-মেয়ে একা থাকবে তখন "ওই" নামে ডাকবে। থাকনা একটু লোকচুরি থাক না মা-মেয়ের মধ্যে, কোন একগোপন প্রেমের মত। আজকাল শরীর ভাল থাকেনা মিথিলার, নানানরকম পরিবর্তন হচ্ছে,বেশ বমি হয়, একেবারেই খেতে ইচ্ছে করে না। হাসান প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় অনেক জোর করে আদর করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে যায়। ফল কেটে, দুধ গরম করে পাশেই রেখে যায়। খালা আসে দুবেলা। সেও বেশ খেয়াল রাখে মিথিলার প্রতি। কিন্ত পুরোদুপুরটা মিথিলার একা, একদম একা কাটে, শুধু হাসান বার বার ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় খেয়েছে কিনা। তাদের মেয়ে কি করে কেমন আছে, কি করছে। বাকি সময়টা মিথিলা মেয়ের সাথে কথা বলে, ছোট বেলার গল্প শোনায়,শোনায় তার কলেজ আর ইউনিভার্সিটির গল্প, তার বাবার সাথে তার বন্ধুতার গল্প, এমনকি তার বাবার বাড়ির ছাদটাও যে তার কত প্রিয় সেটাও। 

 এই মেয়ে নিয়ে হাসানের উচ্ছাস আর ভালবাসার কমতি নেই এতটুকু কিন্ত সেটার বহি:প্রকাশ নেই। হাসান অনেক চাপা স্বভাবের, জন্মের সময় মাকে হারিয়েছে, মায়ের আদর কি সে জানেনা। স্কুলে পড়ার সময় বাবাও তাকে ছেড়ে চলে যান। অনেক কষ্ট করেছে, নিসংগ হাসান জীবন যুদ্ধে একাই লড়েছে। নিজের আবেগ কিভাবে প্রকাশ করতে হয় তা ভুলেই গেছে। কিন্ত সে অনেক ভাগ্যবান মিথিলা তাকে বুঝে, আর দশটা বউয়ের মতশপিংএ যাবার, বাইরে খাবার কোন বাহানা নেই। খুবলক্ষী একটা বউ, হাসান ওকে "সোনাবউ" বলে ডাকে কিন্ত মনে মনে।  কিন্ত মিথিলা কেন বলছেনা, সে কেন মেয়ে চায় আর সবমেয়ের মত কেন ছেলে চায়না!  মিথিলা বলেছে, মেয়ে হবার পর বলবে। আজব ব্যাপার, সে ধরেই নিয়েছে মেয়ে হবে, যদি ছেলে হয় এই ভেবে হাসান কেঁপে উঠে। তখন কি মিথিলা খুব কষ্ট পাবে? নাহ, এটা হাসান ভাবতেই পারে না। সে খারাপ কিছু ভাববে না। অনেক অন্ধকারের পর তার জীবনে আলো এসেছে, মিথিলার মত মেয়েকে সে তার সোলমেট হিসিবে পেয়েছে। মিথিলাতাকে অনেক বুঝে। নাহ, সে আর পিছনে ফিরে তাকাবে না।

 তাদের ছুটির দিন গুলি কাটে মেয়ের জন্য শপিং করে,কতরকম খেলনা, রংবেরং এর কাপড়, দোলনা থেকে সবকিছু, কোনটাতো দিগুণ, তিনগুণ হয়ে গেছে কিন্ত ওদের শপিং শেষ হয়না। তাদের মেয়ের জন্য ঘরও সাজানো হচ্ছে। হাসান চেয়েছিল ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে রুমটা ডিজাইন করতে কিন্ত মিথিলা রাজী হয়নি। বলছে আমাদের ভালবাসার ফসল আসছে আমাদের জীবনে, এক অপার আনন্দ নিয়ে, আমরা কি তার জন্য এইটুকু করতে পারবনা। মিথিলা আস্তে আস্তে করে তাদের মেয়ের ঘর সাজায়। ছুটির দিনে হাসানও হাত লাগায়। দুজনে মিলে মনের মত করে তাদের মেয়ের ঘরটা সাজায় এত দিন যাছিল শুধু তাদের দুজনের। তাদের ঘর, তাদের জীবন পূর্ন করতে আসছে একনতুন প্রাণ,তাদের ভালবাসার চিনহ। দিন যেতে থাকে, মিথিলার শরীরের সেই প্রাণের স্পন্দন স্পষ্ট হতে থাকে। মেয়েটা এখন বেশ নড়াচড়া করে, মাঝরাতে হঠাৎ করে হাত পা ছুড়তে শুরু করে। মিথিলার সাথে হাসানের ও ঘুম ভেংগে যায়। দুজনে মিলে সেই স্বর্গীয় অনুভূতিটা উপভোগ করে। ওরা ডাক্তারকে বলতে নিষেধ করেছে যেন তাদের না বলে ছেলে না মেয়ে হবে। থাক কিছুটা উত্তেজনা, যদিও মিথিলার অগাধ বিশ্বাস তাদের মেয়ে হবে। 

 মিথিলা যে হাসানকে মায়ের আদর দিতে চায়। হাসান মায়ের আদর পায়নি। মেয়ে এসে তার জীবনটা পূর্ন করে দেবে। যেদিন তাদের মেয়ে হবে মিথিলা তাদের মেয়েকে হাসানের কোলে দিয়ে বলবে এই নাও " তোমার মা"। ও কত দিন দেখেছে, হাসান লুকিয়ে লুকিয়ে  তার মানিব্যাগ থেকে তার মায়ের ছবিটা বের করে দেখে আর কাঁদে। মিথিলা বড় পরিবারের মেয়ে, অনেক আনন্দ উচ্ছাসে আর আদরে বড় হয়েছে কিন্ত হাসান মায়ের আদর, বাবার আদর, পুরো একটা পরিবার বলতে কি বুঝায় জানেই না। অবশেষে সেই ক্ষণটি আসে, মিথিলা আর হাসানের অপেক্ষা ফুরায়। হাসান অফিসেই ছিল। পেইন শুরুহ বার সাথে সাথেই পাশের বাসার ভাবীকে ডেকে নিয়ে আসে খালা। সেই হাসানকে ফোন দেয়। হাসান এক মুহূর্ত দেরি করে না, আসার পথেই ক্লিনিকে ফোন দেয়। তাই সে পৌছার সাথে সাথেই এ্যাম্বুলেন্স পৌছে যায়। লেবার রুমে মিথিলা আর বাইরে হাসান উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় অস্থির। মিথিলার তেমন কোন জটিলতা ছিলনা প্রেগন্যান্সি নিয়ে, তেমন  কোন সমস্যা হবার কথাও না। কিন্ত কেন যেন হাসানের বুক কাঁপছে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। 

কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এসে বলল ইমার্জেন্সি ব্লাড লাগবে, হঠাত যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।  তা নিজের রক্ত ও নেগেটিভ গ্রুপ। রাত বাজে দশটা, এই শীতের রাতে দশটা মানে অনেক রাত। এত রাতে সে এখন বি নেগেটিভ ব্লাড কোথায় পাবে! সম্ভাব্য সব জায়গায় ফোন দেয়, কিন্ত কোথাও থেকে কোন সাড়া পায়  না। ডাক্তার এসে তাড়া দেয়, এখনই সার্জারি শুরু করতে হবে। না হলে মা ও বাচ্চা দুজনের জন্যই ক্ষতিকর। ক্লিনিকে মনে হচ্ছে আজ রুগী খুব কম,কেমন নীরব, নিস্তব্ধ, এক প্রচন্ড শুন্যতা অনুভব করে হাসান। পাশের ফ্লাটের ভাই ভাবী এগারটায় বাসায় ফিরে যান, কাল তাদের দুটাবাচ্চারই পরীক্ষা। ভাই নিজেও অনেক জায়গায় ছুটোছুটি করেছেন, ফোন দিয়েছেন রক্তের জন্য। হাসান ভাবে এই অনাগত সন্তান নিয়ে সন্তান নিয়ে তাদের এত স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস আর অপেক্ষা অথচ এরকম জরুরী একটা ব্যাপার অবহেলা করল ভেবে নিজেকে অপরাধী ভাবছে। আর মনেমনে বলছে কিচ্ছু হবেনা মিথিলার। মা-মেয়ে সুস্থই থাকবে।
 
হ্যা মেয়ে, মিথিলার অগাধ বিশ্বাস তাদের মেয়ে হবে। তার সোনাবউয়ের মেয়ে হবে। সে কথা দিয়েছে, মেয়ে কে কোলে দিয়ে হাসানকে বলবে কেন সে মেয়ে সন্তান চেয়েছে। হাসান মনে মনে ভাবেনা আর সেলুকাবে না, এবার থেকে মিথিলাকে সে "সোনাবউ” বলেই ডাকবে। তার সোনাবউ তার একাকী নিসংগ জীবনকে পূর্ন করেছে। সে আর সোনাবউকে ঠকাবে না। প্রায় মাঝরাতে কবরের নিস্তব্ধতাকে অতিক্রম করে সার্জারিরুমে লালবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে ডাক্তার আরও বেশি ভয়ানক এক বিষন্ন চেহারা নিয়ে বের হয়ে আসেন। নাহ, তারা মা মেয়ে কাউকেই বাঁচাতে পারেন নি। হ্যা, মিথিলার মেয়ে সন্তান হয়েছে। ওর বিশ্বাস মিথ্যে হয়নি।

তার মিথিলা, তার সোনাবউ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। তাদের সন্তান তাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না। তার মা, হ্যা হাসান মায়ের আদর পায়নি, তাই কতরাত মিথিলা ঘুমিয়ে গেলে সে তার অনাগত "মা" এর সাথে কত কথা  বলেছে  কতস্বপ্ন সাজিয়েছে। তার সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না। বিধাতা এত নিষ্টুর হতে পারেন না। হাসান পাগলের মত আচরন করছে দেখে ডাক্তাররা তাকে পাশের চেম্বারে নিয়ে বসান কিন্ত হাসান ছুটে বের হয়ে এসে লেবাররুমের সামনে কাঁদতে থাকে, সেইযে দিন বাবা মারা গেলেন তারপর হাসান একদিনও কাঁদেনি। আজ সে চিৎকার করে কাঁদছে, সোনাবউ বলে ডাকছে, মা বলে ডাকছে। কিন্ত বড্ড বেশি দেরী হয়ে গেল, বড্ড ভুল হয়ে গেল।

 

 

 

 

 

০ Likes ৪ Comments ০ Share ৭৮০ Views

Comments (4)

  • - গোখরা নাগ

    emoticons