মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী । তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক । আওয়ামীলীগের দলীয় নীতি ও কর্মসূচির অন্যতম মুখ্য প্রণেতা, দলের সকল মূল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচার বিমুখ সংগঠক ।
২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙ্গালীর উপর । শেখ মুজিবর রহমান সেচ্ছায় কারাবরণ করেন । সমগ্র নিপীড়িত জাতি হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন । এই ক্লান্তিকালে জাতিকে রক্ষার জন্য যিনি হাল ধরেন তিনি তাজউদ্দীন আহমদ । তাজউদ্দীন তাৎক্ষনিক দুটি সিদ্ধান্ত নিলেন । (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসাবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া । [সুত্রঃ মূলধারা ৭১]
৩ এপ্রিল রাত ১০ টায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদ সাক্ষাৎ করেন । তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নিকট মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার জন্য ভারতে আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এবং অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আহ্বান জানান । এছাড়াও দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরণার্থী ভারতে ঠাই নেবে, তাদের আশ্রয় ও আহারের ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানান । ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন ।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাফল্যজনক সাক্ষাতের আলোকে ভারতসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । অবশেষে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যারা ছায়া সরকারের কাজ করেছিল; তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে । ১০ এপ্রিল শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় । সেদিনই বাংলাদেশ সময় রাত ১০ টায় আকাশবানী কলকাতা রেডিও থেকে তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন । তাঁর এই ভাষণে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতভয় সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের কথা । ১৭ এপ্রিল নবগঠিত মন্ত্রীসভার প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদনাথতলায়, যার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর ।
দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানের পাশাপাশি তাজউদ্দীনকে যেমন প্রতিহত করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তেমনি আওয়ামীলীগের একাংশের ষড়যন্ত্র, অন্তর্কলহ ও কোন্দল । একপর্যায়ে শেখ মনির নেতৃত্বে গঠিত মুজিব বাহিনীর শীর্ষ এক নেতা এতটাই হিংসাত্মক ও মরিয়া হয়ে ওঠে যে সে তাজউদ্দীনকে হত্যারও প্রচেষ্টা চালায় । এসকল চতুরমুখি বাঁধা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে যান ।
পাকিস্তানের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করা ছাড়াও তাজউদ্দীনের কাছে আরেকটি বিষয় মুখ্য হয়ে উঠে তা হল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশিত সাফল্যের পর প্রতিহিংসা-হত্যার বিপদ থেকে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করা । ৩রা আগস্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, দেশদ্রোহিতার অপরাধে শীঘ্রই শেখ মুজিবের বিচার এবং উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা হবে । ২ অক্টোবর পাকিস্তানের সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে অপরাধী সাব্যস্ত করে ‘মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ’ করছে বলে একটি কূটনৈতিক সূত্রে প্রকাশ পায় । একই সূত্রে বলা হয়, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে সামরিক আদালতের এই রায় কার্যকর থেকে তাঁরা বিরত থাকবেন । অক্টোবরের শেষে ‘নিউজউইক’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে ইয়াহিয়া খান জানান, ‘শেখ মুজিবকে তিনি খেয়ালখুশি মত ছেড়ে দিতে অসমর্থ হলেও, জাতি যদি তাঁর মুক্তি চায় তবে ইয়াহিয়া তা পূরণ করবেন । কিন্তু বাংলাদেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত অভিযান শুরু করার পর পুনরায় শেখ মুজিবের জীবনাশঙ্কা দেখা দিতে পারে এমন উদ্বেগ ছিল তাজউদ্দীনের । পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর সামরিক জান্তাকে শেষ উন্মত্ততা থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে এমন নিশ্চয়তা ছিল না । এই আশংকা থেকে শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার নিশ্চিত উপায় উদ্ভাবন তাজউদ্দীনের প্রধান প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে ।
পূর্ণ বিজয়ের প্রাককালে শেখ মুজিবের মুক্তির পনমূল্য হিসেবে সাড়ে একানব্বই হাজার পাকিস্তানী বন্দী বাংলাদেশের করায়ত্তে । মুখ্যত শেখ মুজিবের মুক্তির পনমূল্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশের অবরুদ্ধ উপকুলভাগ দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর নিষ্ক্রমণ পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করা হয়েছিল । যদি উপকুলভাগে পাকিস্তানীদের পলায়ন পথ উন্মুক্ত রাখা হতো তাহলে ৭ ডিসেম্বর যশরে তাদের পতনের পর দক্ষিণ দিকে তাদের যেভাবে দৌড় শুরু হয়েছিল তার ফলে সম্ভবত ২/৩ দিনের মধ্যই সারা বাংলাদেশ খালি করে তারা পালিয়ে যেত । ফলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হত না, প্রাণহানিও কমতো । কাজেই অসামান্য দূরদর্শিতা, ঝুকি ও ত্যাগের বিনিময়ে শেখ মুজিবের এই মুক্তিপণ সংগৃহীত হয় ।
১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় লাভ করলো । নবজাত এই দেশকে পুনর্গঠন এবং অবকাঠামো পুনস্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ । তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ‘জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন । ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন । পরদিন ১১ জানুয়ারী তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবের সাথে একান্ত আলাপে বসেন । আলাপের বিষয় বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব পুননির্ধারণ । এতদিন সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন শেখ মুজিব আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ । কিন্তু পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কোন কার্যকরী ক্ষমতা নেই । সরকার পরিচালনার মূল দায়িত্বে শেখ মুজিব থাকবেন এটাই ছিল তাজউদ্দীন আহমদের ঐকান্তিক কামনা । শেখ মুজিবুর রহমানের নিজেরও এই বিষয়ে দ্বিমত ছিল না । তাই ১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাজউদ্দীনের নিকট তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন । ১১ জানুয়ারী একান্ত আলাপে তাজউদ্দীন শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান করেন । এসময় শেখ মুজিব প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেন । তাজউদ্দীন তখন জানান, পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আওয়ামীলীগের বাইশ বৎসরের দাবী সহসা বাতিল করে প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় ; কাজেই এদেশে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে হবে এবং সে গড়ে তোলার দায়িত্ব শেখ মুজিবকেই পালন করতে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ১৯৭০ সালে দেশবাসী বিপুল ভোটে সে রায়ই জ্ঞাপন করেছিল; মাঝখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করার পর দেশের সেই দুর্যোগকালে রাজনৈতিক কর্তব্যবোধ থেকে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন মাত্র । (সুত্রঃ মূলধারা ৭১)
এরপর ক্ষমতা নির্লোভী তাজউদ্দীন আহমদ সেচ্ছায় শেখ মুজিবের কাছে সর্ব ক্ষমতা হস্তান্তর করেন । পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পাট মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন । যে ক্ষমতা নির্লোভী আত্মপ্রচার বিমুখ সংগঠকতাজউদ্দীন আহমদের সুদৃঢ় নেতৃত্ব জাতিকে উপহার দিয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, জাতি কি পেরেছে সেই তাজউদ্দীনকে সঠিক মূল্যায়ন করতে ? যে তাজউদ্দীনকে স্পর্শ করতে পারেনি পাকিস্তানী হানাদারের বুলেট, সে তাজউদ্দীনকে কেন স্বাধীন বাংলার মাটিতে শহীদ হতে হল স্ব-জাতির বুলেটে ? প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল পালন করা হয় মুজিব নগর দিবস, অথচ মুজিব নগরের রূপকার তাজউদ্দীন আহমদকে ক’জন-ই-বা স্মরণ করেন ? তাজউদ্দীনের ত্যাগের প্রতি অমূল্যায়নের কারণে ধীরে ধীরে ইতিহাস থেকে মুছে যাচ্ছে তাঁর নাম !
মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিকে অম্লান রাখা জাতির কর্তব্য । তাই তাজউদ্দীন আহমদের নামে পদ্মাসেতুর নামকরণের জন্য আহ্বান করছি । এতে হয়তো জাতি কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত হবে ।
শফিক সোহাগ
আহ্বায়ক
তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ
Email: shafiq_shohag@yahoo.com
[তথ্যসুত্রঃ মূলধারা’৭১-মঈদুল হাসান, তাজউদ্দীন আহমদঃ নেতা ও পিতা-শারমিন আহমদ ]