Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শেহজাদ আমান

৯ বছর আগে

তসলিমা নাসরীনের দেশে ফেরা না ফেরাঃ প্রত্যাশা, বাস্তবতা ও একজন দ্বাদশ ব্যক্তি ’র কিছু বক্তব্য

( ১)
সেদিন ছিল ২৫ শে আগস্ট। আজ থেকে মাস দুয়েক আগের ঘটনা। তসলিমা নাসরীনকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া ও তার নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য শাহবাগে এক মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল ‘তসলিমা পক্ষ’। মানববন্ধন শেষ করে তসলিমা পক্ষের কর্মী ও তসলিমার সমর্থকেরা পরীবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে গিয়ে তসলিমা নাসরীনের জন্মদিন উদযাপন করেছিল। যেহেতু, তসলিমাকে দেশে আসতে দেয়ার দাবির প্রতি আমার সমর্থন আছে, তাই এই প্রোগ্রামে আমিও ছিলাম তাদের সাথে।




সেখানে কন্ঠশিল্পি শতাব্দী ভবও উপস্থিত ছিলেন। কেক কেটে জন্মদিন উদযাপনের পর সবাই ভব’দার কাছ থেকে গান শোনার আবদার করলো; তিনিও সবার পছন্দমত নিজের কিছু গান গেয়ে শোনালেন। সবার শেষে গাইলেন তার জনপ্রিয় গান ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’।

গানটা শোনার সময় বিভিন্ন কারণে আমার নিজেকেই দ্বাদশ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল এদের এই আয়োজনগুলোতে কেমন যেন একটা 'হলিস্টিক এপ্রোচের অভাব'। আর তার সাথে সাথে বাংলাদেশে তসলিমা নাসরীনের অনুসারী বা সমর্থকদের লাইফস্টাইলের সাথে আমার লাইফস্টাইলের পার্থক্যও আমার নিজেকে একজন দ্বাদশ ব্যাক্তি হিসেবে উপলব্ধি করাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এদের সাথে আর হয়তো এভাবে আমার সময় কাটানো নাও হতে পারে। তাই সঙ্গত কারনেই আমার নিজেকেই দ্বাদশ ব্যক্তির মত আউটসাইডার মনে হচ্ছিল; দ্বাদশ ব্যক্তি গানটা শুনতে শুনতে আমি যেন আরও বেশি আনমনা হয়ে উঠলাম।

তার কিছুদিন আগে তসলিমা নাসরীন আর আসিফ মহিউদ্দিনের একটা ভিডিও ছাড়া হয়েছিল; সেখানে দেখা যাচ্ছিল দুইজন নানান বিষয়ে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে তারা টেবিলের উপর কিছু বইয়ের উপর চায়ের কাপ রেখে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

পরে দেখা গেল, ওই বই আর কিছু নয় – মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান।

লাইফস্টাইলের বা আদর্শের পার্থক্য মানুষে মানুষে থাকতেই পারে। কিন্তু, তারপরও তসলিমা নাসরীনের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তার অনুসারীদের সাথে একই ইস্যুতে কাজ করতেও কোন সমস্যা হতনা। কিন্তু, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, এই ইস্যুতে তাদের সাথে যদি কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে নিকট ভবিষ্যতে, সাপোস, ফেসবুকেই স্ট্যাটাস দেই, তাহলে হয়তো তাদের বেশিরভাগের সাথেই আমার আর সম্পর্ক ভাল থাকবেনা। তাইতো, দ্বাদশ ব্যাক্তি গানটা যখন ভব’দা গাচ্ছিলেন, তখন আমার নিজেকেই দ্বাদশ ব্যাক্তি’র মত মনে হচ্ছিল।

তসলিমা ও আসিফের এই চা-পানি খাওয়ার বিষয়টা আমার কাছে স্পষ্টতই ভাল লাগে নাই। কারণ, স্পষ্টতই বুঝি, কোন ধর্মীয় গ্রন্থের হার্ডকপিকে খেলার জিনিস বা চায়ের কাপ রাখার পিরিচ বা স্ট্যান্ড বানানোর বিষয়টা কোন রুচিকর কাজের মধ্যে পড়েনা। একজন মানুষ নাস্তিক হতে পারে, বিভিন্ন ধরমগ্রন্থের ভুল-ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে পারে বা সমালোচনা করতে পারে অবশ্যই; কিন্তু যে ভিডিওচিত্র পাবলিকলি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, সেখানে এই ধরণের কাজ করা শুধু অরুচিকর, ছোট মনের পরিচায়কই নয়, বরং খুবই হাস্যকর এবং উস্কানী প্রদায়ক কাজও বটে।

এখানে আমার মনে হয়েছে, কোন ধর্মীয় উপসনালয় বা মূর্তিতে আঘাত করে সেটাকে ভেঙ্গে ফেলা যেমন বড় ধরণের একটা মানবতাবোধবিরোধী কাজ, তেমনি যদি নাস্তিকতাকে আমরা একটা ধর্ম হিসেবে দেখি, সেখানে নাস্তিক হয়ে অন্য ধর্মের গ্রন্থের উপর ময়লা ফেলা বা স্পষ্ট করে বলতে গেলে বারংবার চায়ের কাপ রেখেধীরে সুস্থে চা পান করাও একটা ছোটখাট মানবতাবোধবিরোধি বা শুভানুভূতি বিরুদ্ধ কাজ বলেই মনে হয়।

আর এই কাজটা উনি কখন করলেন? যখন অলরেডী তার দেশে ফেরার দাবির স্বপক্ষে বাংলাদেশে একটা ইভেন্ট কল করা হয়েছে, ঠিক সেই সময়টাতে।

ইভেন্টের আয়োজনের মীটিঙয়েও আমি বেশ কয়েকদিন ছিলাম। একদিন মিটিং শেষে সবাই মিলে যখন চা খাচ্ছিলাম, তখন আমি ভব’দাকে বললাম, “তসলিমাকে দেশে আসতে না দেওয়ার ব্যাপারটা নিতান্তই অমানবিক। কিন্তু, তসলিমা নাসরীনের কোরানের উপর চায়ের কাপ রেখে কথা বলার ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে নাই"।

তখন শতাব্দী ভবদা বললেন, “এটা করলেই ধর্মের অবমাননা হবে কেন, তা ভাবছেন কেন ? ইশ্বর তো আছেন মানুষের মনে। মন থেকে কে কিভাবে ব্যাপারটা দেখতেছে , সেটাই আসল ব্যাপার”।

তবে, শতাব্দী ভবদার কথার সাথে মনে হয়না বেশিরভাগ মানুষই একমত হবেন।

শুধু চায়ের কাপের ব্যাপারটাই এখানে শেষ কথা ছিলনা। চা খেতে খেতে তসলিমা আর আসিফ যেসব বিষয়ের উপর আলোচনা করছিলেন, তার মধ্যে ‘লিভ টুগেদার’ ছিল অন্যতম। তারা বলছিল যে, বিয়ের পরিবর্তে বাংলাদেশের মেয়েদের ‘লিভ টুগেদার’-কে বেছে নেয়া উচিত। লিভ টুগেদার রপ্ত করার জন্য তসলিমা বাংলাদেশের মেয়েদের পরামর্শও দেন।

কিন্তু, আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের সমাজে বিয়েটাই মানুষের কাছে এক অন্যরকম আবেদন নিয়ে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এটাকে মানুষ নতুন জীবনের শুরু বলে ধরে নেয়। দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়েরা বিয়ের আগে অনেকের সাথেই অনেক্রকম সম্পরকে জড়ায়; কিন্তু বিয়ের পর তারা সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে লক্ষি মেয়ের মত একনিষ্ঠভাবে সংসারের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ থাকে। বিয়ে নিয়ে বাঙ্গালী নারী-পুরুষ সবাই-ই নতুন করে স্বপ্ন দেখে – এক নতুন শুরুর, এক অভাবনীয় নতুন আস্বাদের।

এটা যে শুধু মুসলিম বাঙ্গালী নারীদের কাছে স্বপ্নময় এক ব্যাপার তা নয়, বাঙ্গালী মাত্র – সে খৃষ্টান হোক, বা হিন্দু হোক -- বিয়ের মর্যাদা আর মাহাত্ম্য তাদের কাছে অন্যরকম।

বিয়ে করে একজনকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া খৃষ্টানদের কাছেও মর্যাদার একটা ব্যাপার। মনে পড়ে যাচ্ছে স্যার ওয়ালটার স্কটের ‘তালিসমান’ বইয়ে পড়া নাইট অব দ্য স্লিপিং লেপার্ড এবং মরুভূমির গোত্রপ্রধানরুপি শিয়ারকফ ওরফে সুলতান সালাউদ্দিনের কথোপকথন,

“আমরা দাসদের মত কোন শৃঙ্খলে বাধা নই; আমরা চাইলেই একাধিক বিয়ে করতে পারি,” (শিয়ারকফের ওরফে সালাহউদ্দিনের উক্তি)

“বিয়েতো শুধু ভোগের জিনিস নয় আমাদের কাছে; আমাদের দেশে আসলে দেখতে পেতে কি করে আমরা একটা মাত্র মেয়েকে ভালবেসে সারাজীবন কাটিয়ে দেই”। (নাইট অব দ্য স্লিপিং লেপার্ডের উক্তি)।

শুধু মধ্যযুগেই নয়, এখনো ইউরোপ-আমেরিয়াকায় লিভ টুগেদারের চেয়ে বিয়ের প্রচলন অনেক বেশি। কাজেই, তসলিমা কেন বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে এমন একটা জিনিসকে ঢোকানোর কথা বলছেন, যেটা কিনা খোদ পাশ্চাত্যেই এখনো বহুল প্রচলিত নয়, বাংলাদেশ তো দূরের কথা!

ধর্মীয় অনেক জিনিসই দেখা যায় বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে সাযুজ্যপূরণ না; কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে তসলিমা কি বাঙ্গালী মেয়েদের ভিতর ‘লিভ টুগেদার’-এর বহুল প্রচলনের কথা বলে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হন নাই? তাও তিনি এটা করলেন তার দেশে আসার দাবির স্বপক্ষে যখন ইভেন্ট খোলা হয়েছে, তখনই...।

তাহলে কি তসলিমার নিজেরই হয়তো দেশে ফেরার ইচ্ছে নেই? মৌলবাদী ও দেশের প্রতিক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠী যেখানে তসলিমার দেশে আসার ন্যায্য দাবির ঘোর বিরোধী, সেখানে মৌলবাদীদের হাতে নতুন করে ইস্য তুলে দিয়ে তাদের আরও বেশি করে খেপিয়ে দেয়াটা কি কোন যুক্তিযুক্ত কাজের মধ্যে পড়ে?

(২)

বাংলাদেশে তসলিমা নাসরীনের যারা সমর্থক বা অনুসারী আছেন, তাদের সাথে আমাদের অনেকেরই লাইফস্টাইলে বা আদর্শের দিক দিয়ে না মিলতে পারে। কিন্তু, আর যাই হোক, বাংলাদেশের একজন নাগরিককে দেশে আসতে না দেয়াটা নিতান্তই অমানবিক একটা ব্যাপার। তার কাজকর্ম আমাদের অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু, তাকে দেশে আসতে দেবেনা এটা কেমন কথা? তাই, বাংলাদেশে তসলিমার অনুসারীদের সাথে জীবনধারা বা আদর্শে না মিললেও অনেকেই আছেন, যারা কিনা তসলিমাকে দেশে আসতে দেয়ার দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করবেন।

কিন্তু, তসলিমা যদি কোরানের উপর চায়ের কাপ রাখার ভিডিও প্রকাশ্যে পাবলিশ করেন আর বাংলাদেশের মেয়েদের ‘লিভ টুগেদার’ করতে প্ররোচণা দেন, অথবা এই ধরনের কাজ কন্টিনিউ করতে থাকেন, তাহলে তসলিমার প্রতি অনেকের সমর্থনটা কি ক্ষীয়মাণ হয়ে যাবেনা?

(৩)

উপরোক্ত ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার আপত্তির কথা তসলিমা নাসরীনের কিছু অনুসারীর সাথে আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম, যারা কিনা ২৫ শে আগস্টে মানববন্ধনে উপস্তিত ছিলেন। সেই পোস্টের সাথে তসলিমার অনুসারীরা, যারা বেশিরভাগই কিনা উগ্র নাস্তিক, তারা আমার সাথে একমত হন নাই। তাদের মধ্যে অন্নপূর্ণা দেবী, সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু, কোকিল ফারাবী নামক তিনজন আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্নপূর্ণা দেবী, সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু ও ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন আমাকে আনফ্রেন্ডই করেন নাই, ব্লক মেরে ধন্য করে দিয়েছেন। অথচ, তাদের সাথে আমার একটা ক্ষেত্রে মতভিন্নতা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। কোন রেষারেষী বা অনলাইনে ঘগড়াঝাটিও হয়নি, শুধু ভিন্নমত প্রকাশ করা ছাড়া।

তাহলে আসলে, বিষয়টা কি দাঁড়ালো?

আমি না হয় উগ্র নাস্তিকদের কাছে স্বাদশ ব্যক্তি; উগ্র আস্তিকদের কাছে নিশ্চয় আমি খুব পেয়ারা?

আসলে বিষয়টা তাও নয়। আমি উগ্র নাস্তিকদের উগ্রতা বা ভুল নীতির যেমন সমালোচনা করি, তেমনি উগ্র আস্তিকদের ভুলও তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। শুধু উগ্র আস্তিকদের পক্ষে থাকলে বা উগ্র নাস্তিকদের পক্ষে, তাহলে তাদের টিমে হয়ত আমি দারুণ পপুলার থাকতাম। আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে তারা লাইকে ভরিয়ে দিত। আমাকে উভয় জায়গাতেই দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে থাকতে হতনা। কিন্তু, সত্য তো এটাই যে ভাই, আমি উগ্র আস্তিকদের কাছেও একজন দ্বাদশ ব্যক্তিই বটে।

উগ্র আস্তিক ফারাবী শফিউর রহমান যখন তসলিমার লেখা প্রকাশের জন্য নইম নিজামের কল্লা ফেলে দেয়ার আহবান জানিয়ে তার সেই 'বিখ্যাত' স্ট্যাটাস দেয়, তখন সেই লেখার প্রতিবাদ করে আমি ভদ্র ভাষায় আমি বলেছিলাম, “ইসলাম প্রথম অবস্থায় দাওয়াকে গুরুত্ব দেয়। ভালো ব্যাবহার ও ভালৈবাসার মাধ্যমে মানুষকে শোধরানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়। দাওয়া না করে, সতপথে আসার আহবান চালিয়ে না গিয়ে নইম নিজামকে কতল করার আহবানের প্রতি একমত হতে পারলাম না। ফারাবী শফিউর রহমান ভাই, আশা করি বিষয়টা নিয়ে আরেকটু চিন্তাভাবনা করবেন।“

এটার স্বপক্ষে নিচে স্ক্রীণশটও হাজির করলামঃ




শুধু এটাই নয়, আমি সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি মৌলবাদীদের বাড়াবাড়ির সমালোচনা করে ‘Athiest’ বা নাস্তিক ট্যাগও খেতে হয়েছে (যদিও আমি নিজেকে একজন অজ্ঞেয়বাদী বা সংশয়বাদী বা আরও পরিস্কার করে বলতে গেলে 'অনুসন্ধানবাদী' মনে করি) :




আর তসলিমা নাসরীনের দেশে ফেরার দাবিকে সমর্থন জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাতাস দেয়ার পর আমার অনেক ভাই-ব্রাদারই আছেন, যারা বিষয়টাকে একেবারেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে। এক ছোট ভাই তো আমার উপর রাগ করে আমারে ফেসবুকে ব্লকই মেরে দিয়েছিলো।

তো, এসব দেখে পাঠকরা হয়তো এটাই বুঝতে পারতেছেন যে, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িউকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা আর হিংসা-বিদ্বেশের দিক দিয়ে উগ্র আস্তিক আর উগ্র নাস্তিকেরা দেখা যাচ্ছে একই লেভেলের। নাস্তিকেরা খালি কারও সাথে বিরোধ হলে আস্তিকদের মত তাদের জানে মারার হুমকি দেয়না। তাছাড়া বাকি সব দিক দিয়ে আমি তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখিনা।

আর যারা, তাদের মত উগ্র, প্রতিক্রিয়াশীল আর সাম্প্রদায়িক হবেন না, তাদের ঠাই হবেনা, আস্তিক, নাস্তিক – কারও দলেই। আমাদের তাই থাকতে হবে ‘ দ্বাদশ ব্যক্তি ’ হয়ে...!

(৪)

কয়েকদিন আগে আমি পল্টনে আমাদের অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনে দিয়ে একটা ছেলে হেটে যাচ্ছে; দেখে মনে হল এতো ফারাবী -- সেই ঠুতনীতে দাঁড়ি, সেই চশমা; কিন্তু আমি শিওর ছিলাম না। আমি ‘ফারাবী’ বলে ডাক দিলাম। দেখলাম ও ডাক শুনে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনিই তো শফিউর রহমান ফারাবী?’

সে বললো, “হ্যা”।

তারপর বললো, “আপনাকে চেনা চেনা লাগতেছে। কিন্তু ধরতে পারতেছিনা আপনি কে?’

আমি তখন আমার পরিচয় দিলাম। আমি বাংলাদেশে সমকামীতা আর উভয়কামীতার বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে একটা লেখা লিখেছিলাম, যেটা ফারাবীর মত ইসলামপন্থিরা আবার ভালই লাইক করেছিল। তখন থেকে ফারাবী আমাকে ভালভাবেই চেনে।

ফারাবী সেইদিন নিজে থেকেই তার বিস্তারিত বলা শুরু করলো। তার নাকি আগামীকাল কোর্টে হাজিরা আছে। তাই সে ধাকায় এসেছে। টুকটাক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার পর সে যখন আমার কাছ থেকে বিদায় নিবে, তখন আমি বললাম, “দেখেন ভাই, ইসলামে যে শুধু উগ্রতাই আছে, তা কিন্তু নয়; ইসলাম কিন্তু শান্তি আর ভালবাসার কথাও বলে"।

ফারাবীও স্বীকার করলো ব্যাপারটা। তারপর সে নিজে থেকেই বললো, “হ্যা ভাই, এখন থেকে আর কাউকে হুমকি-টুমকি দিবোনা"।

বিষয়টা আমার কাছে ভালই মনে হল, যাক এতদিনে ফারাবীর তাহলে সুমতি হচ্ছে।

তসলিমা নাসরীনকে দেশে আসতে দেয়ার দাবিতে যখন ইভেন্ট কল করা হল ফেসবুকে, তখন বাংলাদেশের উগ্র আস্ত্রিকদের পক্ষ থেকে যে এর বিরোধিতা করা শুরু হল এর অগ্রভাগে ছিল ফারাবী। কিন্তু, সেইদিন ফারাবীর সাথে যেদিন দেখা হল রাস্তায়, ওইদিন তাকে দেখে আমার কোন ভয়ংকর কিছু মনে হয়নি।

(৫)

মৌলবাদ বাংলাদেশে এমন একটা শক্তি এটাকে ডিনাই করে বা এটার সাথে জোর-জবরদস্তি করে বাংলাদেশে টিকে থাকা একটু কঠিন। এটাকে কৌশলে ট্যাকল দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রয়োজন হলে করা দরকার কিছুটা সমঝোতা; বড় কিছু পেতে হলে কখনো কখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোট হতে হয়।

আমার দেখা ‘ফিস্ট অব দা লিজেন্ড’ মুভির কথা না বলে পারছিনা। সেখানে নায়ক জেট লি’র চাইতে ভিলেন অনেকটাই শক্তিশালী ছিল। কিন্তু, নায়ক সেখানে শেষ পর্যন্ত ভিলেনকে হারিয়ে দেয়, কারণ সে ‘ভিলেনের’ মারামারির কৌশলগুলো নিজের মধ্যে ‘এডপ্ট’ করতে পেরেছিল। আমরা জিওগ্রাফী বা ডিসকভারি চ্যানেলে কিন্তু দেখি যে একজন স্নেক-ক্যাচার যখন একটা সাপ ধরে, তখন সে কিন্তু খুব ধীরস্থীরভাবে সেটা করে, যাতে সাপ ছোবল দেয়ার বা আক্রমণ করার ফুরসত বা সুযোগ না পায়।

কাজেই, আমার মনে হয়, তসলিমা নাসরীনের আদৌ দেশে ফেরা বা দেশে আসা সম্ভব নয়, যদি সে এই ধরণের সিলি উস্কানীমূলক কাজ চালিয়ে যায়; যদি বাঙ্গালির জীবনধারা বা সংস্কৃতির প্রতি উনার শ্রদ্ধা না থাকে। উনাকে দেশে ফিরে আসতে দেয়ার দাবিতে যত ইভেন্ট বা প্রোগ্রাম করা হোকনা কেন, বহিবিশ্বে সেটা প্রচার পাবে যে, তসলিমার দেশে ফেরার দাবিতে এতজন মানুষ বাংলাদেশে রাস্তায় দাড়িয়েছিল।

কিন্তু, কাজের কাজ আসলে কিছুই হবেনা। কারণ, খোদ বাংলাদেশেই এখনো অনেক মানুষ আছেন, যারা বিশ্বাস করে যে, তসলিমা নাসরীন নিজেই দেশে আসতে চাননা। একজন দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে আমি না হয় সেটা ভাবলাম না। এটা আমি স্পইষ্ট উপলব্ধি করতে পারি, কাউকে নিজের দেশে আসতে না দেয়াটা সেই ব্যক্তির জন্য কতটা কষ্টকর, সেই ব্যক্তির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে। নিজ দেশে ফিরতে না পারার যন্ত্রণা কেবল তারাই জানে যারা নিজ দেশে ফেরার অধিকার হারায়।

কিন্তু, এটাও বলতে চাই, সেইজন্য কাঙ্ক্ষিত অবস্থা বা পরিবেশ প্রথমে তসলিমা নাসরীনকে নিজেই তৈরি করতে হবে। সেই বিশ্বাসটা তসলিমা নাসরীনকে – নিজেকেও রাখতে হবে। আর মানুষের বদলানোর জন্য বা পরিবরতনের জন্য কোন বয়সই নিশ্চয় বেশি বয়স নয়।

শতাব্দী ভবদা তসলিমা নাসরীনিকে নিয়ে একটা গান তৈরি করেছিলেন ২৫ শে আগস্ট ইভেন্টের কয়েকদিন আগে । 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তসলিমা নাসরীন' নামে, যার কয়েকটি চরণ এইরকম,

"তুমি পুরুশতন্ত্র মৌলবাদের মুখোশে দিয়েছ টান
ঘুম পাড়ানির দেশে গাও ঘুম ভাঙ্গানির গান
তুমি কত সহজে জলের উপর আগুন জ্বালতে পার
উতল হাওয়ার দিনগুলোতেও বিবেকের কড়া নাড়।"

"শান্তির সংগ্রামে
বদলে দিতে দিন
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
তুমি তসলিমা নাসরীন।"

সন্দেহ নেই, শতাব্দী ভবদা খুব আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে গানটি গেয়েছেন। কিন্তু, তসলিমা নাসরীন কি সেই আবেগ আর ভালবাসার সত্যিকার মর্যাদা দিতে পারছেন বা পেরেছেন?

যাই হোক, একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তসলিমার প্রতি আমার শুভকামনা রইলো। আজ থেকে ১০-১৫ বছর পরে হলেও শাহবাগে দাঁড়িয়ে তসলিমা নাসরীনের সাথে এককাপ চা হলেও খেতে পারবো।

 

০ Likes ০ Comments ০ Share ৫৩২ Views

Comments (0)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    মালালা কি পেনো আর কি পেল না সেটা মাথা ঘামার দরকার নেই বলে মনে করি

    সুন্দর লেখেছেন ------

    • - মেঘ বলেছে যাব যাব

      ধন্যবাদ। পুরোটা নিশ্চয় পড়েছেন।

    - এম. এ. এস. মানিক

    কোথাকার কে শান্তিতে পেল না অশান্তিতে নোবেল সেটা নিয়ে মাথা ব্যথার কোন কারণ আছে কি? আমাদের দেশেরও একজন সম্মানীয় ব্যক্তি ড. মুহম্মদ ইউনুস শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন.......তা তিনি কোন শান্তিটা প্রতিষ্ঠা করেছেন? দেশের চেয়ে তিনি বিদেশীদের স্বার্থ বাস্তবায়নেই সচেষ্ট বেশি। তবে যেটুকু করেছেনা তা যে খুব একটা মন্দ সেটা বলা যাবেনা, কিন্তু অনেক কম করেছেন....দেশ প্রেম বলে একটা কথা আছে, সেটার নূন্যতম এখন কি তার মধ্যে আছে?

    =====================

    (((আলোতে থাকুন, ভালোতে থাকুন)))