Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাহমিনা রশিদ

৯ বছর আগে

ঝরে পরা বকুল

মেয়ের পরীক্ষা। অনেকদিন পর স্কুলে গেলাম। যেহুতু অল্প সময়, ভাবলাম কিছুক্ষণ বসে থেকে মেয়েকে নিয়েই বাসায় ফিরি।

 

মুখটা দেখলেই বুঝা যায়, এক কালে তিনি মার মার কাট কাট সুন্দরী ছিলেন। এককালে কেন বলছি, হয়ত বছর সাতে'ক আগেই ছিলেন। বিশাল ভুঁড়ি, দ্বিতীয় চিবুক থাকার পরেও তাঁর রুপের ঝলক চোখে পরে। আরেক টু সামনে যে মহিলাটি বসা, তাঁর চোখ দুটিতে বুদ্ধির ঝিলিক ঠিকরে বেরুচ্ছে। মায়াময় মুখের মেয়েটি একটু পর পর টিস্যু দিয়ে ঘামে ভেজা মুখ মুছে নিচ্ছে। একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম, এখানে বসে থাকা মহিলাদের বয়স ২৫ থকে ৩৫ এর মধ্যেই বেশি। কেউ তাঁর এক সন্তানকে স্কুলে দিয়েছেন বছর দুয়েক হল।দুজন, তিন জন সন্তান স্কুলে পড়ে এমন মা ও আছেন। যদিও সংখ্যায় তুলনা মুলক ভাবে কম।

তবে সবাই মা। সবাই বসে আছেন ধানমণ্ডি লেকের গাছের ছায়ায় দল বেঁধে। সন্তানদের ছুটি হবার আগ পর্যন্ত এরা দল বেঁধে বসে থাকে। আড্ডা দেয়। খাওয়া দাওয়া করে, শপিং ও করে। এই মায়েদের জন্যই লেকের পাড়ে ছোট খাট এক মার্কেট জমে উঠেছে। স্কুল ছুটি হবার সাথে সাথেই মার্কেট ও ছুটি।

 

কি পাওয়া যায়না এখানে! জামা, জুতা, চুড়ি, আংটি, গয়না, ক্লিপ ব্যান্ড , গেঞ্জি, মোজা, ট্রাউজার, ব্যাডকভার ,হাড়িপাতিল, সব ধরনের সবজি, গরম মশলা, ফল, দুধ, পোলাওয়ের চাল, আচাড়, হজমি, ফুচকা, সিঙ্গাড়াচা, সেন্ডউইচ, সিগারেট, পিঠা, মুড়ি, পরোটা, ভাজি, ডিম, আর ও কত কি।

ডাইবেটিস পরীক্ষা করার ডাক্তার, মিনি পোর্টেবল জিম। সব আছে। খুঁজে দেখিনি। হয়ত বাঘের দুধ ও আছে।

মোট কথা সে এক বিশাল আয়োজন।

 

হাসি, আড্ডায় উচ্ছল মায়েদের পাশাপাশি কিছু পুরুষ মানুষের ও দেখা পাওয়া যায়। কিছু হয়ত বাচ্চাদের বাবা (?) কিন্তু অনেকেই না।বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে লেকের পাড়ে বসে থাকা বাবার সংখ্যা নেহায়েত কমই হবার কথা। সবারই কাজ থাকে। থাকারই কথা। ব্যাবসা, চাকুরি,... সবাই ব্যস্ত।

তবে কিছু পুরুষ আছেন যারা অনেক স্বাস্থ্য সচেতন(?)। খুব করে লেকের পাড়ে দৌড়ানো শেষে তারা তেলে চুপ চুপ করে ভাজা ৬ টা পরোটা, মালাই চিনি দেয়া চা, ডিম ভাজি পরোটা খেয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করেন এবং লেকের পাড়ে বসে থাকা মায়েদের দিকে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। ব্যাতিক্রম ও আছে বৈকি ।লেকের পাড় সবার জন্য উন্মুক্ত। সুন্দর জায়গা। সকাল বেলা আরও সুন্দর লাগে। যে কেউ আসতে পারে। খামোখা কিছু লোকের জন্য সবাইকে কষ্ট না দেই…:P

ফিরে আসি মায়েদের কথায়। আমার বরাবরই  একটু নাক সিটকানো ভাব ছিল এই সব মায়েদের নিয়ে। যখনই তাদের পাশে বসেছি, শুনতে পেয়েছি

জানেন ভাবী, আমার বুয়াটা না একটা বদ, একদিন এলে আরেকদিন খবর নাই।

ও মা! কি সুন্দর! ভাবী, কানের দুল টা কত নিল?

ও ভাবী, আমার শাশুড়ি টা না কি যে দজ্জাল! জীবন টা ভাঁজা ভাঁজা করে ফেলল।

দেখেন ভাবী এই ডায়মন্ডের রিং টা ও কিনে দিয়েছে। ৫০ পরল। কি যে পাগল একটা!

ঝিলিক দেখেছিলেন কাল? আমি মিস করলাম।

 

ওদের নিয়ে আমার নাক সিটকানো সেই থেকে শুরু। শাড়ি, গয়না, স্বামী, বুয়া, শাশুড়ি, বড়জোর কোন এক রান্নার রেসিপি নিয়ে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক বক করতে পারে। কিভাবে পারে, ভেবে আসলেই অনেক অবাক হতাম।

স্কুলের এই দুই ঘণ্টা এদেরকে আমি বিভিন্ন রূপে দেখেছি। একদিন দেখলাম এক ভাবী বাসা থেকে জুস, খিচুরি,গরুর মাংস রান্না করে নিয়ে এসেছেন। সকালের আদ্দার ভাবীদের খাওয়া বেন বলে। সবাই মিলে গো গ্রাসে খাচ্ছে। কি আনন্দ! হাসি গুলো যেন কিশোরীদের হাসি। কেমন যেন খিল খিল শব্দ। অনেক অনেক প্রানবন্ত।

আজ অনেকদিন পর, অনেকদিন দিন পর আবারো আমি তাদের হাসি সুনলাম, দেখলাম। কিন্তু আজকের অনুভূতি একেবারেই ভিন্ন।

এই মায়েরা এই সময়টুকুতে সেই কিশোরী বেলায় ফিরে যায়। নিজেদের মত থাকে, আড্ডা দেয়,হাসে। মত কথা সংসারের ঘানি থেকে দুই ঘণ্টার মুক্তি। বুয়া, দারোয়ান, শাশুড়ি, রান্না কোন ঝামেলা নেই। শুধু নিজের জন্য সময়। বাসায় মন খারাপের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা। সংসারের বিরক্তি নিয়ে হাসি তামাশা। কুটনি শাশুড়ি দের পেট ভরে বকা ঝকা, নিজের জমানো টাকা থকে ইচ্ছেমত খরচ করা। ২৪ ঘণ্টা সংসারে সার্ভিস দেয়া এই মায়েরা নিজেদের এই দুই ঘণ্টা ভীষণ উপভোগ করে।

কৌতূহল নিয়ে দু চারজনকে পড়াশুনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানাল, ওরা সবাই মাস্টার্স করা। আমার তখন আরও একবার চমকানোর পালা। কেউ কেউ তো একাউন্তিং, ম্যাথ, ইকনমিক্স, ফিজিক্স এর মত খিটমিটে সাবজেক্টে প্রথম শ্রেণি তে স্নাতকোত্তর।

আমার কেন যেন মনে হত, এইখানে আড্ডা দেয়া মহিলারা বেশির ভাগ গ্রাজুয়েট ই না। কত বড় বেকুব হলে এই টাইপের চিন্তা করতে পারি, ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।

লজ্জা পর্যন্ত থাকলে বেঁচে যেতাম। বিষয়গুলো কষ্টে রুপ নিল যখন জানলাম পরিবার তথা বাচ্চাদের সময় দেয়ার জন্যই তিনি আজ নিজেকে হারিয়ে অমুকের মা…. অমুক ভাবী।

তাঁর পরিবার হয়ত ভেবেছে বাহিরে কিছু করার চাইতে বাচ্চাদের সময় দেয়া বেশি গুরুত্ত পূর্ণ। কিংবা তাঁর নিজের ই হয়ত মনে হয়েছে ক্যারিয়ার সামলে বাচ্চাকে ভালভাবে মানুষ করা সম্ভব না। কিংবা quality time and quantitive time ব্যাপারটা হয়ত তাঁর স্বামীকে বুঝানো যায়নি। কিংবা স্বামীর পরিবারকে। নিজের পরিবারের চাইতে ক্যারিয়ারকে বড় করে ভাববে। এই রকম মেয়ে বাংলাদেশে অন্তত দুর্লভ। সবার আগে পরিবার, মেয়েরা এই জেনেই বড় হয়। এই ধারনা তাদের রক্তে মিশে গেছে।

অথচ আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কি সুন্দর একটা ক্যারিয়ার থাকতে পারত এখানকার প্রতিটা মায়ের। অসামান্য মেধা যা শুধুমাত্র সন্তান লালন আর রান্নায় খরচ হচ্ছে, সে চাইলেই পারত তাঁর জন্য আনন্দময় অন্য একটা জগত খুঁজে নিতে। কর্পোরেট লেডি, ব্যাংকার, শিক্ষিকা, ব্যবসায়ি, যে কোন জায়গায় সে চাইলেই নিজেকে দেখতে পারত। তাঁর সে মেধা, যোগ্যতা সবই আছে, ছিল।

কেন এভাবে বেঁছে নিতে বলা হয়, ক্যারিয়ার কিংবা পরিবার? দু’য়ের একটাকে। কখনো কি কেউ শুনেছে ডান চোখ চাই নাকি বাম চোখ এমন প্রশ্ন? দুটো চোখে problem কোথায়?

এক সাথে পরিবার আর ক্যারিয়ার... থাক, একটু বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে।

কোন এক ভাবীকে জিগ্যেস করেছিলাম, এভাবে বুয়েত পাশ মেয়ে ক্যারিয়ার ছেড়ে এখানে লেকের পাড় কি করছে?

আড্ডায় ব্যস্ত ঝলমলে কাপড় পরা ভাবীর চোখগুলোতে একটু যেন বিষণ্ণতা উকি দিয়ে গেল। বড় একটা দীর্ঘ শ্বাস ও মনে হয় কানে বাজল।

নইলে কি সন্তান মানুষ হবে? বলেই হাসলেন। আরও জানালেন তাঁর মেয়ে বরাবরই ফার্স্ট হয়।

আপনার মতই মেধাবী হয়েছে, বলতেই একটু লজ্জা পেলেন।

আমার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়ে তিনি জানালেন তাঁর husband ও নাকি বুয়েট পাশ। ক্লাসমেট বিয়ে করেছেন। আর সবসময় তিনি তাঁর husband এর চেয়ে বেশি নাম্বার পেতেন।

বাহ! মেয়েত মেধাবী হবেই। বাবা মা ভীষণ মেধাবী যে।

ভাইয়া কি করেন?

ওর নিজের একটা ফার্ম আছে।

আমার কেন জানি কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল। উঠে চলে এলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে কয়েকটা কথা বলি। বলা হয়নি। যেই সাজানো সুখ নিয়ে তিনি আছেন, টা যদি নড়বড়ে হয়ে যায় সেই ভয়ে।

যা বলতে চেয়েও পারিনি-

 

মেয়েকে এভাবে সময় দেয়াতে মেয়ে যে একটা “জুয়েল” হয়ে উথবে তাতে সন্দেহ কি। সে অবশ্যই তাঁর মেধা দিয়ে জায়গা করে নিবে তাঁর বাবা মায়ের মতই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভালো রেজাল্ট নিয়েই বেরুবে।

ভাবী নিশ্চয় তা চাইবেন, চাইছেন। সে জন্যই তো তাঁর এত কষ্ট করা। নিজের ক্যারিয়ার ছেড়ে দেয়া।কিন্তু খেলা জমবে তখনই, যখন তাঁর এই “জুয়েল” মেয়ে আগামি ২৫ বছর পরে ঠিক এখানে তাঁর কন্যার জন্য অপেক্ষা করবে, তাঁর নিজের ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে।

একজন মা হিসেবে তাঁর তখন কেমন লাগবে, যে মেয়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলা, সেই মেয়ে যদি তাঁর মেয়ের জন্য নিজেকে হারায়। তাঁর মেয়ের জীবনটাও যদি তাঁর মতো হয়। সোনা দানায় মোড়ানো এক সংসারের গিন্নি।তিনি কি খুশি হবেন? তাঁর কি হবার কথা?

 

সব বাদ-

ভাবী আপনার নিজের মা কেমন আছেন? তিনি কি খুশি?

আপনার নিজের মেয়ের সুখ চাইতে গিয়ে আপনার মায়ের জীবন, সাধনাকে কি আপনি অসম্মান করলেন না?

 

কথা গুলো না বলে হয়ত ভালোই করেছি, কি বলেন???   

১ Likes ৫ Comments ০ Share ৬০৩ Views