ঝগড়া না তর্ক
পাশের ঘরে বাবা আর মা ঝগড়া করছে। উহু, ঝগড়া না তর্ক করছে। মা বলেছে, বাবা-মা ঝগড়া করে না। তর্ক করে। সেই তর্কের শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। বাড়তে বাড়তে আমার ঘরেও চলে এসেছে। আমি জানি শব্দের গতির চেয়ে আলোর গতি বেশি। কিন্তু এখন বাসায় বাবা-মার তর্কের শব্দের গতি অনেক বেশি। অবাক হওয়ার কিছু গতকালই মিস সায়েন্স পড়াতে যেয়ে শব্দের গতির চেয়ে আলোর গতি বেশি-এটা খুব ভালো করে বুঝিয়েছে। আমি জানি বাজ পড়ার শব্দের আগে বিদ্যুৎ চমকানোর আলো দেখা যায়।
সায়েন্স আমাকে বেশি বোঝানো লাগে না। আমি সায়েন্স ভাল বুঝি। আমি শুধু অংক কম বুঝি। তাই ক্লাসে ফার্স্ট হতে পারি না। প্রতি পরীক্ষায় একটা অংক ভুল হয়ে যায়। এইবার ফাইনাল পরীক্ষায়ও একটা অংক ভুল করেছি। মাকে বলিনি। বাবাকে বলেছি। বাবা বলেছে, ব্যাপার না। সবাই ফার্স্ট হলে নাকি ফার্স্টের মূল্য থাকবে না! আমার বাবা ছড়া লেখক তো। তাই অনেক মজার মজার কথা বলে।
ভাবছি বাবা-মার ঘরে ঢুকে পড়ব। তাহলে লজ্জা পাবে। আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে দুইজনই নিজেদের মধ্যে ভাব দেখাবে। ভান করবে যেন আড়ির কিছু হয় নি। কিন্তু আজ আমার ও ঘরে যাওয়া ঠিক হবে না। আজকের তর্কটা প্রয়োজন। আমার ভর্তি ফরম আনতে হবে যে। এই তর্ক না হলে কোন স্কুলে যাব তার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
মা বলেছে, আমার স্কুল এ বছর পাল্টাতে হবে। এই স্কুল ভাল না। মা বলেছে, আন-স্মার্ট স্কুল। এবার আমি স্মার্ট স্কুলে পড়ব। আমি অবশ্য অনেক স্মার্ট। বাবাই জোর করে আমাকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। তবুও আমি সায়েন্স আর ইংরেজি ভাল পারি। ক্লাস ফাইভের বইও আমি ডিসেম্বর মাসে অর্ধেক শেষ করে ফেলেছি। আমার দুইজন টিচার। করুণা মিস আর মা। করুণা মিস বিকালে দুই ঘন্টা পড়ায় আর মা সময় পেলেই পড়ায়। আগেই বলে রাখা ভাল, মার অনেক সময়।
বাবা এবার অনেক জোরে কথা বলছে। মার চেয়েও বেশি জোরে।
-তুমি সহজ জিনিসটা বুঝতে পারছ না কেন? এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গেলে তাহামনি সামলাতে পারবে না। দিলে আগেই দেওয়া যেত। এখন দেরি হয়ে গেছে।
-দেরিটা করল কে শুনি? দরকার নাই, দরকার নাই করে এই কয় বছর পার করলে।
-আরে বাদ দাও না। এখন ক্লাস ফাইভে উঠবে। অযথা বাচ্চাটাকে চাপ দেওয়া।
-বাদ দিব? মানুষের বাচ্চা দেখেছো? নিচতলার রুবিনা ভাবীর মেয়ে অনর্গল ইংরেজি বলে।
-আমার মেয়েও অনর্গল বাংলা বলে।
আমার হাসি পায়। আমি বাবা-মার তর্ক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মা বাবাকে তর্কে প্রতিবার হারায় ঠিকই কিন্তু সিদ্ধান্তে পারে না। বাবা একটা স্মার্ট মানুষ। আমার মতন। নাহ্ মা বলে আমি বাবার মতন!
এইবার মা রেগে গেছে। কারণ বাবা-মার ঘরের বাথরুমের দরজাটা বিকট শব্দে লাগানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। মা বেশি রেগে গেলে সব কাজে জোরে শব্দ করে। বাসাটা এখন নীরব হয়ে গেছে। বাবা আমার রুমে এসেছে। আমি যথারীতি টেবিলে বসে মিসের হোমওয়ার্ক করছি। আমার বাবা অনেক লম্বা। আমি বাবার অর্ধেক। আমিও বাবার মত লম্বা হব। বাবা হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-মা তুমি কি আমাদের উপর বিরক্ত?
-না বাবা, তর্ক আমার খারাপ লাগে না। ঝগড়া খারাপ লাগে। এটা কি ঝগড়া না তর্ক বাবা?
বাবা মিটিমিটি হাসছে।
-শেষ পর্যন্ত তো মনে হয় তর্কটা ঝগড়াই হল রে তাহামনি।
বাবা আমাকে কখনোই মুনতাহা ডাকে না। ডাকে তাহামনি। আবার ডাকে, তাহামনি-ঝুনঝুনি। আমার তখন খুব মজা লাগে। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে স্কুল থেকে আনতে যায়। তখন যদি বাবা রিফাতের সামনে তাহামনি-ঝুনঝুনি ডাকে তবে আমার লজ্জা লাগে। রিফাত খালি প্যারোডি করে তো। ক্লাসের সবাইকে নিয়ে ও ছড়া লিখে, প্যারোডি বানায়। টিকলি, প্রিয়ন্তী, স্পর্শী ঐসব ছড়া শুনলে এত রেগে যায়। আমি রাগি না। কারণ আমার বাবাও ছড়া লেখে। আমি সব সময় ছড়াই শুনি। তাছাড়া রিফাতের উপর আমার রাগ করা সম্ভব না। আমি রিফাতের সব কষ্টের কথা জানি। কারো এত কষ্টের কথা জানার পর তার উপর অযথা রাগ করা ঠিক না।
রিফাতের কষ্টের কথা রিফাত আমাকে বলেনি। রিফাতের মা আমার মাকে গত বছর মাঠে দাঁড়িয়ে বলছিল। আমি শুনে ফেলেছি। বড়দের কথা শোনা ঠিক না হলেও বড়রা সাবধানে কথা না বললে মাঝে মাঝে সে সব কথা শুনে ফেললে তাতে বোধহয় দোষ নেই। রিফাতের বাবা রিফাতের সাতদিন বয়সের সময় মারা গেছে। ওর বাবা নাকি বমি করতে করতেই মারা গেছে।
রিফাত ওর বাবাকে পেয়েছে সাতদিন। আর আমি পেয়েছি বারো বছর। এখনও বাবা আমার সাথে। সেই রিফাতের ওপর রাগ করলে আল্লাহ রাগ করবে। আমার অবশ্য রাগ কম। বাবারও রাগ কম। বাবার ভয়ও কম। তবে আমি কারো বমি করা ভয় পাই।
বাবা সেদিন রাতে ভাত খেতে খেতে উঠে যেয়ে বেসিনে একগাদা বমি করল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার বাবা মরে যাবে না তো! আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। বাবা আমার কান্না দেখে আমাকে কোলে নিয়ে ফেলল। ধ্যাত, আমি এখন কোলে নেওয়ার মতন ছোট আছি নাকি! তবু বাবা হঠাৎ করে কোলে নেয়। আমি না ও করি না। হ্যাঁ ও করি না। কারণ বাবা বলে, আমার তাহামনিকে খুব বেশিদিন আর কোলে নেওয়া যাবে না রে...আমার তাহামনিটা বড় হয়ে যাচ্ছে!
মা বলে, ন্যাকা। হুম। মাও মাঝে মাঝে ন্যাকামি করে। আমার যে গত মাসে জ্বর হল। একশ চার। আর মা রাত জেগে জেগে নিজেরও জ্বর বানিয়ে ফেলল।
বাবা ডায়নিং রুমে ঢুকে মার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করে,
-আজ বাজার লাগবে না?
বাবাকে অন্য শুক্রবার ঠেলেও বাজারে পাঠাতে পারে না মা। বাবা শুধু কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে। আজ তর্ক হওয়াতে বাবা মাকে খুশি করতে চাইছে। আমি বুঝে ফেলি। মাও বোধহয় বুঝে ফেলে তাই মা বাবার কথার উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। আমাদের বুয়া সাথীর মা আজ আসবে না। আমি জানি। বার্ষিক পরীক্ষার পর এখনো স্কুল বন্ধ তাই আমি এখন বাসার অনেক খবর জানি। আজ সারাদিন মার খুব মেজাজ খারাপ থাকবে। সাত সকালেই আবার তর্ক হয়ে গেল!
-বাজারে যাই। যা ইচ্ছা নিয়ে আসি আবার তখন রেগে যেও না কিন্তু।
বাবা দুষ্ট দুষ্ট হাসছে। মাকে রাগানো যত সোজা, বাবাকে রাগানো তত কঠিন।
-আসার সময় স্পোকেন ইংলিশ ভিসিডি নিয়ে আসব তাহামনির জন্য। আমাদের তাহামনি তা দেখে দেখে অনর্গল ইংরেজি বলা শিখবে।
মা রান্নাঘর থেকে এসে ডায়নিং টেবিলের ওপর বাজারের ব্যাগ আর স্লিপ রেখে যায়। মার চোখ মুখ থমথমে।
-তাহামনির মা টুম্পামনি, রাগ ঝেড়ে ফেল এখনই...
মা হেসে ফেলে। মার হাসি এত সুন্দর! পুরো ঘর যেন আলোয় ভরে যায়। এবার বুঝলাম আলোর গতি আসলেই বেশি! সায়েন্স আমি ভালই বুঝি।
মার হাসি মুখ দেখে আমি নিশ্চিন্ত হই। সত্যিই তাহলে ওটা তর্ক ছিল। ঝগড়া ছিল না।
(সময়কাল: ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩ খ্রিঃ, শিশুতোষ গল্প)
Comments (14)
আসসালামু আলাইকুম
আমি হাজির!
আসছেন, বসেন তারপর ভাল করে খাবার দেখেন।
খা্ওয়া যাবে না তাই কারটা ভালো হয়েছে তা বলা যাবে না।
খাওয়া যাবেনা তাই কিছু বলা যাবেনা, এইটা কেমন কথা