১ম পর্ব
আজ স্কুল থেকে আসার পরই জেসানের মনটা ভাল হয়ে গেল। সে এক জায়গায় ইমেইল পাঠিয়েছিল। আজকে তার রিপ্লাই এসেছে। সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না এটা সত্যি কিনা। যখন সে ব্যাপারটি পুরোপুরি সত্যি বলে মেনে নিল ঠিক তখন তার বাবার কথা মনে পড়ল।বাবা কি রাজি হবে? বাবা কিছুতেই রাজি হবে না, ভাবে জেসান। এ নিয়ে তার কিছুটা দুঃশ্চিন্তা হয়। তবু বাবাকে ফোন করে বসে সে। কবির রহমান বর্তমান বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। নতুন একটা প্রজেক্টের কাজে ভীষন ব্যস্ত তিনি। অবশ্য জেসান ফোন করার সময়ে তিনি তার অফিসেই ছিলেন। তিনি ফোন ধরলেন।
-হ্যালো?
-হ্যালো বাবা আমি জেসান।
-হ্যাঁ জেসান। কখন আসছ বাবা স্কুল থেকে?
-এইতো একটু আগে।
-দুপুরে ভাল করে খাইছো তো?
-জ্বি বাবা খাইছি।
-আচ্ছা তুমি বাসায় থাক। আমার আজকে আস্তে একটু দেরি হবে।
-বাবা?
-কি বাবা?
-ওরা আমার মেইলের রিপ্লাই দিছে।
-কিসের মেইল বাবা?
-ও! তোমাকে তো বলায় হয়নি। আমি জাদুর স্কুলে এ্যাডমিশনের জন্যে এ্যাপ্লাই করেছিলাম। ওরা তার উত্তর দিয়েছে। ওরা আমাকে পছন্দ করেছে।
রহমান সাহেব ছেলের উপর রেগে যান।
-তোমাকে বারন করেছিলাম না।ওখানে যেতে হবে না। বিজ্ঞানীর ছেলে হবে জাদুকর? অসম্ভব। তারচেয়ে এখানেই বিজ্ঞানের স্কুলে পড়বে। বড় হয়ে আমার মত বিজ্ঞানী হবে। জাদুবিদ্যা শিখে কাজ নেই।
-কিন্তু বাবা আমি যেতে চাই। আমি জাদুবিদ্যা শিখতে চাই।
রহমান সাহেব এবার রাগে ফেটে পড়েন।
-জেসান আর একটা কথা বলবে না। বিজ্ঞান বাদ দিয়ে জাদুবিদ্যা? ফাঁকিবাজি শিখবা? ধূ্র্তামি করে ব্যাড়াবা? অসম্ভব। ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে থাকলে আর কখনো এ বিষয়ে তুমি আর আমার সাথে কথা বলবা না।
ঝপ করে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখেন রহমান সাহেব। উনার এই এক সমস্যা। একটুতেই রেগে যান। কিন্তু কিছুক্ষন পর মন খারাপ লাগে তার। মা মরা ছেলে। এভাবে না বলে বুঝিয়ে বলতেও পারতেন। কে জানে হয়ত এখন বসে বসে কাঁদছে কিনা? ছেলেটার বয়সও তেমন বেশি নয়। মাত্র দশ।
জেসানকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা গিয়েছিলেন রহমান সাহেবের স্ত্রী জয়া। তারপর আর বিয়ে করেননি তিনি। দেখতে দেখতে দশটি বছর কেটে গিয়েছে।এতগুলো বছর কিভাবে যে কেটে গেলো জয়াকে ছাড়া, ভাবেন রহমান সাহেব। সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় জয়ার সাথে পরিচয়। তারপর প্রেম, ভালবাসা, বিয়ে। কি সুন্দর ছিল দিনগুলো। তখন থেকেই জয়ার একটা ছবি রহমান সাহেবের ম্যানিব্যাগে থাকেই। অবশ্য বিয়ের পর ছবিটি চেঞ্জ করে আরেকটি ছবি রেখেছিলেন। সেই ছবিটি এখনো তার ম্যানিবাগেই আছে। মাঝে মাঝে ছবিটি সামনে নিয়ে স্ত্রীর সাথে কথা বলেন তিনি। উনার বেশিরভাগ কথায় জয়ার প্রতি অভিযোগ ঝরে পড়ে। এখন সেই কাজটি করলেন। ম্যানিব্যাগ বের করে জয়ার ছবি বের করলেন।
-দেখেছো? তোমার ছেলের কান্ড দেখেছ?
-হুম। দেখেছি।
-তুমি কিছু বলবে না?
-কি বলব?
-ওকে বারন করবে না?
-না।
-কেন?
-কারন আমার ছেলে খুবই লক্ষী। আমি তো সারাদিন ওর সাথে সাথেই থাকি। মাঝে মাঝে তোমার কাছে আসি।
-তাতে কি? তাই বলে যা তা আবদার করে বসবে?
-ও তো যা তা আবদার করেনি। জাদুকর হতে চেয়েছে।
-জাদুকর না ছাই। সব ভাঁওতাবাজি। কখনো শুনেছ বিজ্ঞানীর ছেলে হয়েছে জাদুকর?
-তাতে কি? কেউ হয়নি তো কি হয়েছে? আমার ছেলে হবে।
-না। তার চেয়ে বিজ্ঞানী হোক। সারাজীবন আমার কাছেই রেখে দিব।
-তুমি শুধু নিজের কথা চিন্তা করছ।
এবার রহমান সাহেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
-হ্যাঁ। সব দোষ আমার। তোমাদের কোন দোষ নেই। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছ। এখন ছেলেটাও যাবে। ভাল। আমিও চলে যাব। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।
রহমান সাহেবের অফিসের পিয়ন পলাশ মিঞ্চা কিছুক্ষন থেকে দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছে। সে আগেও লক্ষ্য করেছে স্যার মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে একা একা কি যেন বলেন। সে খুব আশ্চর্য হয়। নক করে দরজায় এবং অনুমতির জন্যে অপেক্ষা না করেই ঢুকে পড়ে। দেখে রহমান সাহেব কাঁদছেন। সামনে একটা ছবি।
রহমান সাহেব পলাশ মিঞ্চার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কি ব্যাপার? অনুমতি নিয়ে ঢুকতে পার না?
-সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে। আর এরকম হবে না। আপনার জন্যে চা নিয়ে এসেছিলাম।
-রাখ। তারপর বিদায় হও।
পলাশ মিঞ্চা রুম থেকে বের হয়েই মুখ টিপে টিপে হাসতে থাকে। মনে মনে বলে, বুড়া মিঞ্চা বুড়ির জন্যে কাঁদে।
রহমান সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত আটটায়। ফিরেই দেখেন জেসান গুম হয়ে বসে আছে। তিনি কিছু বললেন না। খাবারের টেবিলে বসে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন,
-তুমি কি এখনো জাদুর স্কুলে যেতে চাও?
জেসান মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়। রহমান সাহেব মাথা নাড়েন। তিনি বুঝে গেলেন সামনের দিনগুলো তাকে একাই কাটাতে হবে।
পরের দিন সকালে জেসান যখন স্কুলের ব্যাগ নিয়ে স্কুল যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন রহমান সাহেব তাকে বারন করলেন। জেসান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে তিনি বললেন,
-চল তোমাকে জাদুর স্কুলে রেখে আসি।
জেসান লাফ দিয়ে উঠে।
-সত্যি বাবা।
-হ্যাঁ সত্যি। কখন যেতে হবে জান?
-হ্যাঁ। আজ বিকেল পাঁচটায়।
রহমান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আর জেসানের আনন্দ দেখে কে।সে জানত বাবা শেষ পর্যন্ত তাকে যেতে হবে। যতবার সে বায়না করেছে ততবারই বাবা শেষপর্যন্ত তা পূরণ করেছে। আসলে বাবা ওকে খুব ভালবাসেন। আর এ জন্যে কিছুটা মন খারাপ হয় তার। জাদুর স্কুলে গেলে পনের বছর আর বাবার সাথে দেখা হবে না। কারন এই পনের বছর সবসময় জাদুর স্কুলেই জেসানকে থাকতে হবে। বাইরের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। জেসান বাবাকে শক্ত করে ধরে রাখে।দুজনেই নিঃশব্দে চোখ মুছে।
রহমান সাহেব বিকেল পাঁচটায় ছেলেকে জাদুর স্কুলে রাখার জন্যে এসেছেন। কিন্তু জেসান যে জায়গায় তাকে নিয়ে এল সে জায়গাটা শহর থেকে একটু দূরে। মানুষজন কম এ এলাকায়।তাছাড়া বাড়িঘরও নেই বললেই চলে। কিন্তু যে বিষয়টা রহমান সাহেবকে আশ্চর্য করল সেটা হল এরকম একটা জায়গায় এরকম একটা অট্টালিকা থাকার কথা নয়। তাও আবার সেই প্রাচীন যুগের অট্টালিকা। যেন কোন রাজা বাদশাহর প্রাসাদ। তিনি খুব একটা বাইরে বের হোন না ঠিকই। কিন্তু এরকম একটা প্রাসাদ এখানে আছে অথচ তিনি একবারও জানতে পারলেন না।ব্যাপারটা অবাক করল তাকে।তিনি জেসানকে জিজ্ঞেস করলেন,
-বাবা তুমি ঠিক জান তো? এটাই কি জাদুর স্কুল?
-হ্যাঁ বাবা। ওদের মেইলে যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেটা এটাই।
-ঠিক আছে চল। কাছে গিয়ে দেখা যাক।
লম্বা একটা রাস্তা চলে গিয়েছে গেট থেকে। সম্পূর্ণ রাস্তায় মসৃণ কোন কার্পেট বিছানো। পা দিলেই নরম ঘাসে যেভাবে পা ডুবে যায় ঠিক সেরকমভাবে পা ডুবে যাচ্ছে। গেটের কাছেই দুইদিকে দুইটি সিংহের মূর্তি বসানো।দেখে মনে হয় একদম জীবন্ত আর কেমন মায়া মায়া চোখ। সিংঘের চোখ কি এরকম হয়? মাঝখানে গোলচত্বরে একটা ঝর্ণার ফোয়ারা। ঝর্ণার চারদিকে অসম্ভব সুন্দর কিছু ফুল ফুটে আছে। রহমান সাহেব কিছুতেই বুঝতে পারলেন না এগুলো কিসের ফুল। কিছুদূর গিয়েই হঠাৎ দেখলেন রাস্তার মাঝখানে পাঁচ ফিট মত জায়গায় পানি। একদম স্বচ্ছ নীল পানি। রহমান সাহেব ছেলের দিকে তাকান।বলেন,
-আয়। রাস্তার নিচ দিয়ে যাই।
কিন্তু জেসান বাবার হাত ধরে ফেলল। বলল,
-আমার মনে হয় পানির উপর দিয়ে যাওয়া যাবে।
-কি বলিস!
-হুম। এস আমার সাথে।
বলেই জেসান পানির উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে।অবাক কান্ড। জেসান দিব্যি পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটার সময় যেরকম একটু একটু করে পা ঢুবে যাচ্ছিল সেরকম একটু একটু করে পা ঢুবে যাচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য পানিতে পা একটুও ভিজছে না। রহমান সাহেব অবাক না হয়ে পারলেন না। থমকে দাঁড়িয়ে জেসানের হেঁটে যাওয়া দেখেন। কিছুটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। জেসানের পানির অন্যদিকে পৌঁছে বাবাকে ডাক দেয়।
-কই বাবা। আস।
রহমান সাহেব হাঁটা দেন ছেলের কথায়। কি আশ্চর্য পানিতে একটুও পা ভিজছে না। আরো কিছুদূর গিয়ে একটা অদ্ভূত গাছ দেখতে পান তিনি। অদ্ভূত গাছের সবকিছুই অদ্ভূত। পাতা দেখতেই একদম ফুলের মত আর ফলগুলো সত্যি অবাক করার মত। টুসটুসে লাল।জেসান বাবাকে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
-বাবা ঐ ফলগুলো হচ্ছে জাদুর ফল।
-তুমি কিভাবে জান?
-ওরা আমাকে একটা বুকলেট পাঠিয়েছিল। সেটা পড়ে জেনেছি।
রহমান সাহেব এবারো অবাক হোন।জেসান আবার বলে,
-জান বাবা এই ফল খেলে মানুষ কিছুক্ষন বাতাসে ভাসতে পারে।
-ধুর।তা কি করে সম্ভব?
-দাঁড়াও তোমাকে দেখায়।
জেসান টুপ করে একটা ফল পেড়ে খেয়ে নেই। কিছুক্ষন পরেই সে বাতাসে ভাসতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেক উপড়ে উঠে যায়। রহমান সাহেব ভয় পাওয়া গলায় ছেলেকে ডাক দেন।
-জেসান নেমে আস। নেমে আস বাবা। পড়ে যাবে কখন।
জেসান বাবার কথায় হাসতে হাসতে নিচে নেমে আসে। সে নিচে নেমে আসতেই রহমান সাহেব তাকে জড়িয়ে ধরেন।
Comments (11)
ভাল্লাছে আপু। বুনো সূতলির ভিড়ে হারিয়ে যেতে মন চায়
শুভেচ্ছা থাকল আপনার জন্য ।
আচ্ছা একই পোস্ট আগেও পড়েছি মনে হচ্ছে