.মাইশার বিয়ের বয়স হয়েছে। বেশ ভালো ভালো প্রস্তাবও আসছে। কিন্তু বিয়ে হই হবো করে করেও শেষ পর্যন্ত কোনটাই হয় না। মাইশার দোষ আছে যে তাও না। শিক্ষা-দীক্ষা দেখতে শুনতে আর পাঁচ জনের চেয়ে কোন অংশে কম না। আসল সমস্যা বোধহয় অন্যখানে। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন মাইশা। মা-বাবার শখের মেয়ে। দাদাবাড়ির দিকের একমাত্র নাতনী। সুতরাং সবার চোখের মনি। আদরের ধন। একে ভালো ঘরে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিতে না পারলে চলবে কি করে! তাই জাত, কাল, শিক্ষা, বংশ বাছতে বাছতে একমাত্র মেয়ে যে বুড়িয়ে যেতে চলেছে সেদিকে কারো খেয়াল নেই। ওদিকে পাড়া প্রতিবেশিরও ঘুম নেই। ঘটক খালি আশেপাশে ঘুরতেই থাকে। একমাত্র কইন্যার বিয়ে বলে কথা। মোটা অংকের দান মারা যাবে! তাই একটার পর একটা প্রস্তাব আসতেই থাকে।
সম্প্রতি একটা ভালো প্রস্তাব এসেছে। ছোট সংসার। শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিবার। বাবা মা বেঁচে নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছেলে সবার ছোট। বড় দু’ভাই সংসারী। এবং কারু ভরণপোষণের দায়ও নেই। এমন হাত পা ঝাড়া নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার ভাগ্য গুণে পাওয়া যায়। ছেলেপক্ষ এবং ছেলে মাইশাকে দেখে পছন্দ করেছে। মাইশারও অমত নাই। কিন্তু তবুও বিয়েটা হবার নয়। কেন? কারণ মাইশার ফুফি বিয়েতে রাজী নয়। কেননা ছেলের বাড়ি বরিশাল। বরিশালের লোক খুব ঘাউড়া। এখানে একমাত্র ভাস্তির বিয়ে দেয়া যাবে না। কিছুতেই না! জামাই মাইশার হাড়-হাড্ডি জ্বালিয়ে খাবে!
মাইশার বাবা-মা’রও এই প্রস্তাব খুব পছন্দ হয়েছে। তাই বোনকে ডেকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- তোর এত আপত্তি কিসের?
ফুফি রেগে বলে উঠলো- নতুন কইরা বলার কি আছে? তোমাগো জামাই যে বরিশালের! তা কি মনে নাই? সব ভুইলা গ্যাছো? সেই ঘটনাটা মনে নাই-তোমার ভাগ্নী রিফা যখন ছোট, অফিস থেকে ফিরাই জিজ্ঞেস করছে- মামণিকে ডিমটা সেদ্ধ কইরা খাওয়াইছিলা? আমি যেই বললাম- ওহ, না তো আজকে তো খাওয়াইতে ভুইলা গেছি কালকে খাওয়াবো নে! আর ওমনি ডিমটা ফ্রিজ থেকে বাইর কইরা জানালা দিয়া ফালায় দিলো! আমি ক্যান ভুইলা গ্যালাম সেইটাই আমার দোষ!
মাইশার বাবা হাত নেড়ে বোনকে বলেন- আরে বাদ দে না। সে না হয় রিফার বাবা একটু ঘাউড়া। তাই বইলা কি সবাই একই রকম হইবো? আর তাছাড়া তার অন্য গুণগুলা দেখিস না ক্যান? দেখা হইলেই কি সুন্দর সালাম দিয়া কথা বলে। সব সময় আমার খোঁজ খবর নেয়। টাকা পয়সার সমস্যায় পরলে কখনোই মুখ কালা করে না। মাঝেমাঝে তোকে পর্যন্ত জানতে দেয় না।
মাইশার ফুফি আবার কথা বলে উঠলো কিছুটা রাগ অভিমান ভরা উচ্চ কণ্ঠে- আর সারাদিন আমি ছেলে মেয়ে দুইটারে স্কুল থেকে আনা নেয়া করি। কোচিঙে দিয়া আসি নিয়া আসি। আমার কোন রেস্ট আছে? সংসারের দুনিয়ার কাজ-কর্ম করি। সেই ভোর বেলায় উঠি সকালের নাশতা বানাইতে। একই সাথে আবার অর অফিসে নেয়ার খাবারটাও তো আমাকেই রাইন্দা দিতে হয়। আমার তো আর বান্ধা বুয়া নাই। উনি আবার বাসায় ফিরা কই একটু বিশ্রাম দিবো তা না! সারাদিনে কি করলাম না করলাম তার দুনিয়ার ফিরিস্তি নেন। কোন কিছু গড়বড় অইলেই হয় ফালায় দিবো নয় নিজেই করতে লাগব। আবার এদিকে হইছে আরেক যন্ত্রণা!
মাইশার মা-বাবা দুজনেই উৎকণ্ঠা নিয়ে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলেন-কি হইছে? কি হইছে?
দু’জনের উৎকন্ঠা দেখে ফুফি এবার হেসে ফেললো। বললো-আর কইয়ো না! কি কমু, যেমন বাপ তেমন তার পোলা। রাকিব আর ওর বাবা প্রতিদিন রাতের খাওয়ার পরে মাছের কাটাকুটা, গোশতের হাড্ডি সিড়ি ঘরে কোণায় রাইখা দিতো। সেইটা বিড়ালে খাইতে আসতো। একদিন হাড় হাড্ডি দিছে-বিড়াল গন্ধ শুঁকে না খেয়ে চলে গেছে। সেদিন হাড্ডিগুলা একদম বেশি শুকনা আছিলো। রাকিব বলতেছিলো- ঝোল ছাড়া দিছো তো এইজন্যে খায় নাই। ওগুলারে মনে হয় রাইন্ধা দিলে খাইতো। ওমনি পোলার বাপে হৈ হৈ কইরা উঠলো- আরে তাইতো! দেখছো-তোমার পোলায় কি সুন্দর আইডিয়া দিছে? যেমন বলা তেমন কাজ! এখন আমার প্রতিদিনের কাজ হইছে মুরগীর চিকন হাড় হাড্ডি-মাছের কাঁটা সব খাওয়ার পরে জমা কইরা রাখো। তারপরে হেগুলিরে আবার মশলা দিয়া জ্বাল দেও। তারপরে বিড়ালরে খাওয়াও। সারা সিড়ি জুইড়া হাইগ্যা মুইত্যা বাড়ি-ঘর গান্দা বানায় রাখবো আর আমি ওইটার জন্য রানবো! আবার একটা প্লাস্টিকের চ্যাপটা বাটি রেডি করছে। ঐটাত কইরা দুধ দেয়। কয়- বিড়ালের পুষ্টির দরকার আছে না? যত্তসব! বরিশাইল্যা ভূত! আমি ভুগতাছি ভুগতাছি মাইশার য্যান ভুগতে না হয় সেইজন্যেই কইতেছিলাম!... শেষের দিকে বলতে বলতে রসিকতা ছেড়ে ফুপি পুনরায় ক্ষেপে উঠতে থাকেন।
মাইশার মা বলে উঠলো- তা তো ভালো কাজই করতেছে। সোয়াবের কাম করতেছে।
ফুফি বললো-হ! সোয়াব না কত! সারাদিন কাম করতে করতে আমার জান শেষ! মাঝেমধ্যে ইচ্ছা কইরাই করিনা আমি! না করলে এখন আবার বাপ-পুতে দুইজনেই করে। তাও বিড়ালরে খাওয়ানো চাইই। আর বিড়ালেও পাইছে মজা! ডেইলী খাওয়ার সময় হইলেই দরজার কাছে আইসা ম্যাঁও ম্যাঁও করতে থাকে! মাছের কাঁটাতো সব খায়ই হাড্ডিগুলার একটা গুড়াও এখন পইড়া থাকে না! এখন কয় দিন ধইরা বাপ পোলার লগে মাইয়াও জুড়ছে। ওনারা হাড্ডি থেকে খুব যত্নের সাথে মাংসগুলা আলাদা কইরা খাইয়া হাড্ডিটা বেড়ালের জন্য রাইখা দেয়। বলে- যার খাবার তাকেই দেয়া উচিত। অযথা নিজেরা খাওয়ার দরকার নেই। হাড়ের ভেতরের রসটা খাইলে বরং শারীরিক নানারকম সমস্যা হইতে পারে। কোলেস্টেরল বাড়ে! ইত্যাদি ইত্যাদি! বিড়ালেও খাইয়া বাঁচল। সাথে আমরাও বাঁচলাম। মোট কথা ওর মনে হইছে এটা করা লাগবে ব্যস করবে! বাপটা পাগোল! পোলা মাইয়ারেও পাগোল বানাইয়া ছাড়তেছে! এখন আবার শীত নামছে। তাই কালকে রাত্রে কয়-সিড়ি ঘরে একটা মোটা পাপোশ কিনে আনবে। যেখানে প্রতিদিন খাইতে দেয় সেখানেই একটা মোটা বোর্ডে খাইতে দিবে। আর পাশেই পাপোশটা রাখবে যাতে ঘুমাইতে পারে। শীতের মধ্যে যাতে বিড়ালের ঠান্ডা না লাগে!
মাইশার বাবা বোনের জামাইয়ের সম্পর্কে আগে এত শুনেন নাই। কথাগুলো শুনে ওনার খুব ভালো লাগলো। বোনের কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন-তুই আর যাই কস আমার এই বরিশাইল্যা ভূতরেই লাগবো। মাইশার বিয়া আমি এই পোলার লগেই দিমু। আর ছাড়ন নাই। তুই বুঝলি না তুই কোন ফেরেশতারে পাইছোস! সময় থাকতে মূল্যায়ণ কর কামে দিবো।
মাইশার বাবা গিন্নিকে বিছানা রেডি করতে বললেন। ঘুমোবেন। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। আল্লাহ সঠিক মানুষকেই তাদের মেয়ের জন্যে পাঠিয়েছেন। কথায় আছে না শেষ ভালো যার সব ভালো তার!
জাকিয়া জেসমিন যূথী
২৮/০১/২০১৪
Comments (35)
শুভ হোক পথ চলা । অভিনন্দন সাদা মনের মানুষ ।
স্বাগতম আপনাকে
সাদা মনে কাদা দিয়েন না আবার