এই গল্পটি সম্পূর্ণই একটা কাল্পনিক কাহিনী। বাস্তবের কোনো ঘটনার সাথে এর কোনো মিল পাওয়া গেলে অথবা বাস্তবরে কোনো ব্যক্তি, স্থান, প্রতিষ্ঠান বা পেশার নামের সাথে এই গল্পে উল্লেখিত কোনো ঘটনা অথবা কোনো ব্যক্তি, স্থান, প্রতিষ্ঠান বা পেশার নাম মিলে গেল তা সম্পূর্ণই কাকতালীয়।]
ছাত্তার সাহেব নিপাট ভদ্রলোক এবং কাজ পাগল একজন মানুষ। মধ্য তিরিশের এই ব্যবসায়ী মানুষটিকে সবাই একজন সৌভাগ্যবান মানুষ হিসেবেই জানেন। যে ব্যবসাতে হাত দেন সেখনেই সোনা ফলান। সে জন্য তার বাবাও ছেলের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন। বাবার ব্যবসার হাল ধরার পর সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক বড় করেছেন। স্ত্রী মুসাম্মৎ রেশমা বেগম এর স্বপ্ন স্বামীকে নিয়ে আলাদা সুখের নীড় গড়বেন। স্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরান ঢাকার নিজের বাড়ি ছেড়ে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে ফ্ল্যাট কিনে সুখের সংসার পেতেছেন। বউকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতলেও বাবা-মাকেও দূরে পুরান ঢাকায় ছেড়ে আসেন নি। এগার নম্বর সেক্টরে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন তাদের জন্য। আলাদা থাকলেও অনেকটা কাছাকাছিই থাকেন। পুরান ঢাকার বাড়িটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন।
কাজ পাগল মানুষ হলেও কাজের অবসরে আড্ডা দিতে খুব ভালবাসেন তিনি। রসিক হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। আড্ডায় সব সময় থাকেন মধ্যমনি হয়ে। আসর জমানোতে তার জুড়ি নেই। তবে যারা দেশের নানা সমস্যার কথা কিংবা সমাজিক অবক্ষয়ের কথা বলতে চেষ্টা করেন ছাত্তার সাহেব তাদের সাথে একমত হতে পারেন না। তিনি এমন মানুষকে একদম পাত্তা দেন না। তার মতে এগুলোসব ফালতু কথা। দেশের উন্নতি ভালই হচ্ছে। দূর্ণীতি আর সামাজিক যেসব সমস্যার কথা বলা হয় তা সব দেশেই আছে। দূর্নীতি কোথায় নেই? একটু আধটু সমস্যা তো থাকবেই। এটুকু বাদ দিলে দেশ স্বঠিক পথেই চলছে। গত ৪২ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন তিনি।
ছাত্তার সাহেব মা’র কাছ থেকে আলাদা থাকলেও দিনের কাজকর্ম শেষে তিনি প্রথমেই মা’র বাসাতেই উঠেন। মা’র সাথে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে কোনো কোনো দিন রাতের খাবার খেয়ে তবে নিজের বাসায় ফেরেন তিনি। সেদিন ছাত্তার সাহেব মা’র বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে নিজের এপার্টম্যান্টের সামনে এলেন। রাত তখন সারে দশটা বাজে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবেন এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখেন মামাতো ভাই রুবেল ফোন দিয়েছে। তিনি আর ভিতরে ঢুকলেন না। কারণ রুবেল কেন ফোন করেছে তা তিনি জানেন। মামা হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসার খরচ তিনিই দিচ্ছেন। কিন্তু স্ত্রী মুসাম্মৎ রেশমা বেগম এসব পছন্দ করেন না বলে তাকে জানানো হয় নি। তাই তিনি বাইরে দাঁড়িয়েই মামাতো ভাই রুবেলের সাথে কথা বলছিলেন।
নিজের এপার্টম্যান্টের গেটে হেলান দিয়েই কথা বলছিলেন তিনি। হঠাৎ পুলিশের একটি গাড়ি তার পাশে এসে থামল। দু'জন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে এসেই তার কলার চেপে ধরে কিল ঘুষি মারতে লাগল। 'ইয়াবার ব্যবসা করো, না? চল শালা থানায়’ বলল তাদের একজন। তারপর থাপ্পরের পর থাপ্পর মারতে মারতে গাড়িতে উঠানো হলো ছাত্তার সাহেবকে। থানায় আনার পর একটা রুমে বেঞ্চিতে বসানো হল তাকে। এসময় একজন লাথি মারলো ছাত্তার সাহেবের কোমর বরাবর। তারা অনেকগুলো মামলার নাম বলাবলি করছিল। ছাত্তার সাহব নাকি সেসব মালার পলাতক আসামী। লাথি খেয়ে ছাত্তার সাহেব বেঞ্চসহ সামনের দিকে উবু হয়ে পড়ে গেলেন। মাথা ঠুকে গেল মাটিতে। বুটের লাথিতে মনে হচ্ছে কোমড়রে হাড় ভেঙ্গে গেছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
ছাত্তার সাহবের এসময় মনে পড়ে যায় বৃটিশ পুলিশের কথা। বৃটিশ শাসনাধীন তৎকালীন ভারতবর্ষের পুলিশের মহাপরিদর্শক কর্ণেল এন এস সিম্পসনের কথা। কেলকাতার রাইটার্স ভবনে ছিল তৎকালীন পুলিশের এই মহাপরিদর্শকের অফিস। পলাশীর যুদ্ধেরে পর বাংলা দখল করে ইংরেজ কোম্পানী নির্মাণ করে এই রাইটার্স ভবন বা ছোট কেরানীদের অফিস। কোনো বাঙালী যুবক রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হলে তার সাথে চরম বীভৎস নির্যাতন আর নিষ্ঠুরতম আচরণ করতো এই কর্ণেল সিম্পসন। একদিন তিন বাঙালী যুবক পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ে রাইটার্স ভবনে। তিন বাঙালী যুবক বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত আর দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স ভবসে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে কর্ণেল এন এস সিম্পসনকে।
তারা ছাত্তার সাহেবের দেহ তল্লাশী করল। মানি ব্যাগে ত্রিশটা একহাজার টাকার নোট আর একটা ডেবিট কার্ড পাওয়া গেল। মোবাইলটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে কী মনে করে ফেরত দিয়ে দিল। কিন্তু টাকাটা নিয়ে নিল। আর ডেবিট কার্ডটা দেখিয়ে একজন জিজ্ঞেস করে 'কত টাকা আছে একাউন্টে?' ছাত্তার সাহেব ভাবে এদের সাথে মিথ্যে বলে লাভ নেই। 'লাখ দশেক হবে' উত্তর দিল ছাত্তার সাহেব। একজন বলল, 'পাসওয়ার্ডটা বল। তোর ভাগ্য ভাল। ছেড়ে দিব তোকে।' ছাত্তার সাহেব পাসওয়ার্ড দিলেন। একজন চলে গেল টাকা উঠাতে।
তার ডেবিট কার্ড দিয়ে এক দিনে সর্বোচ্য দেড় লাখ টাকা উঠানো যায়। তাও আবার প্রতিবার পঞ্চাশ হাজার করে তিন বারে দেড় লাখ। টাকা তুলে একজন ফেরত এলো । তখন রাত এগারটা পঞ্চাশ মিনিট। অন্য একজন বলল, 'বারটার পর তো নতুন দিন শুরু হবে। আরও দেড় লাখ উঠানো যাবে।' তখন কার্ডটি নিয়ে আরেক জন গেল। আরও দেড় লাখ উঠিয়ে ফেরত আসার পর কার্ডটা আর খালি মানি ব্যাগ ফেরত দিয়ে বলে, 'নিচের দিকে তাকিয়ে সোজা চলে যা।'
রাত তখন সারে বারটা বাজে। ছাত্তার সাহেব মাথা নিচু করে থানা থেকে বের হতে হতে মনে মনে বলে, 'ফকিন্নি মা.... বাচ্চারা। খা..... দিয়া শালা দেশটা ভইরা গেছে।' দুই ঘন্টা এই বিভীষিকার পরও ছাত্তার সাহেব মনে করেন তিনি সৌভাগ্যবান। তাকে জজ মিয়া হতে হয় নি কিংবা অন্য যেসব মামলার নাম বলা হয়েছে সেগুলোর আসামি তাকে করা হয়নি। তবে এখন তিনি স্বীকার করেন যে, দেশে অনেক সমস্যা আছে। বরং এখন তিনি মনে করেন দেশটা রসাতলে গেছে। বিভীষিকাময় দুই ঘন্টার পর তার এই বোধোদয়ই হয় যেন।
এখন তিনি আড্ডায় প্রায়ই বলেন, - এমনই আজব এদেশ যে দেশে মাংসের দোকানে জনস্বার্থে ভেজাল বিরোধী অভিযানের সময়য় ম্যাজিস্ট্রেট এর উপর হামলা হয়। অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযানের সময় ম্যাজিস্ট্রেট আক্রান্ত হন বেআইনী কারবারীদের দ্বারা। এদেশে আমি দেখেছি পরীক্ষায় নকল ধরার প্রতিবাদে মিছিল হয়। এদেশে অভিবাবকরা তাদের সন্তানদের পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহ করেন। সামনে এমন কিছু দেখলেও অবাক হব না যে, চোরেরা চুরি করতে না দেয়ায় মানববন্ধন করছে কিংবা ছিনতাইকারী-মলম পার্টির লোকেরা অবরোধ করছে, জলদস্যু-ডাকাতেরা লংমার্চ করছে তাদের দাবি আদায়ের জন্য।
অনেকে বলেন কিছু খারাপ লোকের কারণে সব নষ্ট হচ্ছে। ছাত্তার সাহেব এখন মনে করেন কথাটা ঠিক না। কিছু খারাপ লোক সব সমাজেই থাকে। একটা সমাজে দশ শতাংশ মানুষ খারাপ থাকতেই পারে। তবে এরা সুবিধা করতে পারে না। ভালদের দ্বারা বিতারিত হয় এবং আইনের আওতায় এসে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজের নব্বই শতাংশ মানুষেরই মন মস্তিষ্কই নষ্ট। ফলে ভাল দশ শতাংশ মানুষ আছে বেকায়দায়। আর নষ্টামিটা হয়ে গেছে সিসটেম। সবাই ঐভাবেই চিন্তা করে।
Comments (1)
কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ। ভাল লেগেছে।
সুন্দর শিরোনামের এই চমৎকার কবিতার জন্য ধন্যবাদ জানবেন কবি।
কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ। ভাল লেগেছে।
সুন্দর শিরোনামের এই চমৎকার কবিতার জন্য ধন্যবাদ জানবেন কবি।
অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকুন সবসময়।