Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

চিঠি "কালো রাত্রী"

এখন তা কল্পনাতীত…অথচ এক দিন এই চিঠি লেখাই ছিল অনেকের কাছে দৈনিক রুটিন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর হতেই মুলত স্বাধীনতা যুদ্ধের ঢামাঢোল বাজতে থাকে,সময়ের অতিক্রমে তার রূপ ভয়ংকর হতে থাকে…চার দিকে কেবল ফিসফাস পাকিদের আনাগোনা বাড়তে থাকে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাতে ঢাকা শহরে বসবাসরত একটি পরিবারের এক মাত্র কন্যা নাজমার অপেক্ষা তার সহপাঠি বন্ধু প্রিয়তমা যাই বলি না কেনো,সেই সু-পুরুষটির আগমনের জন্য অপেক্ষায় ঘরের একটু বাহিরে পা চারি করছেন সে “কখন সে আসবে!।দেশের এমন ক্লান্তিলগ্নে উদ্বিগ্ন ছিলো পুরো দেশের জনগণ… কি জানি কি হয় কেবল ব্যাতিক্রম নাজমা,দেশ জাহান্নামে যাক ফিরে আসুক একান্ত নিজের তার প্রিয়তম তার নিকটে।সে বলেছিল এবার যদি আসতে না পারেন তবে সে চিঠি হলেও পাঠাবেন।
হঠাৎ বিকট শব্দ লোকমুখে জানা গেল রাজার বাগ পুলিশ নাইলে হামলা করেছে পাকিরা।তাদের প্রতিরোধে ছাত্ররা উৎপেতে ছিল,কিছু বুঝে উঠার পূর্বে পাকিদের গোলাবারুদের ঝনঝনানিতে পরিবেশ হয়ে উঠল এক বিভীষিকাময় ভয়াল কালো রাত্রীতে।বোমার প্রচন্ড শব্দে কান দুটো চেপে ধরেন নাজমা তবুও বোমার শব্দ আর মানুষের ভয়ার্ত চিৎকারের শব্দ যেনো ক্রমশতঃ বেড়েই চলছে…..দৌড়ে উঠে গেলেন ঘরের ছাদে….।যে দিকে চোখ যায় কেবল আগুনের লেলিহান শিখার দাপুটে খেলা।চোখে পড়ে পাশের বাড়ী লুটপাট আর স্বদেশীয়দের ডাকাতি মহড়া,যে যা পাচ্ছেন কেউ বদনা কেউ বা ঘটি নিয়ে ছুটছেন,কেউ বা ভয়ে তপ্লিতপ্লা সহ কাদো নয়নে বাড়ী ছাড়ছেন কেউ বা মটরের গুলিতে লুটিয়ে পড়ছেন রাজপথের অলিগলিতে…..সবিই তার চোখে একটি সিনেমার চিত্রায়ন ধারন মনে হচ্ছিল।চোখের দৃষ্টি রাজপথের সুডিয়াম আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন,পথচারিদের ভয়ে পালানোর আত্বচিৎকারের সাথে সাথে পাকিদের গুলিতে ছুটন্ত দন্ডায়মান দেহটি ধপাস্ করে রাজপথে লুটিয়ে পড়া কোরবানীর গরুর মতো শত শত মানুষের রুহু বিয়োগের আগ মুহুর্তের ছটফটানি…তার চোখ ঝাপছা হয়ে আসছে মাথাটাও কেমন যেন ঘুড়ছে…।চাচুকে পাক বাহিনীরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে….নীচের ঘর হতে তীব্র চিৎকারের শব্দ শুনে নাজমা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েন।
সেই রাতে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও।
সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও ৩০০০ লোক।ঢাকার রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত দেহ গুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হতে থাকে,শিয়াল কুকুরের বিকট শব্দে পরিবেশ ভারি হতে থাকে।সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশানের ভূমি।
এক সময় শ্মশানের নিরবতা,ভোরের বাতাসে বাতাসে ভেসে আসছে রাজপথের রিক্সাচলক ছাত্র জনতা কুলি মজুরির হাজারো মৃত লাশের গলিত রক্তের তীর্ব্র ঝাঝালো ঘ্রান,গলিত রক্ত রাস্তার ড্রেনে স্রোতের ন্যায় প্রবাহিত হচ্ছে।পাকিদের উদ্দ্যেশ্য ছিল বাঙ্গালিদের স্বাধীকার আন্দোলন অঙ্কুড়েই শেষ করে দেয়া কিন্তু ওরা হয়তো ভুলে গিয়েছিল আন্দোলনে যত লাশ পড়বে তত তার আন্দোলন তীব্রতর হতে তীব্রতর হবে।
নাজমা জ্ঞান ফিরে পেয়ে নীচে তাদের ঘরে প্রবেশ করে অবাক হন ঘরের পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে…লুটতরাজে কিছুই আর অবশিষ্ট রাখেনি লুটেরা কিছুক্ষণ আগেও বাড়ী ভর্তি মানুষজন ছিলো এখন তা শুণ্য।ফাকা ঘর ছাড়া ব্যাবহার্য্য জিনিস পত্র বলতেই কিছুই রেখে যায় নি দস্যুরা তখন হয়তো কারো ছিল ভাদ্র মাস কারো বা ছিলো সর্বনাস।মাকে ঘরের এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসতে দেখে কান্নায় তাকে জড়িয়ে ধরেন।বেশী দিন হয়নি স্বামীর ব্যাবসার তাগিদে ঢাকায় রাজার বাগের সন্নিকটে একটি মহল্লায় বাসা ভাড়া নেন।তার চাচা এসেছিল গ্রাম থেকে কিছু ব্যাসায়িক ঝামেলা মেটাতে।
-মা!!!
মায়ের মুখের ভাষা নেই শুধু ঠোট ফুলিয়ে চাপা কান্নায় নয়নের জল ঝড়াচ্ছেন।মায়ের এমন মৌনতায় সারা রাত্র চলে যায়,সূর্য্যের আলো দুপুর গড়ানোর পর নাজমা দেখতে পেলেন তাদের বাপ চাচা দুজনেই ফিরে এসেছেন।অবাক বিষয় পাকিদের হাতে ধরা পড়ার পরও তারা বেচে আছেন।কথায় আছে রাখে আল্লাহ মারে কে হয়তো সেরকম কিছু ঘটনাই ঘটেছিল সে দিন।
পাকিরা তাদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে তাদের দেহে অমানবিক অত্যাচার করেন তার পিতার সাদা পাঞ্জাবিটি চাপ চাপ রক্তে বুটিকের ন্যায় চিত্রকর্মে ভরে গিয়েছিল,তাদের সমস্ত পিঠে আঘাতের চিহ্ন।নিজেরা এ ভাবে জীবিত আসতে পারবেন কল্পনাও ভাবেননি।ঘটনাটি ঘটে যখন তাদের সহ বেশ কয়েজনকে হাত চোখ বেধে একটি নির্জন স্থানে সারি বদ্ধ ভাবে এক লাইনে দাড় করিয়ে চোখ খুলে দেন অতপরঃ তাদের পড়নে যার যা ছিল,কারো লুঙ্গি কারো প্যান্ট কারো বা ধুতি একে একে সব খুলে ফেলে পরিঙ্ক্ষা করে দেখল কয়জন হিন্দু আছেন সেখানে।যে কয়জন হিন্দু ছিলেন তাদের সবার গোপনাঙ্গগুলো কেটে উল্লাস করতে থাকেন।এরই মধ্যে অর্ডার হয় ব্রাস ফায়ারের….।ফায়ারের শুরুর ক্ষণের পূর্বে কৌশলে তার বাপ চাচা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে যাত্রায় বেচে যায়।
পাকিরা চলে যাবার পর নাজমার বাবা অনুভব করতে লাগলেন তার উপর ভারি কোন বস্তু ভর করে আছে।ঝাটকা দিয়ে উঠতেই সার্চ লাইটের আলো গিয়ে পড়ে সেই ভারি নিথর দেহটির উপর,চিনতে আর বাকী রইল না পিতার।ছেলেটি আর কেউ নয়,মেয়ের অতি পরিচিত,তার মেয়ের সহপাঠক সে।অবশ্য পাকিদের হাতে ধরা পড়ার পরও তার সাথে বাবার সামান্য আলাপ চারিতা হয়েছিল।যখন চোখ বেধে ফেলে,এই নির্জন স্থানে নিয়ে এলো তখন অচেনা হয়ে যায়।পরক্ষনে পিতার বাম হাতটি তার প্রকৃত ঠিকানা খোজে হাতরাচ্ছেন দেহের এখানে সেখানে।বুক পকেটে রাখা গ্রেনেটের আঘাতে ছিদ্র হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত কাগজের একটি টুকরা হাতে পড়ে,তা কিছু না ভেবেই কাগজের টুকরাটি হাতিয়ে নেয় সে।
কাগজের টুকরোটি মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,তোমাদের সহপাঠির….দেখো এখানে কোন ঠিকানা নাম-দাম আছে কি না।অতপরঃ মা মেয়ের কাধে ভর করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেন।নাজমা কাগজটি হাতে নিয়ে তার ভাজ দেখে বুকের ভিতরে আমিটা মোচর মারে,,,,এমন ভাজ করা কাগজ তার বহুকালের চেনা।বাপ চাচাকে কিছুটা সেবা দিয়ে কাগজের টুকরোটি নিয়ে সে বাড়ীর ছাদে উঠেন।

তিনটি কৌশলগত ভাজ ছিল কাগজের টুকরোটির যার পদ্ধতি নাজমার খুবই পরিচিত।একটি করে ভাজ খুলেন আর শরিরের ভিতরের অস্থিমজ্জাগুলো যেন অবশ হতে থাকে,যেন এক অজানা অসুখে নিজেকে অসার করা।ভাজ খুলে চিঠিটি মেলে ধরে নাজমা লক্ষ্য করলেন চিঠির একটি স্থানে জয় বাংলা না কি যেন লেখা ছিল যা সে বুঝতে পারছেন না তাছাড়া  ক্রিচের আঘাতে তা ছিদ্র হয়ে রক্ত জমাট বেধে লাল সূর্য্যের ন্যায় চিত্রিত হয়েছিল…চিঠির সেই লাল অংশের লেখাটি ভাল ভাবে পড়তে কাগজটি উদিত সূর্য্যের দিকে মেলে ধরেন,সুর্য্যের আলোতে এবার স্পষ্টই বুঝা গেল লেখাটি “জয় বাংলা-জয় বঙ্গ বন্ধু”।
এবার চোখ বুলান চিঠির শুরুতে……

প্রিয়,
ক্ষমা করো আমায় রাখতে পারিনি কথা দেওয়ার কথাগুলো।স্বাধীকার আন্দোলনে ভুলে গেছি সব পরিবার পরিজন আশা আছে এক দিন আবারো দেখা হবে,হবে কথা।বাংলায় কথা বলতে বাংলায় চিঠি লিখতে জীবন দিয়েছেন রফিক বরকত আরো কত জন এবার দেশটাকেই করব শত্রু মুক্ত যাতে তোমার আমার মাঝে কিংবা পিতা তার মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্তে স্বদেশে বসবাস করতে পারেন।আমরাতো আমাদের, শুধু অধিকারগুলোই চেয়েছিলাম,….ওরা দেয়নি…বরং আমাদেরটা খেয়ে পড়ে আমাদের উপরই বন্দুকের নিশানা লাগাত,….বলোতো এমন অত্যাচার কি মেনে নেয়া যায়?যায় না তাইতো একান্ত নিজেদের তাগিদেই আমরা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি।এ লড়াইয়ে জয় আমাদেরই হবে।সে দিন আমি থাকবো কি না জানি না তবে,যে বীজ বপণ করে যাবো তার জন্ম হবেই…ইনশাল্লাহ্।
হয়তো তুমি ভাবছো..এ কি প্রেমের চিঠিতে পাগলের মতো প্রসঙ্গ বহিঃভূর্ত কথা বলছি….কি করবো বলো তুমিতো জানোই ‘৫২তে হারিয়েছি প্রান প্রিয় পিতাকে শুধু মাত্র মুখের ভাষাকে প্রানেতে প্রতিষ্ঠা করতে….’৬৯ এ হারিয়েছি ছোট কাকুকে সেই বংশের বংশধর হয়ে দেশের এমন ক্লান্তিকর সময়ে আমার মতো তরতাজা যুবক কি চুপ করে থাকতে পারে?।
গত রাতে তোমাকে নিয়ে ছোট্র একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি,শুনবে…..

এ লড়াই শুধু তোমার জন্য
এ যুদ্ধ তোমাকে আপন করে পাবার তরে
এ সংগ্রাম স্বাধীনতা,
তোমাকে ঘরণী বানানোর তরে
তোমার মিষ্টি হাসি,
দুষ্টু চাহনিতে স্বাধীনতা দিতে,
পূর্ণিমার জোৎস্নায়
রাত ভর ভালবাসার স্বাদ পেতে।

এ স্বাধীনতা
তোমার আমার অস্থিত্ত্বের
সন্তান হারা মায়ের চোখের জলের বদলা,
স্বামী হারা বোনের
সন্তান হারা পিতার
আক্রোশের প্রতিশোধ নিতে।

যদি আমাকে ভালবাসো
তবে,
বাংলার মাটিকে আকড়ে ধরো
খোজে দেখো,
আছি আমি
এ মাটির গন্ধের রন্দ্রে রন্দ্রে
সবুজ অরণ্যের
সুভাষিত বাতাস হয়ে।

ইতি:তোমারি আমি

১ Likes ০ Comments ০ Share ৬১৪ Views