আমার ছোট ছেলে অসি, পাঁচ বছর বয়স তখন, মাত্র প্রি-কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি। অসি এবং আমার মেঝু ছেলে শাওন দুজনকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে সোফায় একটু বসতেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। অসি তখন "ভাইয়া এসেছে, ভাইয়া এসেছে" বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই আমার বড় ছেলে অণি এসে ঢুকলো। অণিকে ঘেমে একাকার অবস্থা দেখে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম--
আমিঃ কিরে বাবা, তোর এই অবস্থা কেন?
অণি- বাহিরে খুব গরম আম্মু !!
আমিঃ কেন, স্কুল বাসে কি এসি ছিলনা?
অণি- ছিলো তো। বাস থেকে নেমে বাসায় আসতে, এইটুকুতেই এক্কেবারে ঘেমে গিয়েছি। অনেক অনেক গরম বাহিরে।
আমিঃ এই জন্যইতো আমি গাড়ি দিয়ে নিয়ে আসতে চাই তোকে, কিন্তু তুই ইতো নিজে নিজে আসতে চাস। যা, সোজা বাথরুমে গিয়ে গোছল করে আয় বাবা। আমি খাবার টেবিলে দিচ্ছি।
অণি বাথরুম থেকে এলে পরে, শাওনকে বাথরুমে পাঠালাম এবং অসিকে আমি অন্য বাথরুমে গোছল করায়ে নিয়ে এলাম। তারপর ছেলেদের জন্য খাবার টেবিলে দিয়ে দিলাম এবং আমি বসে টিভি দেখছিলাম। তার কিছুক্ষণ পর আমার বাগানে যাওয়ার কথা মনে পড়ল। সকালে ফজরের নামাজ পড়ার পর ছেলেদের স্কুলে দিয়ে এসে বাগানে গিয়ে গাছগুলোতে একবার পানি দিয়ে আসি আবার বিকেলে একবার পানি দিই, এই দুইবারই গাছে পানি দেওয়া হয়। দুপুরে ঠাঠা রোদ্দুরে গিয়ে গাছে পানি দেওয়ার সাহসই হয় না, তাই দুপুরে আর গাছে পানি দেওয়া হয়না। এই চাকুরিটা আমার করতে হয় মার্চ/এপ্রিল থেকে অক্টোবর/ নভেম্বর পর্যন্ত। সেই সকালে গাছগুলোতে পানি দিয়ে আসলে সারাদিনে রৌদ্রে শুকায়ে, গাছ এবং গাছের পাতাগুলো সহ একেবারে নুয়ে পড়ে। আবার বিকেলে গাছে পানি দেওয়ার পর রাতের আর্দ্রতায় যেন গাছগুলো সব তর-তাজা হয়ে উঠে, গরমের সময় এমনি করেই গাছগুলো বড় হতে থাকে। এইসব ভাবতে ভাবতে, এক প্রকার বিরক্তভাব নিয়ে আনমনেই আমি বলে উঠলাম, "ইস! কি ভয়ংকর গরমটাইনা পড়েছে, অসহ্য লাগে ভীষণ।"
তারপর বাগানে যাওয়ার সময় ছেলেদের ডেকে বললামঃ "অণি-শাওন, তোদের হোমওয়ার্ক করতে থাক। আমি বাগানে যাচ্ছি, গাছগুলোতে পানি দিয়ে আসছি। আর অসির প্রতি খেয়াল রাখিস। মেইন দরজা কিন্তু খোলবিনা, কেউ আসলে বা ফোন আসলে আমাকে ডেকে দিস।" এবং বলেই বাগানে চলে গেলাম।
বাগানে গিয়েই পানিটা ছেড়ে স্প্রে-নজ্যালটা হাতে নিয়েই প্রথমে সবজি-গাছগুলোতে পানি দিলাম। তারপর একে একে ফুলগাছ আর ফলগাছে পানি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ অসি দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললঃ
"আম্মু আম্মু, তুমি কি করছো?"
আমিঃ দেখিসনে বাবা, কি করছি!!
অসিঃ আমি এখানে খেলা করি?
আমিঃ ঠিক আছে, করো বাবা।
সে তখন আপন মনে কতক্ষণ দৌড়া দৌড়ি করে আমার কাছে এসে, আবারও বললঃ আম্মু আম্মু, তুমি কিসে পানি দিচ্ছ এবং কেন দিচ্ছ?
আমিঃ গাছে পানি দিচ্ছি বাবা। এবং গাছগুলো বড় হতে সাহায্য করছি।
অসিঃ কিন্তু তুমি তো গাছে পানি দিচ্ছনা আম্মু।
আমিঃ তাহলে কি করছি বাবা?
অসিঃ তুমি তো মাটিতে পানি দিচ্ছ।
আমিঃ না বাবা, আমি গাছেই পানি দিচ্ছি।
অসিঃ আমাকে দাও আম্মু, আমি গাছে পানি দিয়ে দিচ্ছি। বলেই আমার হাত থেকে স্প্রে-নজ্যালটা নিয়ে গাছের উপরের দিকে পানি দিচ্ছিল। আর বলছিল, "আম্মু, তুমি গাছে পানি যদি দিতে চাও, তাহলে গাছের উপরের দিকে পানি দিচ্ছনা কেন? গাছের উপরে পানি দিলে, তবেই তো গাছ পানি খেতে পারবে আম্মু।
আমি তখন ওকে বললামঃ "না না বাবা! গাছ ওদের রুট বা শিকড় দিয়ে খাবার খায়। আর গাছের শিকড়গুলো থাকে মাটির নিচে। তাই আমি মাটিতেই পানি দিচ্ছি বাবা।"
অসিঃ "কিন্তু তুমি তো দেখতে পাচ্ছোনা সেটা!!" বলে সে খুব আশ্চর্য্য হয়ে গেল।
আমিঃ ঠিকই বলেছিস বাবা। কারণ, শিকড়গুলো মাটির নিচে লুকানো তো তাই। কিন্তু না দেখতে পেলেও আমি জানি যে, গাছের শিকড়গুলো সব সময়ই মাটির নিচেই থাকে। এবং যখন আমি মাটিতে পানি দিই, তখন গাছের শিকড়গুলো সেই পানিটাকে খাবার হিসেবে পেয়ে থাকে। আমরা যদি সঠিকভাবে গাছের শিকড়গুলোর যত্ন নিতে পারি, তাহলে গাছগুলো অনেক বড় এবং অনেক শক্তিশালী হতে পারে। তখন গাছগুলোতে অনেক ফল হবে, ফুল হবে এবং আমাদের ছায়াও দিয়ে থাকে।
অসি তখনও কিছুটা বিভ্রান্ত থাকলেও, যেন আরো বেশি আশ্চর্য্য হয়ে বললঃ "কিন্তু তুমি কিভাবে জানতে পারলে যে, গাছের শিকড়গুলো মাটির নিচেই থাকে? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা আম্মু! আর তোমার কথা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে তো শিকড়গুলো গাছের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।"
আমি তখন বললামঃ হুমমম অনেক জ্ঞানী লোক আছেন যারা এইগুলো অনেক রিসার্জ করে বইয়ের মধ্যে লিখে রেখে গিয়েছেন। সেই বইগুলো পড়ে সবাই জেনেছে, তেমনি আমিও।
তারপর অসি তার চোখ দুটি বড় বড় করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললঃ থাঙ্কস আম্মু। এখন আমিও জেনেছি।
অবশেষে, মা-ছেলে দুজনে মিলে ঘরে চলে এলাম। এবং বসে বসে অসির সাথে বলা কথাগুলো খুব ভাবিয়ে তুলছিল যে, "আমাদেরও কি তাহলে একইভাবে অনেক কিছু অজানা রয়েছে? আমাদেরও কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদের কাছ থেকে হয়তো গোপন রয়েছে, যেমন করে গাছ থেকে তার শিকড়গুলো লুকিয়ে থাকে মাটির নিচে।"
পরোক্ষণে মনে হলো যে, "আসলে প্রথম দিকে আমরা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিনা, দেখিনা বা বুঝতেও পারিনা ---- কিন্তু পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন এবং আছেন, তাদের আন্তরিক শ্রমসাধ্যে অনেক বই লিখে গিয়েছেন এবং তারা তাদের বইতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে আমাদের বলে গিয়েছেন, কিভাবে আমরা আমাদের জীবনের শিকড়টাকে সঠিকভাবে যত্ন নিতে পারি। যাতে করে আমাদের জীবনটাকে আমরা সঠিকভাবে বিস্তার কিংবা প্রসারণ করতে সম্ভব হতে পারি।"
অতঃপর অসি কি মনে করে যে, একটা ছবি এঁকে এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, "আম্মু, আমি এটা তোমাকে উপহার দিলাম" এবং আমিও তখন ওর আঁকা ছবিটি দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম সেইদিন। তাই এই ছবিটা আমি খুব যত্ন করে তোলে রেখে দিলাম।
Comments (26)
ভাগ্যিস অধ্যাপিকা খুরশিদা বেগম অন্য ধর্মাবলীর হননি। তাহলে আজ হয়ে যেত সংখ্যালঘু হামলা।
সংখ্যালগু এবং সংখ্যাগরিষ্ট শব্দগুলোর জন্মদাতাদের পেলে একটা কিছু করতাম ।
ab¨ev`
সেরকমটা আপনাকেও । ধন্যবাদ ভাই ।