মাঘ মাসের প্রচন্ড শীত। কনকনে ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে। আমি দাড়িয়ে আছি ঢাকার সায়দাবাদ এলাকায়। যেখানটায় রাস্তার পাশে রয়েছে সারি সারি বাস কাউন্টার। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় নানা কোম্পানির বাস। আমার গন্তব্য ফেনী। আশেপাশে আরও লোকজন আছে। কে কোথায় যাবে কে জানে। প্রচন্ড কুয়াশা আর কনকনে শীতে শরীর গরম করার জন্য লোকজন সিগারেট খাচ্ছে অনবরত। সিগারেটের ধোয়ার গন্ধে আমার মাথা ধরে গেছে। বমি বমি লাগছে। কিন্তু ধোয়া থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। যেখানেই গিয়েই দাড়াই সেখানেই কেউ না কেউ সিগারেট ফুকছে। এজিনিসটা মানুষ কীভাবে যে খায় আমি বুঝতে পারি না।
সকালেই ঢাকা এসেছিলাম একটা জরুরি কাজে। আমার ধারনাই ছিল না যে এমন একটা বিপদে পড়তে পারি। সেই বিকেল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। কিন্তু কোন বাসই এখান থেকে ছেড়ে যাচ্ছে না। প্রথমে একটা আশা সবার মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন সবাই নিশ্চিত যে আজ আর বাস ছাড়বে না। ঢাকায় আমার কোন নিকটাত্মীয়ও নেই যার বাসায় গিয়ে উঠতে পারি। আর যে কারণে বাস চলছে না ঠিক সেই কারণেই হোটেলগুলোও কোন বোর্ডার নিতে পারছে না। কারণটা হল একটি রাজনৈতিক দল আগামি কাল “চল চল ঢাকা চল” নামে এটি কর্মসূচি দিয়েছে। আর সেই কর্মসূচিকে প্রতিরোধ করতে সরকার তার সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। মানুষ যাতে ঢাকয় আসতে না পারে তার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে দেয়া হয়েছে। বাস, রেল, লঞ্চ কোন কিছুই চলছে না। মানুষ যাতে আগে থেকে ঢাকায় এসে থাকতে না পারে সে ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছে। সেজন্য ঢাকার হোটেলগুলো যাতে কোন বোর্ডার না নিতে পারে সে জন্য যা করা দরকার করে রেখেছে সরকার এবং সরকার দলীয় লোকজন।
কী করব ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। এদিকে ঠান্ডার সাথে ছিল ঘন কুয়াশা। পর্যাপ্ত শীতের কাপড়ও সাথে ছিল না। সিগারেটের ধোয়া থেকে বাচার জন্য হাটতে হাটতে সায়দাবাদ থেকে মানিক নগরের দিকে অনেক দূর চলে এলাম। একটি চায়ের দোকান দেখে এক কাপ চায়ের কথা বললাম। এসময় একটি লোককে দেখলাম দাড়িয়ে দাড়িয়ে আপন মনে কথা বলছে আর শীতে ঠকঠক করে কাপছে। লোকটির পরনে ময়লা প্যান্ট আর জেকেট। লম্বা চুল দাড়িতে জট ধরেছে। চা খেতে খেতে লোকটিকে দেখছিলাম। নির্ঘাৎ রাস্তার পাগল। একটি কুকুর সেখানে লোকটির সামনে কুৎ কুৎ আওয়াজ করছিল আর মাঝে মাঝে গা ঘেষছিল। মনে হয় ক্ষিধে পেয়েছে। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে লোকটি বলে উঠল, ‘ঐ বেটা কুত্তা গেলি। তুইও তো দেখি মানুষের মত শুরু করলি।’ লোকটার কথাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
এদিকটায় তেমন মানুষজন নেই। একেতো ঠান্ডা তার উপর উত্যপ্ত পরিস্থিতি। একটা দুইটা রিকসা টুং টাং শব্দ করে চলে যাচ্ছে। ‘চা খাবেন?’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটিকে। প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে আছে মধ্য বয়সের পাগল মানুষটি। মনে হয় খাবে, যদিও মুখে কিছু বলছে না। রুটি,কলা আর চা নিয়ে দিলাম লোকটির হাতে। দুটি বন রুটি আর দুটি কলা দিয়েছিলাম। একটি রুটি নিজে খেল আর একটি রুটি কুকুরটিকে দিয়ে দিল। কলা দুটি নিজেই খেল। কে জানে কুকুর হয়ত কলা খায় না। রুটি কলা খাওয়া শেষ হলে হাতে থাকা পানির বোতলটি এগিয়ে দিলাম। সবটুকু পানি খেয়ে বোতলটি ফেলে দিল। তারপর চা খেল অনেক আরাম করে।
কাপ হাতে নিয়ে বিল দিতে গেলাম। চা ওয়ালা জিজ্ঞেস করে ‘ভাইজান কি বাস ধরতে আসছিলেন? বাড়ি কই ভাইজানের?’ ‘বাড়ি তো ভাইয়া ফেনী। বাস না পাইয়া তো ভাইয়া বিপদে পড়ে গেলাম’, আমি উত্তর দিলাম। লোকটি খুশি হয়ে বলল, ‘আরে আমার বাড়িও তো ফেনী। ফেনী ছাগল নাইয়া থানা।’ সে আরও বলে, ‘ভাইয়া এক কাজ করেন, জনপথ মোড়ে হাইওয়েতে গিয়ে দাড়ান। দেখবেন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
চা দোকানদারের কথামত জনপথ মোড়ে দাড়িয়ে আছি। আস্তে আস্তে বাসের কাউন্টাগুলো বন্ধ হয়ে যচ্ছে। যেহেতু আজ এবং কালও কোন বাস ছাড়তে নিষেধ আছে তাই অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে কর্মচারিরা উৎসবের আমেজে আছে। রাত বাড়তে থাকায় এখন লোকজনও কম আর সিগারেটের গন্ধও নেই। একদল টোকাই দেখলাম আগুন জ্বালিয়ে ঘিরে বসেছে। আমিও তাদের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। বেশ উম পাচ্ছিলাম। এত কষ্টের মধ্যেও পাগলের কথাগুলো মাথা থেকে যাচ্ছিল না। আমার মাথায় কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘ঐ বেটা কুত্তা গেলি। তুইও তো দেখি মানুষের মত শুরু করলি।’ ‘পাগলে কী না বলে’ এই ভেবে পাগলের কথাগুলো মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে চাইলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আমার মাথায় ঢুকে গেল আর একটি বাক্য, ‘ আসলে কে পাগল, সেই লোকটি নাকি আমরা?’