Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কাজলা দিদি কবিতার লেখক বিখ্যাত কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ৬৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

 
রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান সাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক যতীন্দ্রমোহন বাগচী। যিনি কাজলা দিদি লিখে সকল পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। যতীন্দ্রমোহন বাগচী খুব অল্প বয়স থেকেই কাব্যচর্চা শুরু করেন। যতীন্দ্রমোহন ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের শক্তিমান কবিদের অন্যতম। সেই যুগে রবীন্দ্রনাথের ভক্তের তুলনায় নিন্দুকের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। তখন যতীন্দ্রমোহনের মতো সাহসী তরুন বুদ্ধিজীবিরাই রবীন্দ্রনাথের জয়গান করে প্রকৃত আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যতীন্দ্রমোহনের কবিতায় হাতে খড়ি তাঁর স্কুল জীবনে। তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। কিশোর বয়সেই বই পড়ার প্রতি তার তুমুল আগ্রহ। বাড়িতে তো পড়েনই স্কুলের গ্রন্থাগারে বসেও্র আপন মনে বই পড়ছেন। ১৮৯১ সালে যতীন্দ্রমোহন শুনতে পেলেন ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর নাই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে কবির কিশোর মন এই লেখকের মৃত্যুতে বেদনার্ত হয়ে ওঠে। নিজের মনকে শান্তনা দিতে লিখে ফেললেন বিদ্যাসাগর স্মরণে ছোট্ট একটা কবিতা। এ কবিতা শুনে অনেকেই বিস্মিত হয়ে যায়। অনেকের চোখ জলে ভরে ওঠে। এতটুকু ছেলে কি এক শোকের বাণী রচনা করে ফেলল। তেরো বছর বয়সে লেখা সেই রচনাটিই যতীন্দ্রমোহনের প্রথম মুদ্রিত কবিতা বলে জানা যায়। এ থেকে তার লেখক জীবন শুরু। ছাত্রাবস্থা থেকেই ঠাকুর বাড়ির বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা ‘ভারতী’ এবং সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় যতীন্দ্রমোহনের প্রথম যুগের কবিতা একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকলে তিনি কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পল্লী জীবনের সুখ-দুঃখের কথা তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। কাজলদিদি ও অন্ধবন্ধু তাঁর দুটি বিখ্যাত কবিতা। ‘রবীন্দ্রনাথ ও যুগসাহিত্য’ তাঁর বিশেষ একটি গদ্য গ্রন্থ। ১৯৪৮ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কাজলা দিদির কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ৬৭তম মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। 
 
১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর পশ্চিম বাঙলার নদীয়া জেলার জমশেরপুরের বিখ্যাত বাগচী জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী। বাবা হরিমোহন বাগচী এবং মা গিরিশমোহিনী দেবী। বাগচী পরিবার ছিল তখনকার একটি মুক্তচিন্তার পাঠশালা। এ পরিবারের রামপ্রাণ বাগচী, জ্ঞানেন্দনারায়ণ বাগচী ও কবি দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী তখন সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত নাম। যতীন্দ্র মোহন বাগচীর ঠাকুরদা রামগংগা ছিলেন নাসিরপুর রাজার দেওয়ান। তার বাবা হরিমোহন বাগচী ছিলেন জেলার সম্মানী ব্যক্তি। যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও সাধারণের সাথে মিশেই তিনি শৈশব পার করেছেন। শৈশব-কৈশোর থেকেই তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সাধারণ জীবন-যাপনের প্রতি। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার জ্যাঠামশায়ের কাছে। জ্যাঠামশায়ের কাছে পাঠ্যপুস্তক নয়, তিনি পড়েন মহাভারত, কৃত্তিবাসের সপ্তকাণ্ড ও রামায়ণ। জ্যাঠামশায়ও নিবিড়ভাবে শুনতেন যতীন্দ্র মোহন বাগচীর এই পড়া। তার প্রথম একাডেমিক জীবন শুরু বহরমপুরের খাগড়াতে মিশনারী স্কুলে। শৈশবেই তিনি তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকদের বিস্মিত করে ফেলেন। পরে তিনি ভর্তি হন কলকাতা হেয়ার স্কুলে। প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফ. এ ও বি.এ পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে নদীয়াস্থ জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এসবে তার মন বসল না। তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে তিনি পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার শৈশব জীবনের লেখা তখনকার আলো ও উৎসাহ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। 
 
জমিদারবংশে যতীন্দ্রমোহনের জন্ম হলেও কর্ম জীবনে যতীন্দ্রমোহন বাগচী উপার্জনের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করেছেন। প্রথম জীবনে সাহিত্যানুরাগী বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন।পরবর্তিতে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স কালেক্টর হিসেবে এবং এফ.এন গুপ্ত কোম্পানীর ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। সেই সময় নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং মহারাজ যতীন্দ্রমোহনকে প্রাইভেট সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত করেন। যদিও মহারাজ মানসী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, কিন্তু তিনি নামে মাত্র সম্পাদক ছিলেন, যতীন্দ্রমোহনই ছিলেন মূল পরিচালক। তিনিই ক্রমশ পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। মহারাজের মৃত্যুর পর এফ এম গুপ্তা পেন্সিল কোম্পানির ম্যানেজার পদে যোগ দেন। পরে কোলিয়ারির কাজ, ব্যবসা ইত্যাদি বিভিন্ন রকম কাজই তিনি করেছেন। তিনি বহু সাহিত্যিক পত্রিকায় গঠনমূলক অবদান রেখেছেন। মানসী, বঙ্গদর্শন, সাহিত্য, ভারতী, প্রবাসী, সাধনা, সবুজপত্র, মর্মবাণী, পূর্বাচল, যমুনা ইত্যাদি পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে তিনি লিখেছেন। বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত মানসী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মর্মবাণী পত্রিকার সঙ্গে তাঁকে যুক্ত দেখা যায়। ১৯২১-১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অবধি যমুনা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং প্রথম সংখ্যা থেকে আমৃত্যু পূর্বাচল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পূর্বাচল পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক ছিলেন। তার রচনায় তার সমকালীন রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করে যায়। তাঁকে রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করে হয়। যতীন্দ্রমোহন যেমন রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি যতীন্দ্রমোহনকে খুবই স্নহে করতেন, তাঁর কবিতাকে ভালোবাসতেন। যতীন্দ্রমোহনের ’নাগকেশর’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনাতে বিশ্বকবি বলেছিলেন ” তোমার লেখনী তোমার কবিত্বকে পক্ষিরাজ ঘোড়ার মতন এখনও সমান বেগে বহিয়া লইয়া চলিয়াছে। … তোমার নিপুণ ছন্দের পায়ে পায়ে অনায়াস নৃত্যলীলার নূপূর বাজিতেছে, আবার তাহার হাতে ও মাথায় কানায় কানায় ভরা বিচিত্র রসের থালি…” 
 
(সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
পল্লী-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। "পথের পাঁচালী"র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি জীবনানন্দ দাশের মত তাঁর কাব্যবস্তু নিসর্গ-সৌন্দর্যে চিত্ররূপময়। গ্রাম বাঙলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রাম জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ সরল ভাষায় সহৃদয়তার সংগে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলোঃ 
১। সংকলিত কবিতাঃ 
(ক) লেখা (১৯০৬), (খ) রেখা (১৯১০), (গ) অপরাজিতা (১৯১৫), (ঘ) বন্ধুর দান (১৯১৮), (ঙ) জাগরণী (১৯২২), (চ) নীহারিকা (১৯২৭), (ছ) মহাভারতী (১৯৩৬) 
২। কবিতাঃ 
(ক) কাজলাদিদি, (খ) শ্রিকল, (গ) অন্ধ বধু ইত্যাদি। 
কাজলা দিদি কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর একটি অসাধারণ শোকবিধুর কাব্য গাথা। যা তাকে পৃথিবী বিখ্যাত করে তুলেছিল। সে কবিতাটি সব কালের পাঠকদেরই কাঁদায়। দিদি হারা একটা ছোট্ট মেয়ে, দিন রাত দিদিকে খুঁজে ফিরে। মায়ের আঁচল ধরে কত প্রশ্ন করে। মা দিদির কথায় আঁচলে মুখ লুকায়। হারিয়ে যাওয়া এই দিদির নাম কাজলা। কবি ও কবিতার নামকরণ করেন কাজলা দিদি। এ কবিতা পাঠককে এতবেশি মুগ্ধ করে যে, পরবতীতে কবি নিজেও হয়ে গেলেন কাজলা দিদির কবি। কাজলা দিদি পড়ে চোখের জল পড়েনি এমন পাঠক সম্ভবত কেউ নেই। ১৯৪৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন কবি ও সাংবাদিক যতীন্দ্রমোহন বাগচী। আজ তাঁর ৬৭তম মৃত্যুবাষিীকী। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঠকের জন্য নিবেদন করছি তার বিখ্যাত ও চোঁখে জল নিয়ে আসা কবিতা "কাজলা দিদি"। 
 
কাজলা দিদি 
যতীন্দ্রমোহন বাগচী 

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই 
মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? 
পুকুর ধারে, নেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাই জ্বলে, 
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই; 
মাগো, আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই? 
সেদিন হতে দিদকে আর কেনই-বা না ডাকো, 
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো? 

খাবার খেতে আসি যখন দিদি বলে ডাকি, তখন 
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো, 
আমি ডাকি, - তুমি কেন চুপটি করে থাকো? 
বল মা, দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে? 
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে! 
দিদির মতন ফাঁকি দিয়ে আমিও যদি লুকোই গিয়ে- 
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে? 
আমিও নাই দিদিও নাই কেমন মজা হবে! 

ভুঁইচাঁপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল, 
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল; 
ডালিম গাছের ডালের ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে, 
দিস না তারে উড়িয়ে মা গো, ছিঁড়তে গিয়ে ফল; 
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবে কী মা বল! 

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই 
এমন সময়, মাগো, আমার কাজলা দিদি কই? 
বেড়ার ধারে, পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোঁপে-ঝাড়ে; 
নেবুর গন্ধে ঘুম আসে না- তাইতো জেগে রই; 
রাত হলো যে, মাগো, আমার কাজলা দিদি কই?
 
 
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সাহিত্যকৃতি বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানাই থেকে গেছে যদিও তিনি আজও আমাদের মননে রয়েছেন। অপরিচয়ের যেটুকু ব্যবধান সেই টুকু দূর করা প্রয়োজন শুধুমাত্র। যদি তাঁর ছবিতে অনেকদিনের পড়ে যাওয়া ধূলো আজও আমরা ঝেড়ে নিতে না পারি, যদি তাঁর রচনাগুলিকে যথার্থ মূল্য নিরূপনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভীষণ লজ্জার হয়ে দাড়াবে।কাজলা দিদি কবিতার লেখক বিখ্যাত কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ৬৭তম মৃত্যবার্ষিকী আজ। কবির মৃত্যুদিন তার জন্য গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। 
০ Likes ০ Comments ০ Share ৯৭২ Views

Comments (0)

  • - লিপু রহমান

    পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে যার ঋণ কখনো শোধ করা যায় না তিনি হলেন মা । মা-কে নিয়ে লেখা তারিফুল ইসলামের ভালো লাগলো । শব্দের গাথুনীর দিকে খেয়াল করলে কবিতাটি আরও সুখপাঠ্য হবে ।