Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ইফ্ফাত রুপন

৮ বছর আগে

একজন বাবার গল্প

ভাই এই খেলনাটার দাম কত?

মতিন সাহেব বেশ স্পষ্ট করেই তার কথাটা বললেন। কিন্তু দোকানদার এমন একটা ভাব করলো যেন সে মতিন সাহেবের কথাটা শুনতে পায় নি। গলা খাঁকারি দিয়ে মতিন সাহেব আবারো বেশ স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করলেন,

এই যে ভাই খেলনাটার দাম কত?

এইবার দোকানদার আড় চোখে মতিন সাহেবের দিকে তাকাল। মতিন সাহেব মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। পৃথিবীতে একমাত্র মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষদেরই খুব সহজে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়। আলাদা করা যায় তাদের পরিহাস কিংবা অবহেলা সহ্য করানোর জন্য।

দোকানদার মতিন সাহেবের কথার বিশেষ কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না কারণ সে জানে দাম জিজ্ঞেস করলেও মতিন সাহেব খেলনাটি কিনবেন না। প্রতিদিন মতিন সাহেবের মতো অনেক মানুষ এখানে আসা যাওয়া করে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে কিংবা দাম জিজ্ঞেস করলেও কেউ খেলনাগুলো কিনে না। খেলনাগুলো তাদের মাপকাঠিতে বানানো হয় নি। বানানো হয়েছে সমাজের বিশেষ এক ধরণের শ্রেণীর মাপকাঠিতে।

এটার দাম পরবে ১২৫০ টাকা। আপনি নিবেন?

দোকানদার অনেক বিরক্ত হয়েছে এমনভাবে মতিন সাহেবের প্রশ্নের উত্তরটা দিল। মতিন সাহেব নিজেও জানেন তিনি খেলনাটি কিনতে পারবেন না। সেই সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু তার পরো তার মন মানে না। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তিনি খেলনার এই দোকানটিতে একটিবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারেন। যদি সস্তায় কিছু তার ছেলেটির জন্য পাওয়া যায়।

মতিন সাহেব পেশায় একজন সরকারি চাকরিজীবী। খুব সামান্য তার রোজগার। দুই সন্তান আর স্ত্রী মিলে ছোট্ট সংসার হলেও রীতিমতো সংসার চালাতে হিমশিম খান তিনি। তার ছোট্ট ছেলেটির বয়স মাত্র ৩ বছর। খুব খেলনার শখ তার এই ছেলেটির। বড় মেয়ে শান্তা ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। ঢাকা শহরের মোটামুটি ঘন বসতিপূর্ণ একটি এলাকায় ছোট্ট একটি এপার্টমেন্ট নিয়ে তিনি আর তার পরিবার থাকেন।

না ভাই আজকে থাক। আরেকদিন এসে নিয়ে যাবো।

মতিন সাহেব তার হাত থেকে খেলনাটি নামিয়ে রাখলেন। প্রতিবার যখন তিনি খেলনাগুলো না কিনতে পেরে নামিয়ে রাখেন ততবারই তার বুকের মধ্যে প্রচণ্ড শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এক মুহূর্তের জন্য তার কাছে মনে হয় বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। প্রতিদিন বাসায় যেয়ে তিনি তার ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। বাসায় ঢুকা মাত্র ছেলে তাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাবা আমার জন্য কি খেলনা এনেছ?”

মানুষের কাছে পৃথিবীর সব প্রশ্নের জবাব থাকলেও একজন বাবার কাছে তার ছোট্ট ছেলেটির এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর জানা থাকে না। মতিন সাহেবেরও এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। প্রশ্ন শুনে তিনি শুধু তার ছেলের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কোন উত্তর তার মুখ দিয়ে বের হয় না।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আগামী তিন দিন পর ঈদ।

মতিন সাহেব রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে ঈদের কারণে জিনিসপত্রের দাম তুঙ্গে উঠেছে আরেকদিকে এই মাসের বেতনটাও তিনি পাবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অফিসে কি নিয়ে যেন একটা ঝামেলা হয়েছে। উচ্চপদস্থ কিছু কর্মচারী বর্তমানে পলাতক। সবার বেতন বোনাস ঠিকি আছে মাঝখান থেকে বিপাকে পরেছেন মতিন সাহেবের মতো কিছু মানুষ। সাধারণত মধ্যবর্তী মানুষেরাই উচ্চ ও নিম্ন উভয়ের কাজের দায় বহন করে।

মতিন সাহেব কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। বাসা ভাঁড়ার টাকাও এখনো দেয়া হয় নি। তার উপর সামনে ঈদ। ঈদ প্রত্যেক মানুষের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসলেও কিছু মানুষের জীবনে এই ঈদ ই আসে অভিশাপ হয়ে।

মতিন সাহেব দরজায় টোকা দিচ্ছেন। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পর তার ছোট ছেলে তার জন্য দরজা খুলে দেয়। আজো এর ব্যাতিক্রম হোল না। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজ তার ছেলে রুহান বাবাকে জড়িয়ে ধরল না। খেলনার কথাও জিজ্ঞেস করলো না। দরজা খুলে সোজা ভেতরের রুমের দিকে চলে গেল।

হাত মুখ ধুয়ে আর কাপড় পাল্টে মতিন সাহেব তার রুমে ঢুকে দেখলেন তার ছেলে বিছানায় শুয়ে আছে। তার এই ছেলেটি অনেক প্রাণোচ্ছল একটি ছেলে। অবেলায় কখনো তিনি তাকে শুয়ে থাকতে দেখেন নি। রুহান সারাক্ষণই কিছু না কিছু দিয়ে খেলা করে। কিন্তু আজ সে এভাবে বিছানায় শুয়ে আছে কেন তিনি বুঝতে পারলেন না। তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,

রাহেলা, রুহানের কি হয়েছে? এই অবেলায় শুয়ে আছে কেন? বকা দিয়েছ নাকি?

না।

তাহলে?

তাহলে কি? সারাদিন তো বাসায় থাকো না। সংসারে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার খোঁজ খবর কি তোমার আছে?

আহা বল না কি হয়েছে?

রাহেলা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, বাবুর পেট খারাপ। আজ সকাল থেকে। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পরেছে বেচারা। মনে হয় ডায়রিয়া হয়েছে। ডাক্তার দেখানো লাগবে।

মতিন সাহেব ছেলের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন তার ছেলেটি শরীরের এই অবস্থাতেও বসে বসে তার একটি গাড়ি নিয়ে খেলা করছে। রুহানকে দেখে বুঝা যাচ্ছে যে ছেলেটি অনেক দুর্বল হয়ে পরেছে। একদিনের ধকলে তার চোখ গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে। ছেলেটি বসে থাকতে পারছে না। খেলতে খেলতে এক পর্যায়ে তার ছেলেটি পাশে রাখা বালিশের উপর কাত হয়ে শুয়ে পরল। যে মুখে সবসময় এক চিলতে হাসি লেগে থাকতো সেই মুখ এখন ভাবলেশহীন রুহানের। খালি বাম হাতে আলতো করে তার ছোট্ট খেলনাটিকে এখনো ধরে রেখেছে সে।

মতিন সাহেব রুহানের কাছে ছুটে যাবার আগেই তার স্ত্রী রুমে ঢুকলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে রুহানকে বললেন,

এই শুয়ে আছিস কেন? ওঠ। উঠে বস। শুয়ে শুয়ে খেলছিস কেন? শুয়ে থাকলে কি কাজ হবে? তোর বাবার কি সেই মুরুদ আছে তোকে ডাক্তার দেখানোর। উঠে বস।

রুহান উঠে বসলো। মতিন সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

পৃথিবীতে একমাত্র নারীরাই পারে একজন পুরুষের সবচাইতে দুর্বল দিকগুলো খুব নির্মমভাবে তার সামনে তুলে ধরতে। ঈশ্বর তাদের সেই ক্ষমতা খুব সুক্ষভাবে প্রদান করেছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কাল ঈদ।

সব মিলিয়ে মতিন সাহেবের পকেটে এখন আছে মাত্র ৮৭ টাকা। মতিন সাহেব কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এই কয়দিনে ছেলের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে তার। ডাক্তার ঔষধ সব কিছু মিলিয়ে তার কাছে যা ছিল সবই শেষ করেছেন তিনি। ছেলেকে সুস্থ করতে গিয়ে তার এটা আর মনে ছিল না যে সামনে ঈদ রয়েছে।

মতিন সাহেবের বাসায় ঈদের জন্য কোন বাজার করা হয় নি। সকাল বেলা যে একটু খানি সেমাই খাবেন সেই সেমাই কেনার টাকাটাও তার কাছে নেই। আজকে তিনি তার ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তার ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করেছে, “ বাবা আমাদের এবার জামা কিনে দিবে না ?”

সন্ধ্যায় মতিন সাহেবের স্ত্রী তার কাছে বাজার করার জন্য টাকা চাইলেন। লজ্জায় অপমানে মতিন সাহেবের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না তখন। মানি ব্যাগ থেকে তার শেষ সম্বলটা বের করে তিনি তার মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “ মারে আমার কাছে এটা ছাড়া আর কিছু নেই ।”

সেদিন তার স্ত্রী কিভাবে বাজার করে এনেছিলেন মতিন সাহেব তা জানেন না। জানার চেষ্টাও করেন নি। পরদিন সকালে মতিন সাহেব নামাজ পড়ে এসে দেখেন তার বাসায় তালা ঝুলছে। তার স্ত্রী তার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে তার বাবার বাসায় চলে গেছে। দুপুর পর্যন্ত তিনি বাসায় বসে থাকলেন। নিঃসঙ্গতা মানুষ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। দুপুরে কিছু না খেয়ে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তিনি কমলাপুর রেল ষ্টেশনে চলে এসেছেন তা তিনি নিজেও খেয়াল করেন নি। বেশ খানিকক্ষণ এখানে সেখানে হাঁটাহাঁটি করে তিনি একটা বেঞ্চের উপর বসে পরলেন। কোন একটা কারণে তার এখন আর কোন কিছুর বোধ হচ্ছে না। প্রচণ্ড কষ্ট পেলে মানুষ একসময় পাথরের মতো হয়ে যায়। তখন আর কষ্ট ঠিকমতো অনুভব হয় না।

কিছুক্ষণ পর একটি ট্রেন এসে ষ্টেশনে থামল। ঈদের দিনও যে ট্রেন চলাচল করে তা মতিন সাহেবের জানা ছিল না। বেশ কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নামতে শুরু করলো। তার ঠিক সামনেই অল্প বয়সী কিছু ছেলে মেয়ে অনেক মালপত্র ও ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নামলো। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই একটি ছেলে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “মামা ব্যাগগুলো গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিয়ে আসেন। ২০ টাকা করে পাবেন।”

মতিন সাহেব কিছুক্ষণ ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উঁচু স্তরের মানুষেরা প্রায় সময় মানুষ চিনতে ভুল করে এই কথা তিনি শুনেছিলেন কিন্তু তার মতো একজন গ্রেজুয়েশন শেষ করা সরকারী কর্মকর্তাকে এভাবে কুলির সাথে তুলনা করে ফেলবে এই কথা তিনি কখনো কল্পনাও করেন নি। ছেলেটিকে তিনি মানা করতে যাবেন এমন সময় তার ছেলে রুহানের কথা তার মনে পরল। ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “বাবা আমাদের এবার জামা কিনে দিবে না?”

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সন্ধ্যায় যখন তিনি তার শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছালেন তখন তার সারা গায়ে এবং ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। হাঁটুতে এতো ব্যাথা করছে যে তিনি ঠিকমতো দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছেন না। এই অবস্থায় তিনি কলিংবেল চাপ দিয়ে ধরে রাখলেন। তিনি মনে করেছিলেন কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিবে কিন্তু দরজা খুলল তার ছেলে রুহান। বাবাকে দেখে চিৎকার করে উঠলো, “মা বাবা এসেছে”।

মতিন সাহেব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। দরজার কাছে হাঁটু গেঁড়ে পরে গেলেন। হাতে ধরে রাখা জামা দুটো তার ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবারে এই নে। তোদের জন্য ঈদের জামা এনেছি”।

বলতে গিয়ে মতিন সাহেবের চোখে পানি চলে এলো। কিন্তু সেই পানি তিনি তার ছেলেকে দেখতে দিলেন না। নীরবে শার্টের হাতা দিয়ে মুছে ফেললেন।

পৃথিবীর কোন বাবাই চান না যে তার চোখের পানি তার সন্তানেরা দেখুক।  

 

 

                         --------------

 

 

 

     
০ Likes ২ Comments ০ Share ৯২০ Views