মৌমিতা, কয়েক মাস আগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছে ঢাকার এক কলেজে । কলেজের হোস্টেলে থেকেই পড়ালেখা করে সে । পড়ালেখার সূত্র ধরেই এক বান্ধবীর বড় ভাই সাইফের সাথে পরিচয় । বেশ কিছুদিন ধরে সাইফের সাথে তার বন্ধুত্বের রসায়নটাও বেশ চলছে । একজন আরেকজনকে বেশ ভালো বুঝে । একই ডিপার্টমেন্টের শেষ বর্ষের পরীক্ষার্থী সাইফ । আর তাই পড়ালেখায়ও সাইফের কাছ থেকে বেশ সহায়তা পায় মৌমিতা ।আর এভাবেই তাদের দু’জনার দুই পথে হাঁটার রাস্তাটা দিনে দিনে ক্রমশঃ যেন একই পথে এসে ঠেকেছে ।
মৌমিতার ভাবনায় সাইফ বেশ ভালো ছেলে । মনটাও বেশ পরিষ্কার । এমন একটা ছেলেকেই যেন মৌমিতা তার জীবনের জন্য চেয়েছিল । কিন্তু... ? এ যে হবার নয় ! কি করে সাইফের কাছে সত্য লুকাবে সে । সাইফের ভাবনায় ঠোঁটের কোণে জমে থাকা আলতো হাসিমাখা মুখটা হঠাৎই যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায় মৌমিতার । ঐ মুহূর্তে একা রুমে নিজকে যেন বড্ড বেশি একা মনে হয় মৌমিতার ।
ওদিকে সাইফের ভাবনা জুড়েও মৌমিতা । ‘সামনেই ভ্যালেন্টাইন ডে । এ সুযোগে যে করেই হোক মৌমিতাকে মনের কথাটা বলতেই হবে।’ -মনে মনে ভাবতে থাকে সাইফ । ভাবতে ভাবতেই মোবাইল হাতে নিয়ে মৌমিতার নাম্বারে রিং দেয় সে । অপর প্রান্তে মৌমিতা...
-হ্যালো সাইফ !
-হুম..কেমন আছো মৌ ?
-এইতো... ভাল । তুমি কেমন আছো ?
-এই...তো আছি.. । তারপর পরশু ভ্যালেন্টাইন ডে-তে কোথায় যাচ্ছ ?
-ভ্যালেন্টাইন ডে শুনে কেমন যেন চুপ (অন্যমনস্ক) হয়ে যায় মৌমিতা ।
-হ্যালো !
-(নীরবতা ভেঙ্গে মৌমিতা) না, কোথাও যাচ্ছি না !
-তুমি যাচ্ছ !
-কোথায় ?
-আমি যেখানে নিয়ে যাব !
-না, সাইফ । আমি যেতে পারব না । আমার অনেক কাজ আছে ।
-আমি সেদিন সকাল ৯ টায় সেখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । তুমি অবশ্যই আসবে । জরুরী কথা আছে ।
মৌমিতাকে কোন সুযোগ না দিয়ে নিজের কথা শেষ করেই কল কেটে দেয় সাইফ । মৌমিতা জানে, সাইফ কি বলতে চায় । মৌমিতা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তার কি করা উচিত । অনেক ভাবনার পর মৌমিতা সিদ্ধান্ত নেয় সে যাবে । তার অতীত জীবনের না বলা কথাগুলো সাইফকে জানিয়ে দেবে সে । এরপরও যদি সাইফের কিছু বলার থাকে...বলবে ।
ভ্যালেন্টাইন ডের সকালে ঠিক সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে আছে সাইফ- যেখানটায় মৌমিতার সাথে প্রায়ই কথা হয় তার । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দূর থেকে মৌমিতাকে দেখতে পেল সাইফ । ভেতরে যেন হঠাৎ খুশির ঢেউ খেলে গেল তার । মৌমিতা আসার সাথে সাথেই সাইফ বলতে শুরু করলো-
-আমি জানতাম তুমি না এসে থাকতে পারবে না ! আমার বিশ্বাস ছিল- তুমি আসবেই ।
-আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, সাইফ ।
-উহু, আজ শুধু আমি বলবো, তুমি শুধু শুনবে মৌ । দেখো আমার কিন্তু আর দেরী সইছে না ! তুমি চোখ বন্ধ কর ! একটা সারপ্রাইজ আছে ।
-কিন্তু সাইফ ?
-কোন কিন্তু নয় ! চোখ বন্ধ কর বলছি ।
মৌমিতা চোখ বন্ধ করে । সাইফ হাঁটু গেড়ে প্রেম নিবেদনের ভঙ্গিতে হাতে লাল গোলাপ নিয়ে মৌমিতাকে চোখ খুলতে বলে । মৌমিতা চোখ খোলার সাথে সাথেই প্রেম নিবেদন করে সাইফ-
-(লাল গোলাপ হাতে নিয়ে) আমি তোমাকে ভালবাসি মৌ । আমি শুধু তোমাকে চাই ।
-কিন্তু সাইফ ? আমার কিছু বলার আছে !
-(মৌমিতার কথা টেনে নেয় সাইফ) আমাকে তোমার পছন্দ নয় মৌ ? তুমি আমাকে ভালোবাসো না ?
-না, সাইফ ঠিক তা নয়... ! আমি আসলে...
-আমার আর কিছু জানার নেই মৌ । আমি উত্তর পেয়ে গেছি । আই লাভ ইউ মৌ । লাভ ইউ সো মাচ । মৌ আজ আমরা অনেক দূরে ঘুরতে যাব । শুধু তুমি আর আমি ।
বলতে বলতেই মৌমিতার হাত ধরে সাইফ । মৌমিতা কিছু বলার সুযোগ পায় না । চট্টগ্রামের সী-বীচ সাইফের বেশ পছন্দের জায়গা । নিজের গাড়িতে করে মৌমিতাকে সাথে নিয়ে সেদিকেই ছুটে চলে সে । বিকেল হতে হতে সী-বীচে পৌঁছে যায় তারা । গল্প করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে । মৌমিতার মনে প্রশ্ন জাগছে- রাতে ওরা থাকবে কোথায় ? আবার কি সেই হোটেল ? মনে মনে ভয় জাগে মৌমিতার ! এর মাঝেই সাইফ উঠে পড়ে-“চলো উঠি, আজ তো আর ফেরা সম্ভব নয় ! এখানেই ভালো কোন হোটেলে রাতটা কাটিয়ে দিতে হবে ।” সাইফের কথা যেন মৌমিতার সেই আশংকা সত্য হবারই পূর্বাভাস । “তবে কি আবারো ?”-মনের ভাবনাটাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় মৌমিতার ।
সাইফ হোটেলে গিয়ে পাশাপাশি দু’টো রুম ভাড়া করে । মৌমিতা যেন কিছুটা স্বস্তি ফিরে পায় । সাইফ সম্পর্কে আজে-বাজে ভাবতে থাকা চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরে যায় । তবে একা রুমেও যে মৌমিতা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছে তেমনটাও নয় । দু’বছর আগের ভ্যালেন্টাইন ডে-র স্মৃতি যেমন তাকে ঘুমোতে দেয়নি তেমনি সেই ঘটনা সাইফকে বলতে না পারার বিষয়টাও । সকালে উঠে ঢাকায় ফিরে আসে দু’জন । মৌমিতাকে হোস্টেলে পৌঁছে দেয় সাইফ । ফেরার পথে সাইফকে দু’একদিন পর আবার দেখা করতে বলে মৌমিতা । সাইফ সম্মতি দেয় ।
আজ মৌমিতা সাইফকে সব খুলে বলার সুযোগ পেয়েছে । মৌমিতা কলেজ জীবনের শুরুতেই একটা ছেলেকে ভালোবাসে । দু’বছর আগের এক ভ্যালেন্টাইন ডে-তে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাইফের মতো করেই তাকে ঘুরতে নিয়ে যায় সে । তার সাথেও সেই রাতে হোটেলে থাকতে হয় তাকে । কিন্তু দু’বছর আগে সেই ছেলের সাথে হোটেলের এক রুমে থাকা মৌমিতার সেই রাতটা কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না । কৌশল করে এক রুমে রেখে ভালবাসার দুর্বলতার সুযোগে সেই রাতে মৌমিতাকে জীবনের অভিশপ্ত এক রাত উপহার দেয় সে । বলতে গিয়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে না মৌমিতা । এরপর মৌমিতা তার সম্পর্কের স্বীকৃতি চাইলে ছেলেটি ধীরে ধীরে মৌমিতার জীবন থেকে দূরে সরে যেতে থাকে । একটা দূরত্বের দেয়াল যেন গড়ে উঠে দু’জনের মাঝখানে । এক পর্যায়ে এমন আরেকটি ঘটনার জের ধরে জেলে যেতে হয় ছেলেটিকে । তারপর থেকে আর যোগাযোগ হয় না তাদের ।
মৌমিতার জীবনের এতো বড় সত্য জেনে সাইফ অনেক কষ্ট পায় । কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে সে । এরই মাঝে মৌমিতা ভারী কণ্ঠে বলতে থাকে-“আমি জানি সাইফ, এরপর তুমি আর আমাকে ভালো জানবে না, মন থেকে তোমার ভালবাসা হিসেবে মেনে নিতে পারবে না । বিশ্বাস করো সাইফ- আমি সেদিনই তোমাকে আমার জীবনের এই কথাগুলো বলতে চেয়েছি । তুমি আমাকে বলার সুযোগই দিলে না সেদিন । আমি তোমাকে এভাবে আঘাত করতে চাইনি । যদি পারো- আমাকে তুমি ক্ষমা করো সাইফ । আমাকে ক্ষমা করো ।”
কথা শেষেই অশ্রুসিক্ত নয়নে হাঁটতে শুরু করে মৌমিতা । পেছন থেকে সাইফ ডাক দেয়-“দাঁড়াও মৌ !” সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজের দু’হাত দিয়ে মৌমিতার হাত ধরে সাইফ । “দেখো মৌ, আমি তোমাকে ভালবাসি ! আমি তোমার অন্য কিছু নয়, শুধু তোমার সুন্দর আর পবিত্র মনটা দেখেই ভালবেসেছি । তোমার সেই মনটা আজো আমার কাছে আগের মতোই সুন্দর, পবিত্র । তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা শুধুই একটা দুর্ঘটনা । সেটার জন্য তুমি কেন নিজেকে দায়ী করছো ? তুমি কেন দোষী ভাবছো নিজেকে ? তুমি হয়তো আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না ! তুমি যেওনা মৌ ! প্লীজ তুমি যেওনা”-একের পর এক কথাগুলো বলে যায় সাইফ ।সাইফের চোখের দিকে তাকিয়ে মৌমিতা চোখের জল আর আটকে রাখতে পারে না ! সাইফকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে হুহু করে কাঁদতে থাকে সে ।