Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আবিরের লাল জামা



আবির: বাবা, ও বাবা, কথা বলো। আমি আর রিমোট গাড়ি, লাল জামা চাইব না। তুমি কথা বলো। [রুদ্রের ছেলে আবির ঈদের আবদার ছিলো লাল জামা আর রিমোট কন্ট্রোল একটি গাড়ি। দারিদ্রের করালে রুদ্র আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। হাসপাতালের মেঝেতেই তার অবস্থান।]


প্রতিদিনের মতো সেদিনও রুদ্র পেটের দায় ঘোচাতে পাখি ডাকা ভোরে কাজের সন্ধানে বের হয়। রমজান মাস রোজা রাখলে চাল ডালের খরচটা কিছু কমে। তারপর আল্লাহর হুকুম মেনে চলা যায়। জীবনটা ও বেঁচে যায় অর্থেরও কিছু অভাব পূর্ণ হয়। রোজার মাসটি এভাবে কাটছে রুদ্রের সংসারে। স্ত্রী, রুদ্র ও তার ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান।

প্রতিদিন কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হবে তখন ছেলের বাবা বলে ডাকাডাকি। একমাত্র আল্লাহই জানেন এই ছেলেটি কিভাবে টের পায় বাসা থেকে বের হবো।

আবির: বাবা, কোথায় যাও ?
রুদ্র: কাজে যাই বাবা। তুমি ঘুমাও নি।
আবির: ঘুমাইছিলাম তো,
রুদ্র: তা এখন তোমার মায়ের সাথে ঘুমাও
আবির: ঘুমাবো বাবা, আমার কথা তোমার মনে আছে?
রুদ্র: কি বাবা ? [অনিচ্ছাকৃত রুদ্র তার ছেলে আবির কে জিজ্ঞেস করল। রুদ্র নিজেই জানে ছেলেটি কি বলবে। তবুও ছেলের আবদারের কথা ছেলের মুখ থেকেই শুনতে ভাল লাগে।]

আবির: আমার রিমোট গাড়ি, লাল জামা। তুমি প্রতিদিন ভুলে যাও কেন বাবা? আমি তো বেশি চাই নাই। এই গাড়ি আর জামা। কোনদিন দিবে বাবা?

রুদ্র: দেখি বাবা, কাজ করে টাকা নিয়ে আসি, তারপর দু'জনে বাজারে গিয়ে কিনে দেব। [রুদ্র আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে আর আনমনে অন্য দিকে তাকি সান্ত্বনার কথাগুলো বলছে।]

ছেলের কপালে, দু'গালে, নাকে, ঠোটে প্রতিদিনের মতো চুমু খেয়ে আজকেও কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলো। উত্তরা আজমপুর হাট বাজারের মতোই লেবারদের হাট বসে। কপাল ভাল হলে স্যারদের ডাক মিলে না হয় ঝুরি, কোদাল, শাবল নিয়ে বসে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। একে একে সবাই কাজ পায় সবাই চলে যায়, রুদ্রের কাজ নাই। অনেক মহাজনকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে,
রুদ্র: স্যার, আমাকে একটা কাজ দিন। আমার কাজের প্রয়োজন। খুব কষ্টে দিন কাটছে।
রুদ্রের আকুতি মিনতি কেউ শোনে না। একদিন এক স্যার (সুমন) বলে ফেললো,
সুমন স্যার: আরে বাবা তুমি তো এই কাজের জন্য জন্মাও নি। আর এই কাজ তুমি করতে পারবে না। লেবারের কাজ খুব কষ্টের। তোমার চেহারা শরীর দেখে মনে হচ্ছে তুমি নতুন। না, বাবা, তোমায় কাজে নিয়ে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে পারবো না। ভারি কাজ না হলে তোমাকে নিতাম। জানি তুমি কষ্টে এই পথে এসেছো।

রুদ্র: অসহায় ও ক্লান্ত প্রাণীর মতো নেতিয়ে ইট বেছানো রাস্তা বসে রইল। একটি হাত মাথার একপাশে রেখে ভর করে কি যেন ভাবছে। লেবার বাজারে সে একাই বসে আছে, একটি কাজের আশায় ছেলের কথা তার মনে পড়ছে বার বার। কতদিন হলো ছেলের একটি চাহিদাও পূর্ণ করতে পারছে না। রোজাও প্রায় শেষ, আর মাত্র দু'দিন বাকি আছে। নানান ভাবনার অবসান ঘটলো। কে যেন ডাকছে।
রফিকুল স্যার: এই ছেলে, তুমি কি কাজ করবে?
রুদ্র: কি কাজ স্যার?
রফিকুল স্যার: ছোট করে কুপ খুরতে হবে। ধরো পাঁচ ফুট। পারবে কি ? ভাল পয়সা দেবো।
রুদ্র: পারবো স্যার [কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই রুদ্র রাজি হয়ে গেলো।]
ঝুড়ি, কোদাল, শাবল হাতে নিয়ে উঠে দাড়াল রুদ্র।
রুদ্র: চলেন স্যার, আমি ইফতারির আগেই কাজ শেষ করব।
রফিকুল স্যার: চলো, আমার পিছু পিছু আসো...রাস্তা পাড় হয়ে রিকসা নেব। ১১ নং সেক্টর।
আজমপুর ওভারব্রীজ পাড় হয়ে রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে থেকে রিকসা নিল। দু'জন রিকসায় বসে চলতে থাকলো। হঠাৎ কেন যেন রফিকুল স্যার বললে ফেললো,
রফিকুল স্যার: আচ্ছা তুমি কি আমার একটা সত্য কথা বলবে?
[রুদ্রের মাথা সেই একই যন্ত্রণার ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে, এবারও কি তীরে এসে তরী ডোবাব। সত্য বলবো নাকি মিথ্যা কথা বলবো। রোজা রেখেছি সত্য কথাই বলা ভাল। যা হবার তা তো হবেই।
রফিকুল স্যার: কি ভাবছো তুমি?
রুদ্র: না, স্যার তেমন কিছুই না বলুন। আমি সত্য কথা বলবো। আপনি কি জিজ্ঞেস করবেন করুন।
রফিকুল স্যার: আচ্ছা তোমায় দেখতে তো লেবারের মতো দেখায় না। এই শরীরে কি এতো কষ্টের কাজ করতে পারবে?
রুদ্র: পারবো স্যার। আমাকে যে পারতেই হবে।
রফিকুল স্যার: পারতেই হবে মানে ?
রুদ্র: স্যার, অনেকদিন হলো ভাল একটা কাজ করতে পাই না। সংসারে টানা হেচড়া লেগে রয়েছে। ছেলের আবদার সেটাও মেটাতে পারি না। প্রতিদিন ছেলেটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বাসা থেকে বের হই। একটা রিমোট গাড়ি, একটা লাল জামা।
[কথাগুলো বলতে বলতে রুদ্রের চোখ দিয়ে গড়িয়ে জল পড়তে থাকলো, গলার গামছা দিয়ে চোখের জল মুছে ফেললো রুদ্র।

রফিকুল স্যার: কি বলো তুমি? তোমাকে কেউ কাজে নেয় না ?
রুদ্র: যেই দেখে সে আপনার মতোই প্রশ্ন করে, আর বলে তুমি এতো কষ্টের কাজ পারবে না। স্যার কেউ আমার ভেতরের কথা বুঝে না। আমি যদি ভাল পড়ালেখা জানতাম তাহলে কি আর এই কাজ করতে আসতাম। আজ যদি কোন কাজ না পেতাম নিজের বিবেকে বিক্রি করে দিতাম।
রফিকুল স্যার: বিবেক বিক্রি, সেটা কিভাবে ?
রুদ্র: স্যার, চুরি ছাড়া তো আমার কোন পথ খোলা ছিলো না। ঈদের আর আছে দু'দিন। খাই আর না খাই সন্তানের দাবি তো পূর্ণ করতে হবে। প্রতিদিন মিথ্যা কথা বলে ঘর থেকে বের হই।
রফিকুল স্যার: আচ্ছা তুমি কাজ করো, কাজের টাকা তুমি পাবে আর তোমার ছেলের রিমোট গাড়ি আর লাল জামা পাবে সেটা আমার পক্ষ থেকে দিবো। তা তোমার ছেলের বয়স কত?
রুদ্র: চার বছর স্যার,
রফিকুল স্যার: তোমাকে বাসায় নিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে আমি মার্কেটে আসবো। আর তুমি পড়া লেখা কতদূর পর্যন্ত করেছো ?
রুদ্র: স্যার বাবা,মা থাকা পর্যন্ত এসএসসি পাশ করেছি। বাবা মায়ের বড় আশা ছিলো আমাকে নিয়ে। এক দূর্ঘটনায় আমার একা করে চলে গেলেন দু'জনে। বাড়ির সবাই পড়ালেখা নিয়ে প্রশংসা করতো স্যার। আমি নাকি ভাল ছাত্র।
রফিকুল স্যার: তোমার বাবা মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি । তোমার একটা ব্যবস্থা আমি করে দেবো। তোমাকে আর এই কাজ করতে হবে না।

রিকসা ১১ নং সেক্টেরের ১১ নং রোডে ১১ নং বাসার সামনে গিয়ে হাজির। রিকসা থেকে রুদ্র নেমেই স্যারের পা ছুয়ে সালাম করে নিলো।
রুদ্র: স্যার আল্লাহ আপনাকে অনেক বড় করুক। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।
রফিকুল স্যার: আগে এই কাজটি করো তুমি। আচ্ছা তোমার নামটি জানা হলো না, তোমার নাম কি ?
রুদ্র: রুদ্র আমিন, সবাই রুদ্র বলে ডাকে।
রফিকুল স্যার: খুব সুন্দর তোমার নাম। চলো....
[রুদ্র স্যারের পিছু পিছু হাটতে লাগল। স্যার যেখানে কুপ হবে সেই জায়গায় রুদ্রকে দিয়ে দিলো।] রুদ্র সাবধানে কাজ করো, কুপ খুরতে গেলে পাশের মাটি কিন্তু ভেঙে পড়ে। তুমি সাবধানে কাজ করতে থাকো, আমি বাসা থেকে মার্কেটে যাবো। আর তুমি এখানেই ইফতারি করবে।
রুদ্র: মাথা নেড়ে সম্মতি জানানো।

রুদ্র আপন মনে কুপ খুরতে থাকলো, আনন্দে আনন্দে আজ রুদ্রের কষ্টগুলোকে কষ্ট মনে হচ্ছে না। মনে হয় আজ রুদ্রের ঈদের আনন্দ লেগেছে। প্রায় কাজ শেষ, স্যারও মার্কেট থেকে বাসায় চলে এসেছেন। ছেলের রিমোট গাড়ি আর লাল জামা নিয়ে মহাজন রুদ্রের নিকট গেলেন। রুদ্র কাজ করছে।

রফিকুল স্যার: রুদ্র আর কতক্ষণ লাগবে? তুমি তো অনেক কষ্ট করতে পারো দেখি। এতো কম সময়ে তুমি এতো বড় কুপ খুরলে।
রুদ্র: স্যার মনে আনন্দ থাকলে কষ্টগুলো কষ্ট মনে হয় না। আর এখানের মাটি গুলো খুব নরম মনে হলো আমার। তাই কোদাল আর শাবল চালাতে সমস্যা হয়নি।

রফিকুল স্যার: তুমি সৎ, তোমার উদ্দেশ্য ভাল, আল্লাহ তাই তোমার কষ্টকে সহজ করে দিয়েছেন।

এসব কথা বলতে বলতেই হঠাৎ একপাশের মাটি এসে রুদ্রকে চাপ দিয়েছে। হৈচৈ পড়ে গেছে চারপাশ। জনবল পাশে ভাল ছিলো বলেই রুদ্রকে তাড়াতাড়ি গর্ত থেকে উঠানো সম্ভাব হয়েছে। রফিকুল স্যার দ্রুত রুদ্রকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে যাবতীয় চিকিৎসা করছে। রুদ্রের জ্ঞান এখনো ফিরেনি। রুদ্রের বাড়ি খবর দিবে এমন মানুষও নাই ঠিকানাও নাই।

রফিকুল স্যার: কিভাবে খবর দেয়া যায় ছেলেটির বাসায়, পাশে যত লোক জন ছিলো সবাই কে জিজ্ঞেস করছে। হঠাৎ একজন এগিয়ে এলো বললো,

তানিম: স্যার আমি রুদ্রের ঘর চিনি। আমি একবার ওর ঘরে গিয়েছিলাম।

রফিকুল স্যার: তাহলে একটু কষ্ট করে ওর স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে আসবে হাসপাতলে।
তানিম: জ্বী স্যার, পারুম।
রফিকুল স্যার: পকেট থেকে ১০০ টাকা নোট বের করে বললো তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। 
তানিম: আচ্ছা স্যার, খুব বেশি সময় লাগবে না। এই মোল্লারটেক থাকে।
[এসব কথা বলেই তানিম বের হলো হাসপাতাল থেকে। রুদ্রের বাসায় গিয়ে ছেলে এবং রুদ্রের স্ত্রীকে নিয়ে এলো। ততক্ষণে রুদ্রের জ্ঞান ফিরেছে।

ডাক্তার বিপ্রজিত: এই রোগীর অভিভাবক কে ?
রফিকুল স্যার: জ্বী বলুন, আমি

ডাক্তার বিপ্রজিত: রোগীর কপাল সত্যি ভাল বলতে হবে। তার কোন সমস্যা হয়নি। অঙ্গ প্রত্যেকটি ঠিক আছে। রোগী খুব দূর্বল । স্যালাইন দেয়া হয়েছে। আশা করি খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে। কালকেই আপনি নিয়ে যেতে পারবেন।

তানিম, রুদ্রের স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত। স্বামীর নিকট গিয়ে স্ত্রী হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। ছেলেটি তানিমের কোলে। তানিম ছেলেটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন।

আবির: বাবা, ও বাবা, কথা বলো, আমি আর রিমোট গাড়ি, লাল জামা চাইব না। তুমি কথা বলো।

এই কথাগুলো শুনে রফিকুল স্যার ছেলেটিকে কোলে নিয়ে বললো ,
রফিকুল স্যার: বাবা তোমার নাম কি ?
আবির: আবির
রফিকুল স্যার: আবির তোমার বাবা তোমার জন্য সব কিনেছে, এই দেখো, তোমার লাল জামা, রিমোট গাড়ি। তোমার বাবার কিছুই হয়নি। কিছুক্ষণ পর তোমার সাথে কথা বলবে।

রফিকুল স্যার সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে হাসপাতালের যাবতীয় বিল পরিশোধ করে রুদ্রের স্ত্রীকে বললেন, তুমি কান্না কাটি করো না, রুদ্র ভাল আছে। ডাক্তারে সাথে আমার কথা হয়েছে। আর রুদ্র সুস্থ হলে আমার বাসায় যেতে বলবে, আমি ওর জন্য চাকরি ঠিক করে রেখেছি। ওর মতো সৎ ছেলের খুব প্রয়োজন এই সমাজে।

১ Likes ০ Comments ০ Share ৪৮৩ Views

Comments (0)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    সুন্দর অনুভূতির হাহাকার

    অনেক শুভেচ্ছা দাদা

     

    • - মুদ্রা

      ধন্যবাদ :)

       

    - সোহেল আহমেদ পরান

    অনেক ভালো লাগলো কবিতা।

    দারুণ।

    emoticons

    (অনাস্তা/দারুন/ অহরনিশী/শোঁকের- বানান ক'টি একটু দেখে নেয়ার অনুরোধ করছি। )

    • - প্রলয় সাহা

      তবুও আমি চাই
      যাবতীয় অভিমানকে পাশ কাটিয়ে
      আমরা হই দারুন সকাল,মুগ্ধ বিকেল,
      খুনসুটির সন্ধ্যা,উষ্ণতা বিনিময়ের রাত,
      আমরা খুব কাছাকাছি আসি
      খুব কাছাকাছি ভাসি,
      দুজনে মিলে গড়ে তুলি আহ্লাদের সংসার।

      বানান কয়েকটা ভুল আছে দাদাভাই। লেখার ভাব-ই আলাদা। 

    • Load more relies...