Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আত্মদহন

ঝুম তালে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে আজ মেঘ যেন নতুন মিতালী করেছে মাটির সাথে। তাই বন্ধুত্বের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকে মনের মতো করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই নিয়ে পুরো তিন দিন হবে বৃষ্টির বয়স। গত শনিবার ভোর রাতে যখন নাছোড়বান্দা এই বৃষ্টির  জন্ম হয় তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রেললাইনের বস্তিবাসী। যদিও আষাঢ় আসতে এখনও দশ-পনের দিন দেরী। এসব দিন, মাসের হিসেব নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না ত্রিশষোর্ধ রফিক কিন্তু তার বউ সুমি আবার এসবে ওস্তাদ। মঙ্গল- অমঙ্গল, শুভ-অশুভ এসব বিষয়গুলো বেশ ভাল করেই মেনে চলে ও। বউয়ের চাপে মাঝে মধ্যে সেও এসব নিয়মকানুন মানতে বাধ্য হয়। আকাশের অবস্থা  ভালই দেখেই তারা ঘুমিয়েছিল। মন খারাপের কোন চিহ্ন দেখতে না পেয়ে নিশ্চিন্তে সেরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুজন আর তাদের আদরের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি শেষে রাতের বেলার টুকটাক ছোটখাট শব্দে এমন মানুষগুলোর ঘুম না ভাঙ্গারই কথা। আর তাই বৃষ্টির শব্দে তাদের ঘুম না ভাঙ্গলেও বৃষ্টির পানি যখন তাদের শরীরে এসে লাগে তখন তারা সবাই জেগে ওঠে। কেননা বস্তিঘরটার চালে বেশ কিছু জায়গায় ফুটো থাকায় খুব সহজেই ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ে। বৃষ্টি শুরু হলেই বিছানা-পত্র ভাঁজ করে ঘরের এককোণায় জড়ো করে এই পরিবারের তিনটি মানুষ গুটিঁসুটি মেরে বসে থাকে কখন বৃষ্টি থামবে সেই আশায়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর সময় কিংবা যখন আকাশ ফেটে বজ্রের হুংকারের ন্যায় বাজ পড়তে শুরু করে তখন মেয়েটি মায়ের বুকের মুখ গুঁজে সজোরে চিৎকার করে ওঠে। সেই সময় বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় রফিক যখন সুমির মুখের দিকে তাকায় তখন তাঁর কাছে মনে হয় ও যেন হাজারো প্রশ্ন করছে তাকে। মেয়ের ভয়ার্ত গলার চিৎকার, বউয়ের প্রশ্নবিদ্ধ মুখ আর মেঘের গুরুগম্ভির ডাক সব মিলে তখন একটা অন্য রকম পরিবেশের সৃষ্টি হয় তার এই ছোট ঘরটিকে ঘিরে। সেটা ভয়, আতঙ্ক নাকি শঙ্কার রফিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অসহায় পুরুষের মতো তখন সে ভাঙ্গা চালের ফুটো দিয়ে আকাশের বিচিত্র কারুকাজ দেখতে থাকে।

 

রাত দশটা। রফিক দাঁড়িয়ে আছে শহরের ব্যস্ততম এলাকা এয়ারপোর্ট মোড়ের একটা চায়ের দোকানে। সে যে কারবার করে চা দোকানে সাধারণত তার বসে থাকার কথা না। তারপরেও সে আজ বসেছে। বৃষ্টির কারণে দোকানের বেঞ্চিগুলো আগেই পরিপূর্ন হয়ে গেছে। কোন রকম ভিতরে মাথাটি ঢুকিয়ে বহু কসরৎ করে দাঁড়িয়ে যায় । বাইরে বৃষ্টি তখনও ঝিরঝির করে পড়ছেই। শহরের পিচঢালা পথে যখন ফোঁটাগুলো পড়তে থাকে তখন রাস্তার লাইটের আলোর সাথে তাদের মধ্যে একধরনের ছন্দবদ্ধ খেলার সূচনা হয়। বর্ষার দিনে যখন কেউ কেউ এভাবে আটকে থাকে এবং চিন্তা করার কোন উপায় খুঁজে পায় না তখন অনেকেই বৃষ্টি আর আলোর মধ্যকার এই ছন্দবদ্ধ খেলা উপভোগ করে।

কতই না বিচিত্র মানুষের জীবন। রফিক এই বিষয় নিয়ে যতই ভেবেছে ততই আশ্চর্য হয়ে গেছে। বৃষ্টির এই সময়টিতে চায়ের দোকানে কেউ কাউকে না চিনলেও এখন চায়ের কাপে রীতিমত ঝড় উঠেছে। রাজনীতি, পরিবেশ, সমাজ জীবন, প্রেম, মানুষ সব ধরনের আলাপ জমে উঠে এই সময়। এসব কথার শব্দে মাঝে মধ্যে ঝুম বর্ষার শব্দও অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। এইসব মানুষকে নিয়েই রফিকের কারবার। চলার পথে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে বাঁচে আরও তিনটা জীবন। সেও মাঝে মধ্যে ভেবেছে এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার। কিন্তু পারেনি। কি এক অজানা কারণে সে বার বার এপথেই ফিরে এসেছে। তিনদিন ধরে তুমুল বৃষ্টির কারণে তিনটা জীবন এখন প্রচন্ড রকমের কষ্টে আছে। বর্ষার সময় লোকজন সাধারণত বাইরে বের হতে চায় আর বের হলেও গাড়ি কিংবা রিক্সা নিয়েই বের হয়ে। আর তখন ইনকামও কমে যায় তার। যদিও বৃষ্টি কখনও তাঁর কোন কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে নি। শুধু গরীব বলে নয় যখন কারো ক্ষুধা লাগে তখন সে অন্ধ হয়ে যায়। সামনে যা পায় তাই খেতে ইচ্ছে করে। তাই গরীরের কাছে বৃষ্টি কখনও কোন সমস্যা তৈরি করতে পারে না। শুধু সাময়িক কষ্ট হয় এই যা। তারপরেও সে বৃষ্টি ভালোবাসে। ভালোবাসে বর্ষায় গুনগুন করে গান গাইতে। রফিক হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত নটা। কিন্তু আকাশ মেঘলা হওয়ায় বাইরে তাকালে মনে হয যেন এগারটাও পার হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টির রাগ কমতে থাকলে চায়ের দোকানও ফাঁকা হতে থাকে। এবার বেঞ্চিতে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে পড়ে ও। তার পাশেই যে ভদ্রলোকটি এই মুহূর্তে বসে সিগারেট ফুঁকছে তাঁর দিকে আড়চোখে দেখে নেয়। সে তৎক্ষনাৎ বুঝে নেয়  মাঝবয়সী এই মানুষটি শহরে নতুন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি প্রমাণ করে তাঁর চোখে ক্লান্তির ছাপ। যেন একটা বিছানা পেলেই ঘুমিয়ে পড়ছে মিনিটের মধ্যেই। বেঞ্চিতে বসার সময় প্যান্টের সাইট পকেটে হাতের ছোঁয়া লেগে যাওয়ায় রফিক আরও বুঝতে পারে লোকটি টাকাওয়ালা মানুষও বটে। মানুষকে ঠকিয়ে যে খায়, চলে সে খুব সহজেই এসব ধরতে পারে। অপরিচিত লোকটির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে রফিক।

 

-    ভাই আগুনটা একটু দেয়া যাবে? বলেই পকেট থেকে একটা স্টার সিগারেট বের করে। লোকটি কোন কথা না বলে এগিয়ে দেয় নিজের সিগারেটটি।

-    ভাই কি এখানেই থাকেন নাকি? প্রায়ই আপনাকে এই দোকানে দেখি। এবার সরাসরি মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করে রফিক। অথচ সে নিজেই জীবনে কখনো এই এলাকায় এসেছিল কিনা মনে করতে পারে না।

-    না ভাই, ঢাকায় এই প্রথম আসলাম। বাড়ী শেরপুর।

-    ও আচ্ছা, চেনা চেনা লাগছিল তো তাই বললাম।

-    আল্লাহর দুনিয়ার মানুষের মতো কি আর মানুষ নাই।

রফিক বুঝতে পারে শিকার অন্যদিকে মোড় নিেেচ্ছ। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, যাবেন কোথায় আপনি?

- যাবো শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যালে। বলেই লোকটি উঠে দাঁড়ায়। রফিকও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে। বলে ’আমিও তো যাবে ঐদিকে। চলেন এক সঙ্গেই যাওয়া যাক’ বলেই একপ্রকার জোর করেই লোকটির চা-বিস্কুট এর দাম দিয়ে দেয়। বৃষ্টি তখনও পড়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ে দু’জন।

 

বাসের মাঝামাঝি গিয়ে দুইটা সিটে পাশাপাশি বসে পড়ে দুজন। চায়ের দোকান থেকে বের হবার পথে ইতিমধ্যে নামটিও জেনে নিয়েছে সে। আশরাফ। বয়স পঁয়তাল্লিশ কিংবা সাতচল্লিশের কাছাকাছি। চুলগুলোয় সবে পাক ধরেছে। টেনশনে দাড়ি কাটেনি বলে মুখে খোঁচা খোঁচা অসংখ্য দাড়ির জন্ম হয়েছে। হাতে ছোট একটি ট্রাভেল ব্যাগ। যাচ্ছে নিজের মেয়ের কাছে। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ্য বলে ওকে ডাক্তারের পরামর্শে ঢাকা মেডিক্যালে আনা হয়েছে। বাস দশ মিনিট চলতে না চলতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় আশরাফ। কেউ দেখে ফেলার আগেই খুব দ্রুত হাতের কাজ সেরে নেয় রফিক। একাজে সে পাকা ওস্তাদ। পকেট থেকে টাকার বান্ডিল ও মোবাইলটা নিজের পকেটে ঢুকায়। ইতিমধ্যেই বাস এসে পৌঁছে যায় মহাখালিতে। বাস থামানোর আগেই  লাফ মেরে নেমে যায় ও। কিছু দূর যাওয়ার পর মনের অজান্তেই  মায়া হয় তার। আশরাফ বলেছিল, ঢাকা মেডিক্যালে যাবে, মেয়ে অসুস্থ্য। কিন্তু এসব ব্যাপারে কোন মায়া দেখালে চলবে না। বরং নিজেরেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাফিয়া! তার মেয়ে এখন কেমন আছে কে জানে। সেই সাত সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে। বের হবার সময় বারবার করে বলে দিয়েছে ওর জন্য কাঠিওয়ালা লজেন্স নিয়ে যেতে। ফুটপাতে উঠে এক প্যাকেট লজেন্স কিনে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় রফিক।

 

(২)

 

রোববার। অফিসের প্রথম দিন। রফিক দাঁড়িয়ে আছে শহরের ব্যস্ততম মোড় কাওরান বাজারে।  বাঁ হাতে ধরে রেখেছে একটা পেপসি সদৃশ্য বোতল। সারাদেশে তুমুল অস্থিরতা চলছে। রাজনৈতিক গোলযোগে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। মঙ্গলবার বিরোধীদল হরতাল ডেকেছে। আর সেই হরতাল সফল করার জন্যই সে দাঁড়িয়েছে এখানে। যদিও রাজনীতি সম্পর্কে তার নূন্যতম জ্ঞানও নেই। তার কাছে হাসিনা যা, খালেদাও তাই আর এরশাদ সাহেব তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন বস্তিবাসীর ভাগ্যে যে কোনরূপ পরিবর্তন হবে না এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়েছে প্রায় দশ বছর আগেই। অথচ প্রতিবারেই নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে তাদের বস্তিটাও জমজমাট হয়ে উঠে। বিভিন্ন স্তরের নেতা আর পাতি নেতার পদচারণায় ভরে যায় বস্তির ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলো। দেখা হলে ভাই বলে সম্বোধন, সালাম-কালাম দেয়ার একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সে বেশ খেয়াল করে দেখেছে এই একটা সময়েই দেশের মাথাওয়ালারা তাদের খোঁজ খবর রাখে। মাঝে মধ্যে এসব রাঘববোয়ালরা বস্তির ছোট্ট দরজায় মাথা ঢুকিয়ে বলে- কি খালা, চাচীরা সবাই ভাল আছেন তো? তখন রফিক ভাবে আহ্ দেশটা যদি সত্যিই এমন হতো। তখন হয়তো বস্তির চেহারাটাও পাল্টে যেতো। এমন সময় তুমুল হট্টগোলের শব্দ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ে তাঁর। চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে রাস্তার ঐ পারে এক লোককে গণপিটুনি দিচ্ছে সবাই। মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয় না । আনছার আলী। চরম ধুরন্ধর। কিন্তু কি কারণে এই দিন দুপুরে ধরা খেল বুঝে উঠতে পারে না। যার কাজ সে সে করবে ভেবে নিজের কাজে মন দেয়। বাঁ হাতে রাখা বোতলটার দিকে আড়চোখে তাকায়। বোতলটির মুখের দিকে একটুকরা লাল কাপড় তখনও ঝুলছে। বা হাতের বুড়ো আঙুলটা লাল বাটনের ওপর রাখা। এখন শুধু মাত্র একটা চাপ দেয়ার অপেক্ষা। বাটনে চাপ পড়লেই স্পার্ক শুরু হলে কাপড়ে আগুন দিয়ে সেটা ছুঁড়ে মারতে হবে বাসের ভেতর। বিনিময়ে সে পাবে এক হাজার টাকা। এমনই নির্দেশনা পেয়েছে সে। তার কাছে এখন টাকাটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে তার ক্ষুধার্ত বউ, অসুস্থ্য মেয়ে। এই টাকা পেলেই সে চাল-ডাল কেনার পাশাপাশি মেয়ের জন্য ওষুধও কিনবে। বস্তির বড় ভাই জয়নালের কাছ থেকে গতরাতেই সে এই কাজটির অর্ডার পেয়েছে। বাংলামোটর মোড় থেকে একটা বাস আসছে দেখে প্রস্তুত হতে থাকে। কিন্তু বাসটি কাছে আসা মাত্রই ও দেখে একটি ছোট মেয়ে মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে অবিকল রাফিয়ার মতোই, ওর মতোই বয়স হবে মেয়েটির। বাসটি চোখের সামনে দিয়ে কাওরান বাজার মোড় পেরিয়ে ফার্মগেটের দিকে চলে যায়। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে রফিক। এভাবে আরও আট-দশটি বাস চলে যাওয়ার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় আর নয়, মিরপুর দশ নম্বরের দিকে রওয়ানা হয়েছে যে বাসটি সেটিকেই টার্গেট করে ও। কাছে আসা মাত্র বাঁ হাতে রাখা বোতলটি ডান হাতে নেয়। বোতলটি ছুঁড়ে মারার ঠিক আগ মূহুর্তেই প্যান্টের বাঁ পকেটে রাখা মুঠোফোনটি বিশ্রি সুরে ডেকে ওঠায় বাঁ হাতদিয়ে যন্ত্রটি বের করে দেখে সুমির ফোন। রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে ’হ্যালো’ বলা মাত্রই চুপসে যায় রফিক। ফর্সা মুখটা মূহুর্তে লাল হয়ে উঠে। বোতলের রেড বাটনে আর চাপ দেয়া হয়না। তার মেয়ে রাফিয়াকে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছে। শরীরের প্রায় ৩০ শতাংশই পুড়ে গেছে। মুঠোফোনটিকে কানে ধরেই শাহবাগের দিকে দৌড়াতে থাকে। ঘটনাটি ঘটেছে সকালেই। মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছিল সুমি। তখনই পেট্রল বোমায় ঝলসে যায় রাফিয়ার শরীর।

 

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। বার্ন ইউনিটের সামনে অনেক লোকের ভীড়। সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভেতর থেকে ভেসে আসছে চিৎকার-চেঁচামেচি। ভীড় ঠেলে কর্তব্যরত ডাক্তারকে অনুনয় বিনয় করে ভেতর গিয়ে দেখে তার আদরের মেয়ে শুধু বাবা গো মাগো বলে চিৎকার করছে। কাছে গিয়ে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। সেও কেঁদে ওঠে। রফিকের মনে হতে থাকে সবকিছু যেন অনবরত দুলছে। চোখে আবছা দেখতে থাকে। তার মেয়ে যেন বলছে- তুমি আমার বাবা নও, তুমিও হত্যাকারী, মানুষকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছো। রফিকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা জ্বলন্ত বাস। যে বাসটিতে সে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মেরেছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের চিৎকার চেঁচামেচি আর দেখতে পায় পুড়ে যাওয়া দেহ। প্রতিটি ছেলে মেয়েকেই মনে হতে থাকে রাফিয়া। তাদের চিৎকারে যেন ভারি হয়ে উঠছে রাজপথের পরিবেশ। রফিক যেখানে বসে ছিল তাঁর তিনটা বেড পরেই একসঙ্গে তিন-চারটা মানুষের কান্না শুনে সে দিকে তাকিয়ে দেখে তার রক্ত আবারও হিম হয়ে যায়। দেখে পরশু রাতের বাসের সেই ভদ্রলোকটি। আশরাফ সাহেব। তিনিও কেঁদে চলেছেন। পাশ থেকে কেউ একজন বলল - আহ বেচারা। গতপরশুই চিকিৎসার বিশ হাজার টাকা হারিয়ে এমনিতেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, আজ আবার মেয়েটিকেও হারালো। রফিক আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। সে পাগলের মতো নিজের মেয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে -মাগো, আমি তো পা দুইড়া ধইরা শপথ করতাছি আর কুনো দিন আমি খারাপ পথে যামু না। তোরে দেইখা আমি যে আর ঠিক থাকবার পারছি না মা। সে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে সেই ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে চোখে চোখ পড়া মাত্রই ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায় রফিক।
১ Likes ১ Comments ০ Share ২৭৬ Views