Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহসান কবির

৬ বছর আগে

আকাশ বাড়িয়ে দাও

শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার

চোখ মেলে কি তাকাতে পারছেন এখন? নাকি ওষুধের ভারে ক্লান্ত আপনার চোখ খোলা সাময়িক বারণ? আচ্ছা, হাসপাতালের বিছানা থেকে মুক্ত আকাশ কতটুকু দেখা যায়? ঘুম আর ব্যথাময় জাগরণের ভেতর আপনার নিজের (প্রথম?) লেখা কি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে একবারও মনে পড়েনি? একবারও কী বলতে ইচ্ছে হয়নি-আকাশ বাড়িয়ে দাও!
সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছিলেন-ভালোবাসার পাশে একটা অসুখ শুয়ে থাকে! ২০১৮ এর ৩ মার্চ যে ঘাতক আপনাকে হত্যা করার চেষ্টা করে, ছবিতে সেই ঘাতককে আপনার পেছনেই দেখা গেছে। তাহলে কী মুক্তপ্রাণ ও মুক্তবুদ্ধির মানুষের পাশেই সমান্তরাল বসে থাকে বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত অন্ধ ঘাতকরা? কাউকে কাউকে চেনা যায় আর ঘাপটি মেরে বসে থাকা অনেককেই চেনা যায় না? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা দেশটাকে ভালোবেসে এগিয়ে আসবেন, পেছন থেকে চাপাতির কোপে তাঁদের মুণ্ডুটাই কি কেটে ফেলা হবে? চাপাতিই দেবে ওইসব অন্ধদের বেহেশতের নিশ্চয়তা? সুনীল গাঙ্গুলী আরও লিখেছিলেন, আমি মানুষের পায়ের নিচে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে! বিশ্বাসের ভাইরাসে অন্ধ আর জঙ্গিবাদের মিথ্যে ফানুসের কাছে নতজানু কুকুররা আজ লোকালয়ে নেমেছে মানুষের বেশ ধরে। এইসব মানুষের ভেতরের কুকুরটাকে চিনে রাখা খুব দরকার! এরা ফেসবুকে অন্ধ ঘাতকের পক্ষে সাফাই গায়! জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন!



নবারুন ভট্টাচার্য্য লিখেছিলেন, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। জেনে শুনে তবু এই মৃত্যু উপত্যকায় ফিরেছিলেন আপনি। বাবার বীরোচিত মৃত্যু আপনাকে সম্ভবত উজ্জীবিত করেছিল মৃত্যু উপত্যকায় ফেরার। আপনি জানতেন আপনার বাবা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ফয়জুর রহমানকে কীভাবে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আপনি জানতেন স্যার আপনার বাবাকে যখন বুলেটবিদ্ধ করা হয় সেই অন্তিম মুহূর্তে আপনার বাবা কী বলেছিলেন। বলেছিলেন- আমার আশেপাশে কেউ যদি বাঙালি থাকেন, যদি কেউ বাংলা বোঝেন তাহলে বলবেন আমাকে কীভাবে হত্যা করা হযেছিল! আমার বড় ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাঁর নাম হুমায়ুন আহমেদ!

সেই সময়টার কথা আপনারা তিন ভাই ( অন্যজন উন্মাদ সম্পাদক, লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব) ভুলতে পারেননি। পরিচয় গোপন করে গিয়েছিলেন বিশ্বাসের ভাইরাসে ভোগা ধর্মরোগাক্রান্ত (ধর্মের প্রকৃত বিশ্বাস অন্যরকম যা প্রচলিত পীর সাহেবরা আদৌ ধারণ করেন না) বরিশালের এক পীর সাহেবের কাছে। জীবন বাঁচাতে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে ধর্মের সেবক হতে হয়েছিল আপনাদের। তারপর পরিচয় জানাজানি হলে আপনাদের ওই পীরের আস্তানা থেকে চলে আসতে হয়। আপনার অসহায় মাকে নিয়ে আপনারা চড়ে বসেছিলেন নৌকায়। ওপরে খোলা আকাশ। নিচে মাথা কুটে মরছিল নদীর জল! আপনারা জানতেন না আপনাদের ঠাঁই কোথায়! তখন কী আপনার প্রথম মনে হয়েছিল যে আকাশ বাড়িয়ে দাও? ১৯৭৯-৮০ সালের কোনও একদিন, যখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, তখন রেডিওর খবরে বলা হচ্ছিল ওই পীরকে রাষ্ট্রীয় সন্মাননার পদক দেওয়া হয়েছে! জানি না আপনাদের খাবার হজম হয়েছিল কিনা!

এমন দেশে, এই মৃত্যু উপত্যকায় তবু আপনি ফিরে এসেছিলেন। দুর্ভাগ্য কখনো আপনাদের পিছু ছাড়েনি। স্বাধীনতার পর শহীদ পরিবার হিসেবে যে বাসাতে আপনারা থাকতেন, সেই বাসা থেকেও আপনাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল একদিন। সেই রাতেও পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে আপনাদের নেমে আসতে হয়েছিল খোলা আকাশের নীচে। তখনও কী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন-আকাশ বাড়িয়ে দাও? আপনারা জানতেন না পরদিন সকালে কোথায় যাবেন। আপনাদের খবর জেনে প্রয়াত লেখক আহমদ ছফা বঙ্গভবনের দিকে রওয়ানা হতে চেয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওখানে গায়ে আগুন লাগিয়ে তিনি (ছফা) আত্মাহুতি দেবেন। তার আগেই অবশ্য ঘটনার সমাধান হয়েছিল।

বিদেশে যেয়ে প্রাচুর্যের সাথেই থাকতে পারতেন আপনি। যাদের অধীনে আপনি পিএইচডি করেছেন,গবেষণা করেছেন, তাদের কেউ কেউ নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছেন। হয়তো হতে পারতেন কোন নামকরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক। কিন্তু কী যে হয়েছিল আপনার! ফিরে এসেছিলেন দেশেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িয়ে গেলেও লক্ষ কোটি টাকা কামিয়ে নিতে পারতেন। ঢাকাতে থাকলেও না হয় একটা কথা ছিল। ঢাকা থেকে দূরে দেশের এক কোনে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিয়েছিলেন আপনার কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। কী দরকার ছিল প্রমিথিউস হয়ে মানুষের ভেতর চেতনার আগুন জ্বালানোর? আকাশ কি বাড়িয়ে দিয়েছিল হাত?

যদি সেখানেও আকাশ হাত বাড়াতো তাহলে ২০০০ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হলের নামকরণ নিয়ে কেন এমন ঘটনা ঘটবে? আপনি প্রতিবাদ করেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ ‘শহর সিলেট’ নামে এক মনকাড়া লেখা লিখেছিলেন একটা জনপ্রিয় দৈনিকে। লেখাটা পড়ে চোখ ভিজে উঠেছিল অনেকের। যেদিন পরিবারের সবাই মিলে আপনারা ট্রেনে করে সিলেট যান অনশন করতে, সেদিন সারা বাংলাদেশ যেন ভেঙে পড়েছিল সেই ট্রেনে। তারুণ্যের সেই বাধভাঙা জোয়ার দেখে অভিভূত হয়েছিলেন অনেকেই। যেন ট্রেন ভর্তি তরুণদের মনের কথা ছিল এমন-কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি! ভালোবাসি বাংলাদেশ! রাজনৈতিক কোনও দলের কর্মসূচির বাইরে তরুণরা যে এমনভাবে সমবেত হতে পারে সেটা করে দেখিয়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ এবং আপনারা।

ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা নামে একজন রাজনীতিবিদ আছেন এইদেশে। তিনি একবার বলেছিলেন, একাত্তর সালে জামায়াতে ইসলামী নাকি তেমন কোনও অপরাধ করেনি! নাজমুল হুদা সাহেব সেই সময়ে নুহাশপল্লী দেখতে যেতে চেয়েছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ তখন একটি লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখায় তিনি হুদা সাহেবকে নুহাশপ্লীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন, আপনি (হুদা) যেদিন আসবেন, আমি (হুমায়ুন) সেদিন নুহাশ পল্লীতে থাকব না। শুধু গেটে আমার বাবার একটা ছবি টানিয়ে রাখব। বাবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন!

স্যার হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কি পরিবারের এতসব ঘটনা মনে পড়ছে আপনার? স্যার একবারও কি অভিজিতের ঘটনাটা মনে পড়েনি? মনে পড়েনি অভিজিতের বাবা অজয় স্যারের মুখ? মনে পড়েনি একবারও ফয়সাল আরেফিন দীপনের মুখ? স্যার দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের মতো আপনিও কি বলবেন আপনি বিচার চান না?

নাকি স্যার হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মুক্ত আকাশের দিকে যতটুকু দৃষ্টি যায় সেই দৃষ্টি থেকে কান্নার জল মুছে আপনি আবারও বলবেন আকাশ বাড়িয়ে দাও? নাকি দেশটাকে ভালোবাসার অপরাধে যে প্রাপ্তি আপনার জীবনে যোগ হলো সেটা ভোলার জন্য দীর্ঘশ্বাস চেপে হেলাল হাফিজের কথাটাই মনে পড়বে আপনার-গিয়ে থাকলে আমার যাবে কার কী তাতে? আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি!!

আপনার বড় ভাইয়ের লেখার একটা কথা তুলে ধরে শেষ করি স্যার। পৃথিবীতে বিভেদ তৈরি করে মানুষকে ঘৃণা করার অপরাধে কারও কোনও শাস্তি হয়নি। ভালোবাসার অপরাধে অনেকেরই শাস্তি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে!

প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের পর আপনি বেঁচে গেছেন স্যার। টুটুল তার প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আপনি হয়তো দেশেই থাকবেন। তবে দুঃখিনী এই দেশ আর মানুষকে ভালোবেসে ভবিষ্যতেও হয়তো কারো না কারো কপালে প্রাপ্তিযোগ ঘটবে।

তাদের উদ্দেশ্যেও কি সেই একই কথা বলবেন আপনি-আকাশ বাড়িয়ে দাও!
০ Likes ০ Comments ০ Share ১৫২ Views