অফিস ফেরত আমি সাধারণত বাসে অথবা সি.এন.জিতে করে বাসায় ফিরি। আজ এলাম হেঁটে! অফিস থেকে বেড়িয়ে দেখি; আরে! এ যে বিকেল! বাসায় যাবো কি? অফিস ফেরত খারাপ মনটা তাই ভালো হয় গেলো। সময় নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আইল্যান্ড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সাধারণত আমি খুব দ্রুত হাটি। কেউ আমাকে পেছনে ফেলতে চাইলে আমার গতি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু আজ অন্যসব দিনের মতো নয়। সারাদিনের অফিসের চাপকে একপাশে ছুড়ে ফেলে তখন আমি ডানা মেলা পাখি। ভাবনার ডানায় চড়ে উড়ে চলেছি মনের সুখে। কদিন লিখি লিখি করেও সময় হয়না। আজ একটা হ্যাস্তন্যাস্ত হওয়া চাই ই চাই। দেখি চেষ্টা করে...
প্রথম পর্বঃ অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবিটা যখন প্রথমবার দেখি তখন আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি সনটা ২০০৭। তখন পুরোটা না বুঝলেও উত্তম কুমারের অপার্থিব অভিনয় এবং সাথে মান্না দে আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলো প্রান ছুয়ে গিয়েছিল। তারপর যা হয়। আমার মাথা থেকে ফিরিঙ্গি সাহেব হাওয়া আর অন্য কোন ভূতের আগমন।
২০১৪ তে এসে যখন আমার খুঁটি গাড়বার সময় হল; যখন আমি একটু ধাতস্ত তখনই হঠাৎ ফিরিঙ্গি সাহেবের হঠাৎ আগমন! নাহ, জন্ম যার ১৭৮৬ সালে সে কি করে আবার ফিরে আসবে? কিন্তু ফিরে এলো জাতিস্বর হয়ে! আর আমার ছোট্ট মনে একটা বিরাট দাগ কেটে গেলো। যে বছর লর্ড কর্ণওয়ালিস কোলকাতায় এসেছিলেন; সেই বছর কোন একদিন পশ্চিমবঙ্গের ফরাসডাঙ্গার চন্দননগরে এক নুন ব্যবসায় পর্তুগীজ পরিবারে জন্ম হয় হ্যান্সমান অ্যান্টনির। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কোলকাতাতেই। কবিগানের প্রতি ছিল অসম্ভব টান। তাই বাবার অনুমতি নিয়েই কবিগানের দলে ভেড়েন। কিন্তু হারিয়ে যান নি। ভাষা সংকটকে পেছনে ফেলে হয়েছেন অনন্য। কঠোর অধ্যাবসায় আর পরম নিষ্ঠার সাথে গান শিখে বাংলা কবিগানকে দিয়েছেন এক অনন্য মাত্রা। সৌদামিনী নামে সতীদাহর দারপ্রান্তে উপনীত এক ব্রাহ্মণ সদ্য বিধবা রমণীকে নতুন জীবন দেন এবং পরে তাকে বিয়ে করেন। পরে সনাতন ধর্ম রীতি মেনে ঘর পাতেন সৌদামিনীর সাথে । কুর্তা টুপী ছেড়ে গায়ে তুলে নেন বাংলার পোশাক। কবিগানে তখনকার বাঘা বাঘা প্রতিযোগী ভোলা মইরা, রাম বসু, ঠাকুর সিংহকে হারিয়ে মেডেল জিতে ফেরেন। কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুদের রোষানলে পরেন। শ্লেস্বর হাতে মাদুর্গা পুজা! প্রথমে হুমকি পরে বাড়িতে আগুন আর তাতে প্রান যায় প্রিয়তমা স্ত্রী; আগুনে পুড়ে যায় মা দুর্গাসহ তার পুরো বাহিনী। দগ্ধ স্ত্রীর মৃত দেহ বুকে নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন অ্যান্টনি। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির চিত্রনাট্য এখানেই শেষ হয়।
দ্বিতীয় পর্বঃ জাতিস্মর... রোহিত মেহতা। কোলকাতায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। মা বাবা গুজরাটি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলে। সব কথাতেই ‘আছি’ শব্দাটা ব্যবহার করে। প্রেমে পরে বঙ্গ ললনা মহামায়ার। পিছুপিছু ঘোরাঘুরি কিন্তু পাত্তা পায় না। অবশেষে একদিন কথা হয় এবং ক্লিন বোল্ড। আধ-ভাঙা বাংলায় গান গেয়ে প্রিয়াকে বোঝাতে চাই যে সে বাংলা জানে, ইলিশ মাছও খায় কিন্তু তাতেও বরফ অগলিত রইলো। কিন্তু মেয়েটা একটা শর্ত দেয়, “যদি রোহিত তাকে নিয়ে পুরদস্তুর বাংলা গান লিখে সেটা পরিষ্কার উচ্চারণ করে গেয়ে শোনাতে পারে; তবে পরে না হয় তার কথা ভেবে দেখবে”। তারপর দুজনের দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেলো যে চলে... রোহিত বিদেশে পরতে চলে যায়। লাস্ট সেমিস্টারে কোর্স “ইন্টারন্যাশনাল একচেঞ্জ প্রোগ্রাম (পর্তুগীজ স্টাডিস)”। সেই কোর্সের পড়া পড়তে লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের মাঝে অ্যান্টনির সাথে রোহিতের পরিচয়। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে রোহিত। একজন পর্তুগীজ অ্যান্টনি যদি কবিগানে নিজেকে অনন্যভাবে উপস্থাপন করতে পারেন; তবে সে কেন নয়? মনের মাঝখানটাতেতো বঙ্গ ললনা মহামায়া আজও সজীব! কোর্স সুপারভাইসরের অনুমতি নিয়ে ফরাসডাঙ্গার চন্দননগরের পথ ধরে রোহিত। লক্ষ্য অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির উপর ডকুমেন্টরি আর মনের এক কনে আছে বিশ্বাস যদি মহামায়া... ফরাসডাঙ্গায় এসে সে প্রথমে সে সাধারণ মানুষের মধ্যে অ্যান্টনির অবস্থান জানতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ তেমন কিছু বলতে পারে না। সেখানকার লাইব্রেরিতে অ্যান্টনির উপর লেখা খুজতে গিয়ে পরিচয় হয় স্থানীয় পাঠাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান কুশল হাজরার সঙ্গে। কুশল যে কিনা জাতিস্বর। অ্যান্টনি জন্মান্তরের পরিক্রমায় আজকের কুশল। প্রথমে রোহিতের ব্যাপারটা বিশ্বাস না হলেও ক্রমে ক্রমে বিশ্বাস হতে থাকে। রোহিত হাতে পায় তার ডকুমেন্টরির মুল চরিত্রকে। যে কিনা এই জন্মে একজন ইঙ্গিনিয়ার। অনেক পরে নিজের মাঝে অ্যান্টনির উপস্থিতি টের পেয়ে সংসার ছেড়ে এই চন্দননগরে এসে জুটেছে। ততদিনে রোহিত পুরোদস্তুর বাংলা বলা শিখে গেছে। আর মহামায়া রেডিও মিরচির সফল আরজে। ব্যাণ্ডেমনিয়ামের মাধ্যমে রোহিতের নিজের লেখা গান গাওয়া এবং মহামায়ার কথা রাখা। শেষ বেলায় কুশলের পুড়োটা অ্যান্টনি হয়ে যাওয়ার অভিনয়; সব মিলিয়ে এক দুর্দান্ত জন্মান্তরবাদের উপাখ্যান আমরা দেখতে পায় জাতিস্বরে।
কুশল চরিত্রে প্রসেঞ্জিত অসাধারন আর রোহিত চরিত্রে যীশু ঠিকঠাক (আমার দাদার মতো দেখতে তাই বেচারাকে অনেক আগে থেকেই ভালোলাগে)। অন্যদিকে মহামায়া চরিত্রে স্বস্তিকার দুর্দান্ত অভিনয় ছবিকে করেছে প্রানবন্ত। বন্ধুর চরিত্রে রাহুল, রিয়া এবং আবির ছবিকে আরও দিয়েছে অন্যমাত্রা। ছবির এক পর্যায়ে মহামায়া তার মাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কবে বুঝলে যে বাবাকে তুমি ভালোবাসা? উত্তরঃ যেদিন ক্যাউরাতলা (কোলকাতার শ্মশানঘাট) থেকে ফিরলাম! আসলেই কি আমারা মানুষকে হারিয়ে তারপর তাকে সত্যিকারের চেনা চিনি”? আর গানের কথা বিশেষ করে না বললেই নয়। সঙ্গীত পরিচালক কবির সুমন জাতিস্বরে এককথায় অনবদ্য।
উনবিংশ শতকে অ্যান্টনি যা পাইনি টা হল- সময় এবং পারিপার্শ্বিকতার সাহায্য। তাই নাম-যশ-স্ত্রী পেয়েও তাকে শেষ পর্যন্ত কাঁদতে হয়েছে। আর আজ এই সময়ে রোহিত যে কারনে জয়ী; তা হল সময় আর পারিপার্শ্বিকতার সাহায্য এবং লক্ষে অবিচল থাকা । একটা সনাতন কথা বলতে চাই, মন থেকে চাইলে আর সে যদি যোগ্য হয় অবশ্যই সব কিছু সম্ভব। কেউ কেউ বলে দূর গোঁজামিল! আমি বলি, এটাই সত্য। জাতিস্মরে সেটা আবার প্রমাণিত হল।
Comments (7)
অনেক অনেক ভালো লাগা রইলো।
thanks kobi,,,,,,,,,
চারু দা
অসাধারণ----------
thanks kobi,,,,,,
ধন্যবাদ শ্রদ্ধাভাজন অসম্ভব সৃষ্টির জন্য।
thanks kobi,,,,,,