আজকাল ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষের মনের অনেক কথায় জনসম্মুখে চলে আসে। আমি প্রায় দেখি অনেকেই বলেন "ধীরে ধীরে সবাই অনেক মানুষের মাঝে থেকেও একা হয়ে যাচ্ছেন!” কথাটা প্রবাসের জন্য সঠিক মনে হলেও,দেশের জন্য আমার কাছে তেমন বিশ্বাস যোগ্য মনে হত না। কারণ দেশে মা বাবা ভাইবোন কত আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব ওখানে কীভাবে সবাই একাকীত্ব অনুভব করে!? কিন্তু আমার সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে যখন সত্যিই দেখি খুব কাছের কেউ ফোন দিলে বলে- “বড় একা লাগে। কাউকেই আর কাছে পাই না। সবাই যার যার মত করে ব্যস্ত। মরলাম না বেঁচে থাকলাম কেউ আমার খোঁজও নেয় না!” তাঁর দীর্ঘশ্বাসটা আমার বুকের ভীতরে বড় একটা ক্ষতের সৃষ্টি করে। হাজার হোক সে আমার অতি আপনজন। তাঁর বলা সুখের কথা যেমন আমাকে আনন্দ দেয়। তেমনি তাঁর বলা কষ্টের কথা আমাকে আহত করে প্রতিনিয়ত। আমি সান্ত্বনা দেই সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবিস না কিছু! কিন্তু না কিছুই ঠিক হবার নয়। কারণ আমরা নিজেরাই চাইছি কিছু যেন ঠিক না হয়।
ইদানীং দেখছি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা,ভালবাসা একেবারেই নেই বললে চলে। আমরা যেন সবাই এখন অনেক বেশি স্বার্থপর হয়ে গেছি! স্বার্থপরতা দেখাই কারণে,কখনো বা অকারণে। আমি আমার কথাই বলি- দীর্ঘ প্রবাস জীবনে এতটা একাকীত্ব আমি কোনদিন অনুভব করিনি। যতটা মাঝে মাঝে কিছু মুহূর্তে অনুভব করি...। একাকীত্ব অনুভব করি আপন ভাইবোন আত্মীয়দের কথা ভেবে। মাঝে মাঝে ভীষণ দুশ্চিন্তা করি,ভাবি আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার সন্তান দুটি(যতই বড় হোক না কেন) বড় একা হয়ে যাবে। এমন কেউ নেই যে এসে ওদের একটু সান্ত্বনা দিবে,খবর নেবে।
অথচ কত বন্ধু(!) চারিদিকে। তারপরও মনের অনুভূতি বড় নিঃসঙ্গ। বারবার নিজেকে ভাঙি আবার গড়ি,আবার ভাঙি আবার গড়ি। এই ভাঙ্গা গড়ার মুহূর্তগুলো খুব বেশি যাতনা দেয়। মনে পড়ে যখন আমার আব্বা মারা গেলেন সেই সময়ের কথা! তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আব্বা মারা গেলে আমরা পরিবারের সবাই এতটাই ভেঙ্গে পড়ি যে কীভাবে কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু সবকিছু সামাল দিল আমার আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশীরা। সেদিন চারিদিক ছিল লোকে লোকারণ্য।
তারপর অতিবাহিত হয়েছে দীর্ঘ সময়। মা মারা গেলেন ২০১৩ সালে...! আমি তখন প্রবাসেই...! উফঃ কি যে দুঃসহ যন্ত্রণা বলে বোঝান যাবে না। একটা কষ্ট বুকে পাথর হয়ে চেপে বসেছে। একা আমি...! স্বামী সন্তান সবাই সবার মত করে ব্যস্ত...। স্বামী দুইদিন ছুটি নিয়ে পাশে ছিল। আর তা যেন আমার জন্য অনেক বেশিই ছিল তখন। না পারছি খেতে, না পারছি ঘুমাতে। ভাইবোন আত্মীয় কেউ নেই পাশে। দুই একজন যাদেরকে বন্ধু ভেবেছিলাম তাদের মাঝে কেউ কেউ অতিথি বেশে এসে কিছুক্ষণ থেকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেল। কেউ কেউ আমার বাসার পাশের পার্টি হাউজে মাদার ডে পার্টি করতে এসেছে। পার্টি সাঁজে আমাকে দেখতে এসে বলছে- “সরি আমার মা যখন মারা গেল তখন তুমি কত কী রান্না করে আমার পাশে ছুটে গিয়েছিলে। অথচ আজ তোমার মা মারা গেছে আর আমি প্রায় একমাস পরে দেখা করতে আসছি,তাও খালি হাতে!” আমার বুকের ভীতরে কষ্ট বাড়ে...! কষ্ট কিছু আনেনি বা দেরিতে এসেছে সেজন্য নয়। কষ্ট সে আমার সামান্য উপকারের কথা কয়েক বছর অতিবাহিত হবার পরেও ভুলে যায়নি বলে! সে আমার অনুভূতি কীভাবে বুঝবে!? আমি যা করেছি তা আমি আমার বাবা মাকে করতে দেখেছি...। অবাক কাণ্ড তাঁরাও কিন্তু তখনকার সময়ে অনেক ব্যস্ত ছিল...! আর এখনও? হ্যাঁ সবাই ব্যস্ত...এই ব্যস্ততায় যেন এখন একমাত্র জীবন। মায়া মমতা,ভালবাসা এসব কিছুই যেন এখন তুচ্ছ।
আমার দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি-সবার মাঝে থেকেও আসলে আমরা সবাই একা! এই যে সময়ে সময়ে,দিনক্ষণ দেখে একসাথে এত আনন্দ ফুর্তি,গল্প,দেয়া নেয়া এসব কিছু আসলে মিথ্যে। সত্য একটাই সময়ে আমরা সবাই একা হয়ে যাব। এই একাকীত্ব সবাইকে সময়ে শতভাগ অনুভব করাবে...আপন আসলে কে বা কারা। ভুলটা তখন সে বুঝবে,যখন বিপদে আপদে পাশে কাউকে সে পাবে না! ভুক্তভোগী হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে। মেনে নিয়ে বলবে-"এর চেয়ে অসহায়ত্ব আসলে জীবনে কিছুই নেই।"
আমরা আমাদের সামনে কাউকে কাঁদতে বা কষ্টে দেখতে অভ্যস্ত নই! আমরা কেবল মানুষের সুখের সময়ের বন্ধু হয়ে পাশে থেকে সুখটুকু অনুভব করতে পছন্দ করি। কিন্তু দুঃখের সময়ে সেই একই মানুষকে একা রেখে দূর থেকে কেবল তাঁর দুঃখ কবে ঘুচবে তার অপেক্ষা করি। ফেসবুকে সান্ত্বনার স্ট্যাটাস দিয়ে দায়িত্ব পালন করি! নীতি কথা বলে বলে স্ট্যাটাস আর মন্তব্যে ঝড় তুলি। আর বাস্তবে করি ঠিক তার উল্টো আচরণ! এই আচরণকেই আধুনিক সমাজে বন্ধুত্ব বলে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ব্যস্ত থাকি। আমরা আসলেই সবাই ব্যস্ত...আর এই ব্যস্ততাই ধীরে ধীরে মুখোশের আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের শ্রদ্ধা,ভালবাসা আর সহমর্মিতার অটুট বন্ধন। আজ আমার পাশের জনের খোঁজ নিতে আমার হাতে সময় নেই। একদিন এই আমার জন্যও আমার সন্তানের হাতে সময় থাকবে না। খুব সুন্দরভাবেই পথটা চিনিয়ে দিয়ে...? আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি নিঃসঙ্গ অন্ধকার পথ। যা হয়ত আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
সময় বহিয়া যায় আলোর সন্ধানে
দেখিনা আলো অন্ধকারে
বাঁধিয়া রাখিতে কারে হই ঊন-মন
জানি না কোন আলোরে
জীবন বহিয়া যায় নব হাহাকারে
উত্তাল ঢেউ আসে ধেয়ে
দিনের শেষে একী গভীরতা
আঁধার নামে ঘন হয়ে।
ছবি-গুগুল থেকে নেয়া
Comments (8)
ভাললাগা জানালাম...