Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শেখ আব্দুল্লাহ্ আল-কাফী

৮ বছর আগে লিখেছেন

অতঃপর মিসির আলী

                                                    
                                               

                                                           প্রথম পরিচ্ছেদ
সকাল সাড়ে আটটা।বাইরে নির্মল রোদ।মিসির আলী তার ঘরে বসে আজকের সংবাদপত্রের একটি সংবাদ খুব মনযোগ সহকারে পড়ছেন।
"নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবনাবাস"।এই শিরোনামের লেখাটি তিনিএকাধিকবার পড়লেন।এছাড়া হুমায়ূন আহমেদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আর যেলেখাগুলো ছাপা হয়েছে সেগুলিও পড়লেন।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ তিনি গতকাল রাতেই শুনেছিলেন।এই লোকটিসম্পর্কে সব সময় তার কৌতুহল ছিল। সংবাদপত্র পাঠ শেষে তিনি বাইরে বেরুলেন।
ইদানিং মিসির আলী পান্থপথের একটি ভাড়াবাড়ির নীচতলাতে থাকছেন।দ্বিতল ভবনেরউপর তলায় বাড়ির মালিক জনাব ফরহাদ উদ্দীন সাহেব তার পরিবারসহ থাকেন।নীচতলারএকটি পাশ তিনি তার ব্যবসার কাজে ব্যবহার করেন।এদিকটা তার কিছু গাড়ী এবংব্যবসার দ্রব্যসামগ্রীতে ভরপুর থাকে।আর একপাশে একটি বড় রুম,একটি বাথরুম ওরান্নাঘর।এটিই বর্তমানে মিসির আলীর অস্থায়ী নিবাস।অনেক কষ্টে তিনি ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অস্থায়ী অধ্যাপনার পদটি ফিরেপেয়েছেন।সেখানে সপ্তাহে তিনদিন তাকে ক্লাস নিতে হয়।এই চাকরী থেকে যা কিছুপান তাতেই তার সময়টা বেশ ভাল কাটছে।
বর্তমানে তার ঘরে কাজের লোক নেই।কাজের লোক রাখার একটি বড় অসুবিধা হল ঘরেরমূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া যায়।এজন্য মিসির আলী যে মেয়েটিকে কাজের জন্যরেখেছিলেন পান্থপথে আসার পর তাকে বিদায় করেছেন।
এখন তিনি দুপুর ও রাতে সাধারণত বাইরে কোন হোটেলে খেয়ে নেন আর সকালের জন্যনিকটস্থ একটি হোটেলে বলা আছে।হোটেলবয় প্রতিদিন দুটি করে রুটি,ডাল আর ডিমভাঁজি দিয়ে যায়।
আজ আর মিসির আলী নাস্তার জন্য অপেক্ষা করলেন না।নিজেই হোটেলে গিয়ে নাস্তাসারলেন।কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আরো অন্তত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সংবাদপত্র কিনেবাসয় ফিরলেন।আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি গেলেননা।সারাদিনভর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কিত লেখাগুলোপড়লেন।সহসা হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু মিসির আলীকে লেখকের ব্যাপারে যেন আরোকৌতুহলী করে তুলেছে।সন্ধ্যার পর তিনি আবারও বাইরে বেরুলেন।আজকে দুপুরেস্বাভাবিক নিয়মে তিনি খেতে বের হননি।সন্ধ্যার পর বের হয়ে রাতের খাবারখেলেন।এরপর একটা চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেতে খেতে আপামর জনসাধারণের আলোচনাশুনতে লাগলেন। হোটেল থেকে চায়ের দোকান সর্বত্রই আজকের আলোচনারকেন্দ্রবিন্দু হুমায়ূন আহমেদ।তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মন্তব্য করতেলাগল।কেউ বলল,লোকটি নাস্তিক ছিল।কেউ বা বলল,তিনি ছিলেন খুবই আস্তিক।কেউ কেউমন্তব্য করল,রাজনৈতিক দল মতের ঊর্ধে উঠতে পারটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড়সফলতা।তারা আরো যোগ করল,তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ।কোন কোন জন তাঁর দ্বিতীয়বিয়ের তীব্র সমালোচনা করল,আবার কেউবা তা যৌক্তিক বলে মত দিল।
চা শেষে দোকানীর কাছ থেকে মিসির আলী একটি কলা,পাউরুটি আর একটি সিগারেটেরপ্যাকেট নিলেন।সিগারেট খাওয়া তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন তবুও কেন জানি আজ আরনিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারলেন না।দোকানীকে প্রয়োজনীয় অর্থ মিটিয়ে সিগারেটেরপ্যাকেটটি পকেটে এবং রুটি-কলার ছোট্ট প্যাকেট হাতের বামে রেখে তিনি আরোকিছুক্ষণ বসে আম জনতার আলোচনা শুনলেন, এরপর একসময় বাসায়   ফিরলেন।কিছুদিনহল তিনি টিভি কিনেছেন।টিভি ছেড়ে বিভিন্ন চ্যানেলের নিউজে হুমায়ূন আহমেদসম্পর্কিত খবরগুলো দেখতে লাগলেন।তাঁর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী,রাষ্ট্রপতিসহশোক প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ।তাঁরপরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দের অভিব্যক্তিও মিসির আলী মনযোগের সাথেদেখলেন।টিভি দেখা শেষ করে তিনি যখন উঠলেন তখন রাত প্রায় সাড়ে বারটা।এবারতিনি টেবিলে বসলেন।ডায়েরী খুলে শিরোনামে লিখলেন "হুমায়ূন আহমেদ"।
তাঁর সম্পর্কে আরো যে কথাগুলো লিখলেন-

* ইনি ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলার দৌলতপুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

* মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ অফিসার পিতাকে হারানোর পর বড় সন্তান হিসেবে পুরো পরিবারের দায়ভার কার্যত তার উপর এসে পড়ে।

* এই চাপ তিনি বেশ দক্ষতার সাথে সামাল দেন।এর বাইরে প্রচুর পরিশ্রমের মাধ্যমে অসাধারণ শিক্ষা জীবনের অধিকারী হন।

* ১৯৭২ সালে তাঁর উপন্যাস "নন্দিত নরকে" প্রকাশিত হওয়ার পরখ্যাতি ও পুরস্কার উভয়ই লাভ করেন।এরপর তাঁর উত্থান এবং ক্রমোন্নতি রূপকথাররাজকুমারকেও হার মানায়।

* বাবার মৃত্যুর পর একেবারে শূন্য থেকে শুরু   করে শুধুমাত্রলেখালেখির উপর ভর করে যে সম্মান এবং অর্থ তিনি অর্জন করেছেন তা ইতিহাসেবিরল।

* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পদটি ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেতাঁর অসীম সাহসীকতার পরিচয় নিহিত ছিল।এরপরই তিনি লেখালেখির পাশাপাশিচলচ্চিত্র পরিচালনায় নিজেকে নিয়মিত করে তোলেন।

* বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডামাডোলের ঘূর্নীপাকে তাঁর সমসাময়িকপ্রায় সকল সাহিত্যিকগণ বাঁধা পড়লেও তিনি তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেপেরেছিলেন,যা তাঁর উন্নত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উত্তম ফসল।

* ১৯৯৭ সালে গাজীপুর জেলার পীরুজালি গ্রামে "নুহাশ পল্লী"নামে যে নন্দন কানন তিনি গড়েছেন পৃথিবীর অন্য কোন সাহিত্যিক কোন সময়ে এরকমকিছু করতে পেরেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না,যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উইলিয়াম শেক্সপিয়র, কাজী নজরুল ইসলাম, ওয়াল্টার হুইটম্যানদের মত যুগস্রষ্টাসাহিত্যিকদের জীবনের একটা বড় সময় অনাহারে কাটাতে হয়েছে।

* ১৯৭৩ সালে তিনি গুলতেকিন নামের এক সুন্দরী রমনীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন,যে কিনা বাংলা সাহিত্যের অপর একজন নামকরা লেখকপ্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া।
সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর সংসার করার পর ২০০৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
এরপর তিনি নিজ হাতে গড়া অভিনেত্রী শাওনের সাথে পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে মিলিত হন।

* হুমায়ূন আহমেদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তদ্বয়ের পেছনে ঠিক কী কারণ ছিল তা পাঠক মহলের কাছে বরাবরই রহস্যাবৃত।

* তাঁর সমস্ত সাহিত্য কর্ম পাঠ করেও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকঠিন যে তিনি আস্তিক ছিলেন না নাস্তিক। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনিরবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

* প্রথিতযশা এই লেখকের জীবনের একটা সোনালী অধ্যায় যেখানে পার হয়েছিল সেই যুক্তরাষ্ট্রেই তাঁর জীবনের শেষ সময়টা কাটল।

* তাঁর কোলন ক্যান্সারের পেছনে প্রধান কারণ সম্ভবত মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান যদিও তিনি ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়েছিলেন।

সবশেষে মিসির আলী লিখলেন-
হুমায়ূন আহমেদ(১৯৪৮-২০১২) তাঁর যাদুকরী কলমের ছোঁয়ায় বাঙালী পাঠক সমাজকে বইপড়াটা অভ্যাসে পরিণত করাতে পেরেছিলেন যা তাঁর সবচেয়ে বড় সফলতা।
"জীবিতাবস্থায় সাহিত্যে একটা নোবেল পুরস্কার অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য ছিল।"

এবার মিসির আলী ডায়েরী বন্ধ করে উঠলেন।সারাদিনের একরকমঅনাহারে যথেষ্ট ক্ষুধার উদ্রেক হওয়ায় তিনি দোকান থেকে কেনা কলা ও রুটিরসন্ধানে হাত বাড়ালেন কিন্তু কোথাও তা পাওয়া গেল না।এগুলো সম্ভবত তিনিদোকানেই ফেলে এসেছেন।মনে পড়ল হুমায়ূন আহমেদ যখন জীবিত ছিলেন দুইবার তিনিতাঁর সঙ্গে দেখা করতে রাতে তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন ঠিক এরকমই খাবারেরপ্যাকেটসহ আর দুইবারই তিনি তা লেখকের বাসায় ফেলে এসেছিলেন।সেই স্মৃতিরোমন্থিত হওয়ায় মিসির আলী আপন মনে কিছুক্ষণ হাসলেন,তারপর একটা সিগারেটধরিয়ে তা শেষ করে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন।

                                                             দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দুপুর আড়াইটা।বৃহস্পতিবার হওয়ায় আজ হাফ স্কুল।ক্লাস শেষে কাব্য,মিতা,কবিতা ওঋতু বাড়ি ফেরার জন্য বিকল্প পথ ধরল।চলাচলের জন্য গ্রামের মানুষ সাধারণত এইপথ ব্যবহার করে না।গাছ-গাছালীতে ঘেরা নির্জন সংকীর্ণ রাস্তা লতা-পাতায়আচ্ছন্ন।পথিমধ্যে রাস্তার ধারে একটি কবরস্থান পড়ে।গ্রামের অধিকাংশআত্মহননকারী নারী-পুরুষকে এই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বিধায় এ পথ সম্পর্কেমানুষের ভীতি একটু বেশি।প্রায় সকলেরই ধারণা এখানে জ্বীন-ভূতের বসবাসআছে।সুযোগ পেলেই তারা যে কারো উপর ভর করে তার ক্ষতি করতে পারে।এই ভীতিগ্রামবাসীর কাছে উক্ত পথকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে।কাব্য ও তারবান্ধবীরা যখন ঐ রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরার প্রত্যাশায় স্কুল থেকে যাত্রা শুরুকরল তখনই হঠাৎ পিছন থেকে সীমা এসে হাজির হল।সীমা অন্য চারজনের সাথে একইস্কুলে দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে।সে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল- তোরাহঠাৎ এই পথে কেন?
উত্তরে ঋতু বলল- কেন?কোন অসুবিধা?
সীমা- না মানে তোরা সবাইতো জানিস এই পথ পরিত্যক্ত।খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়াকেউ এটা ব্যবহার করে না।এই পথে ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে।তা সত্ত্বেও........

মানুষের ভয়ের ধারণাকে মুছে দেওয়ার জন্যই আমাদের এই পদক্ষেপ।আমরা সবাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ি।,পূরাতন ধ্যান-ধারণার জালে আবদ্ধ থাকাটাআমাদের কাজ নয়- বলল কবিতা।
সীমা- তবুও এখন ভর দুপুর।সহজ রাস্তা থাকতে ঝুঁকি নেওয়াটা কী ঠিক হবে?
প্রতিউত্তরে মিতা হাসিচ্ছলে বলল- ভরদুপুর বলেই কিনা আমরা এই সময়টাকে বেছেনিয়েছি।রাজা রামমোহন রায়কে তো চিনিস।তিনি জলপথে উপমহাদেশ থেকে ইউরোপ পাড়িদিয়ে এ অঞ্চলের মানুষদেরকে ভয়ানক কুসংস্কারাচ্ছন্নতা থেকে উদ্ধারকরেছিলেন।আর আমরাতো শুধু গ্রামের লোকেদের হিতার্থে এতটুকু করতে উদ্দতহয়েছি।গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌছানোর এটিই সবথেকে সহজরাস্তা।এজন্য একবার চলাচলের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা নিয়মিত করতে পারলেগ্রামবাসীর বরং উপকারই হবে।সীমা আর কথা বাড়ালোনা শুধু তাদের সাথে দ্রুতপদক্ষেপে এগিয়ে চলল।কাব্য নশ্চুপ,নির্বিকার।
ঘন জঙ্গলে প্রবেশের ঠিক পূর্বমুহূর্তে ভিতর থেকে সাদা পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তিকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।
হাফেজ আব্দুর রউফ।গ্রামের প্রবীণ লোকদের মধ্যে অন্যতম।পরহেজগার মানুষ,সকলেরশ্রদ্ধাভাজন।অর্থাভাবে হজ্ব করতে পারেননি কিন্তু হজ্বের মৌসুমে হাজীসাহেবগণ যে পোশাক পরেন তিনি সার্বক্ষণিক সেই পোশাকেই থাকেন।আর একটি কাজতিনি নিয়মিত করেন।গ্রামের যে গোরস্থানগুলো আছে প্রত্যহ ঘুরে ঘুরে সেগুলোজিয়ারত করতে ভুল করেননা কখনো।এখন হয়ত তিনি ভিতর থেকে কবর জিয়ারত করেইফিরছেন।
কাছে এসে বালিকাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন- তোমরা এসময়ে এদিকে কোথায় যাও?
বাড়ি যায়,চাচা- কবিতা উত্তর দিল।
হাফেজ সাহেব- কিন্তু বাড়ি যাওয়ার জন্য সহজ রাস্তা ফেলে তোমরা এই ঝোপঝাড় বেছে নিলে কেন?
ঋতু- সহজ রাস্তাতো এটাই,চাচা।নিয়মিত ব্যবহার করে এই রাস্তাকে যদি চলাচলেরজন্য উপযোগী করা যায় তবে আমাদের সময় ও শ্রম উভয়ই বাচবে,আর তাতে গ্রামেরলোকেরও সুবিধা হবে।
হাফেজ সাহেব- এটা তোমরা ঠিক কর নি।এই সময়ে এদিক দিয়ে যাওয়াটা তোমাদের জন্য Likes Comments

০ Share