Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

ইফ্ফাত রুপন

৭ বছর আগে লিখেছেন

ইন্দ্রাণী

আবহা। এই আবহা। উঠছিস না কেন? দেখ কত বেলা হয়েছে। এতক্ষণ ধরে ঘুমায় কেউ?

আবহা বেশ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল।

স্বপ্নের পরিবেশগুলো সাধারণত ধূসর বর্ণের হয়। যার নিজস্ব কোন রং থাকে না, থাকে না কোন নিজস্ব অস্তিত্বও। কিন্তু আবহার কাছে সবসময় মনে হয় শুধুমাত্র তার স্বপ্নগুলোর মাঝেই নিজস্ব একটা স্বকীয়তা রয়েছে। কারণ একমাত্র তার এই স্বপ্নগুলোর মাধ্যমেই সে মাঝে মাঝে তার অতীতের জীবনটাতে ফিরে যেতে পারে। ফিরে যেতে পারে তার সেই জগতে যেখানে শুধু সে ছিল, তার স্বপ্ন ছিল আর সেই স্বপ্নের সাথে মিশে ছিল...

আবহা। উঠ তো মা। আর কতো ঘুমাবি?

আবহা উঠে বসলো। স্বপ্নটা তার এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মার কি দরকার ছিল এভাবে তাকে ডাকাডাকি করার। ডাক না দিলে হয়তো আরো কিছুক্ষণ তার সঙ্গে থাকা যেত।

আজকের স্বপ্নটা একটু অন্যরকম ছিল। অন্যান্য দিনের মতো বিষাদময় ছিল না। কারণ আজ সে, তার পাশে ছিল। তারা দুজন একসাথে করে কোথাও যাচ্ছিল। সে বসেছিল জানালার পাশে আর আবহা বসেছিল ঠিক তার পাশের জায়গাটিতে। আবহা তার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। আর সেই সাথে জানালা দিয়ে আসা বাতাসের কারণে আবহার চুলগুলো উড়ছিল। একটু পর আবহা খেয়াল করলো তার চুলগুলো উড়ে গিয়ে ঠিক তার পাশের মানুষটার মুখের উপর পরছে। কিন্তু মানুষটা তাকে কিচ্ছু বলছে না এমনকি সে চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরাচ্ছেও না। যেন সে চাইছে বাতাসে আবহার চুলগুলো উড়ুক এবং সে যেন সেগুলোর স্পর্শ অনুভব করতে পারুক। আজকের স্বপ্নে তার মুখটাও বেশ হাসিখুশি ছিল। অন্যান্য দিনগুলোতে তো মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। আবহা হাত বাড়িয়ে তার পাশে বসে থাকা মানুষটাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছিল। আর ঠিক সেই সময়টাতে মা ডাক দিয়ে তার ঘুমটা ভেঙে দিল।

কালকেও রাত জেগেছিস নিশ্চয়ই? তোকে না কতবার মানা করেছি রাত না জাগতে।

রাত তো মা আমি ইচ্ছা করে জাগি নি। একটা টার্ম পেপার জমা দেয়ার লাস্ট ডেট আজকে। তাই জাগতে হলো।

বলেই আবহা তার ভেতর ভেতর বেশ অনুতপ্ত হলো। কি দরকার ছিল সকালটা একটা মিথ্যা দিয়ে শুরু করার। হ্যা, সে রাত জাগে। কিন্তু টার্ম পেপার লিখার জন্য কিংবা অন্য কিছু করার জন্য নয়। সে রাত জাগে শুধুমাত্র তার জন্য। তার একটি মাত্র ফোনের জন্য। এবং এটাই আবহার জীবনের সবচাইতে বড় সত্য। তাকে যে রাত জাগতেই হবে। তা না হলে তো......

হয়েছে বুঝেছি। এখন নাস্তা খেতে আয়। তোর বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

আবহার বুক ধক করে উঠলো। বাবা তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে তার মানে হচ্ছে আজকে তার জন্য খুবই মারাত্মক একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। এবং দুঃসংবাদটি কি হতে পারে তাও আবহার জানা আছে। কিন্তু যে জিনিসটি আবহার নেই তা হচ্ছে বাবাকে মুখ ফুটে কিছু একটা বলার সাহস। কিভাবে বলবে সে বাবাকে? আজ পর্যন্ত নিজেও তো কিছু জানে না সে...

আবহা আর মৃদুলের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল অনেক আগে। এতোটাই আগে যে শুরুর দিককার সময়গুলোর কথা আবহা মাঝে মাঝে ঠিকমতো মনেও করতে পারে না। তার শুধু এইটূকু মনে আছে মৃদুল একসময় তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। বেশ ছোট ছিল আবহা তখন। মাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছে। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে যারা একাকীত্বের স্বাদ পরিণত বয়সে এসে অনুভব করে না। কিন্তু আবহা সেই মানুষগুলোর মধ্যে একজন যার জীবনের শুরুটা হয়েছিল অনেক পরিপূর্ণতা দিয়ে। আর তার জীবনে সেই পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছিল মৃদুল। মৃদুল আবহার বান্ধবী তানিয়ার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। কলেজে উঠার পর তার সাথে আবহার পরিচয় হওয়া, তারপর একটু আধটু রাতে ফোনে খুনসুটি করা, একসাথে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে পাশাপাশি বসে ফুচকা খাওয়া এভাবে করতে করতে আবহার কি যেন হলো সে নিজেও প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না। সবকিছু থাকার পরও নিজেকে খুবই অসহায় লাগতে লাগলো তার মাঝে মাঝে। সবকিছু থেকেও কি যেন নেই তার। আর নেই মৃদুলকে হারিয়ে ফেলার শক্তি। কিন্তু কেন সে তা নিজেও বুঝতে পারছিল না।

মৃদুল সবসময় তাকে ঠাট্টা করে বলতো, দেখবে আমি একদিন হঠাৎ করে তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবো। আমাকে আর কোথাও তুমি খুঁজে পাবে না। কারণ আমি খুঁজে পাবার জন্য হারাবো না।

মৃদুল হারিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আবহা তা হতে দেয় নি। কলেজের গণ্ডি শেষ হবার পর মৃদুল স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। আর ঠিক তখনই আবহা বুঝতে পারে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে মৃদুলকে। তার ভালোবাসার পরিমাণ এতোটাই তীব্র ছিল যে সেই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে চলে যাবার ক্ষমতা বিধাতা আজ পর্যন্ত কোন ছেলেকে দেন নি। কিন্তু আবহা অনেক দেরি করে ফেলেছিল। আর ততক্ষণে মৃদুলও অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল।

তাদের সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল অনেক দূর থেকে। দু প্রান্ত থেকে। কিন্তু হয়েছিল। আবহার আজো সেই দিনটার কথা মনে আছে যেদিন সে মৃদুলকে প্রথম তার ভালোবাসার কথাটা জানিয়েছিল। আবহার নিজস্ব কোন ফোন ছিল না তখন। মৃদুলের সাথে তার কথা বলতে হতো হয়তো বাসার ল্যান্ডফোন থেকে কিংবা তার ছোট চাচ্চুর মোবাইল থেকে। মৃদুল আর আবহার মধ্যকার সময়ের ব্যাবধানের কারণে মাঝে মাঝে বেশ রাতেও আবহার মৃদুলের সাথে কথা বলতে হতো।

সেদিনও এরকমই একটা রাত ছিল। রাতে কথা বলাটা আবহার জন্য অনেক বিপদজনক ছিল কারণ রাতে ল্যান্ডফোন দিয়ে কথা বলার সুযোগ তার ছিল না। ল্যান্ডফোনটা থাকতো তার বাবা মার ঘরে। সকালে বাবা অফিসে আর মা রান্নাঘরে থাকার কারণে আবহা খুব অল্প কিছু সময়ের জন্য মৃদুলের সাথে কথা বলতে পারতো। আর যেদিন রাতে কথা বলার দরকার হতো সেদিন ছোট চাচ্চুর মোবাইলটা ছাড়া আর কোন উপায় তার কাছে থাকতো না। কিন্তু সেটা আরও বিপদজনক ছিল। কারণ ছোট চাচ্চু ঘুমুতে যাবার সময় তার মোবাইল ফোনটা নিজের মাথার কাছে রেখে ঘুমাতেন।

সেদিনও আবহা জানতো যে আজ রাতে মৃদুল তাকে ফোন করবে। আগের দিন কথা বলার সময় সে তাকে বলে রেখেছিল। কিন্তু আজ বাসায় মেহমান থাকার কারণে রাতে মৃদুলের সাথে কথা বলা কোনভাবেই আবহার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মৃদুল বলেছিল সে ফোন করবে রাত তিনটার দিকে। আবহা ঠিক করে রেখেছিল আজ আর সে কথা বলবে না। একদিন কথা না বললে কিছু হবে না। কিন্তু রাত একটু গভীর হবার সাথে সাথেই আবহার কি যেন হলো তার নিঃশ্বাস পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। তার কাছে মনে হতো লাগলো আজকে কথা বলতে না পারলে আর কোনদিনও মৃদুলের সাথে তার আর কথা বলা হবে না। আর কোনদিনও না। এক পর্যায়ে ছটফট করতে করতে সে ড্রয়িং রুমের দিকে রওনা হলো। তার চাচ্চু আজ সেখানে মশারী খাটিয়ে ফ্লোরিং করেছে। বাসায় এতো মানুষ যে বেচারার আজ নিজের বিছানাটাও অন্যের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছে।

আবহা চাচ্চুর মোবাইল ফোনটা দেখতে পাচ্ছে। তার মাথার কাছে এক কোণায় রাখা। কিন্তু মশারী উঠিয়ে ফোন নিতে গেলে তো চাচ্চু জেগে যাবে। এভাবে কতোবার সে চাচ্চুর মাথার কাছ থেকে মোবাইল নিয়েছে। কিন্তু মশারী না থাকায় চাচ্চু কোনদিন টেরও পায় নি। কিন্তু আজকে কি করবে আবহা?

মৃদুলের ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে আবহা সেদিন মৃদুলকে বলেছিল, “দেখ আমি এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আর তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। আর আমি এভাবে তোমার কাছ থেকে আর দুরেও থাকতে পারবো না। তুমি এসে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। তোমার খুব কাছে। যেখান থেকে আমি তোমাকে অনুভব করতে পারি”।

ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য সবসময় নির্দিষ্ট কোন শব্দের প্রয়োজন হয় না। এমনকি মাঝে মাঝে কোন শব্দেরও প্রয়োজন হয় না। মৃদুল সেদিন নীরব থেকেছিল। কিন্তু আবহা তার সেই নীরবতার মাঝেও তার প্রতি মৃদুলের অগাধ ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল।

পরদিন আবহার ছোট চাচ্চু ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলো তার মাথার কাছের মশারীটার একটা অংশ গোল করে কে যেন কেটে রেখেছে। এভাবে শুধুমাত্র কেঁচি দিয়েই কাটা সম্ভব। তার স্পষ্ট খেয়াল আছে আবহার ঘরের কলমদানিতে সে একবার এরকম একটা কেঁচি দেখেছিল।

 












আবহা বসে আছে তার বাবার সামনে।

মশিউর রহমান সাহেব পেশায় একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। ছিলেন এই করণে বলা হচ্ছে বেশ কিছুদিন হলো তিনি তার চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করার কারণে প্রত্যেক সরকারী চাকরিজীবীরা অবসরে আসার সময়টুকুকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে পরে যান। কিন্তু এক্ষেত্রে মশিউর সাহেবের বেলায় সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ দেখা গেলো। মশিউর সাহেব তার স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়ে বেশ হাসিখুশি এবং প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ ছিলেন। সংসারের দেখাশুনার পাশাপাশি তার এই সংসারকে সর্বক্ষেত্রে কিভাবে সুখী রাখা যায় এই ব্যাপারে সবসময়ই তার সজাগ দৃষ্টি ছিল। কথায় আছে অতিরিক্ত কোন কিছু অন্য সবক্ষেত্রে ভালো হিসেবে বিবেচিত হলেও সংসার নামক বস্তুতির ক্ষেত্রে তা ঠিক কেন যেন খাটে না। মশিউর সাহেবের বেলায় সেই অতিরিক্ত জিনিসটি ছিল তার পিতৃস্নেহের বেলায়। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণবশত সেই অতিরিক্ত আদর কিংবা নিজের মেয়েদের ভালো রাখার খুব বেশি চেষ্টা করার থেকেই হোক মশিউর রহমান সাহেবের দুই মেয়ে ঠিক কি কারণে যেন তার সাথে কোনদিন ফ্রি হতে পারলো না। এটা নিয়ে মশিউর সাহেবের মনে আজো আক্ষেপ রয়েছে। এবং কে জানে হয়তো সামনেও থাকবে।

তো যাই হোক রিটায়ারমেন্টে আসার পর থেকে মশিউর সাহেব সম্পূর্ণভাবে নিজের চিরচেনা রূপকে বিদায় জানালেন। পরিবর্তে নিয়ে এলেন সদ্য মেজর হিসেবে জয়েন করা ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সের এক আর্মি অফিসারের রূপ। ডিসিপ্লিন নামক শব্দটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন। সেই সাথে নিজের জীবন ছাড়া সংসারের অন্য সবার জীবন রীতিমত অতিষ্ঠ করে তুললেন। এরকম একজন মানুষের  সামনে বসে নিজের জীবনের সবচাইতে গভীর অনুভূতিগুলোকেও কখনো অনুভব করা যায় না। আবহাও এখন কিছু অনুভব করছে না। সত্যি কথা বলতে কি আবহা এখন আর কিছুই অনুভব করছে না। মানুষের অনুভূতি তো কখনো শুন্য হয় না।

“তুই নাকি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিস না”?

বাবার কথায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো আবহা। এই জিনিসটার ভয়ই আবহা এতক্ষণ ধরে করছিল। বাবার এই স্বভাবটাও আগে ছিল না। তিনি যে কোনো কথা শুরু করতেন বেশ সময় নিয়ে, পরিস্থিতি বুঝে। কিন্তু অবসরে আসার পর থেকে তার এই ব্যক্তিত্বটাও পুরোপুরিভাবে আবহাদের জীবন থেকে মুছে গেল। নতুন মানুষকে নতুন করে মানিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু একজন পুরনো চিরচেনা মানুষকে নতুন করে গ্রহণ করে নেয়া যায় না। প্রকৃতিও তা পছন্দ করে না।

আবহা মনে মনে কথা গুছাতে শুরু করলো। অনেক কিছু বলার আছে তার বাবাকে। অনেক সময় নিয়ে সে কথাগুলো গুছিয়েও রেখেছিলো। কিন্তু এখন আর কেন যেন কিছুই আর মনে আসছে না। ঘুরে ফিরে তার খালি একটা কথাই মনে আসছে আর সেটা হচ্ছে “আমি এখন আর কোন কিছু অনুভব করছি না কেন?”

এরকম চিন্তা করতে করতেই আবহা তার পাশে থাকা জানালাটার দিকে তাকালো। আরে শীত চলে এসেছে। কেমন ঘন কুয়াশা জানালার ওপাশে। আবহা এখন অনুভব করতে শুরু করলো। অনুভব করতে শুরু করলো গত বছরের এই সময়টাতে প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছিল। আবহার কেন যেন এখন বেশ ঠাণ্ডা অনুভব হতে লাগলো। আরে তাই তো। এখন তো শীতকাল। ঠাণ্ডা তো লাগবেই। অথচ সেই কয়দিন আগেই না আবহার জীবন থেকে শীত বিদায় নিয়েছিল। সেই শীতের সাথে বিদায় নিয়েছিল আবহার জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষাগুলো, সমস্ত অনুভূতিগুলো।

গত দু বছর ধরে আবহা আর মৃদুলের সম্পর্কটা খুব বেশি একটা ভালো যাচ্ছিলো না। আর তার প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের মধ্যকার ব্যবধানের দূরত্ব। গত দু বছর ধরেই মৃদুল কেমন যেন আচরণ করছে আবহার সাথে। যেন সে চাইছে না আবহা তার জীবনে থাকুক। বিষয়টা আবহাও বুঝতে পেরেছে অনেক আগেই। এখন আর মৃদুল তাকে আগের মতো করে ফোন দেয় না, আর দিলেও কেন যেন কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে চায় না। মৃদুলের সব ব্যাপারেই কেমন যেন একটা অবহেলার ছাপ ফুটে উঠেছে এই গত দু বছরে। এর কারণ কি তা আবহা জানে না। সে জানতেও চায় না। এমনকি মৃদুলকে আজ পর্যন্ত এসব নিয়ে কোনদিন কোন কিছু জিজ্ঞেসও করে নি সে। আবহার ভালোবাসায় তো কোন ঘাটতি নেই। তাহলে কেন সে নিজ থেকে মৃদুলকে প্রশ্ন করবে যে তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন?

“কিরে কথা বলছিস না কেন?”

বাবার কথায় আবহার সম্বিৎ ফিরে এলো। কি উত্তর দেবে বাবাকে সে? সে নিজেই তো কিছু জানে না এখনো। গত বেশ কয় মাস ধরেই আবহার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। যতবারই আবহার বাবা কোন সম্পর্ক নিয়ে এগুতে চেষ্টা করেছেন ততবারই আবহা কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে তার জন্য আসা বিয়ের সম্পর্কগুলোকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন আর কোনমতেই আর তা করা সম্ভব হচ্ছে না। আবহার বাবা প্রথম প্রথম তার মেয়েকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। কিন্তু গত কয়দিন আগে একটা বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার পর এই প্রথমবার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে কেন সে এখন বিয়ে করতে চাচ্ছে না।

আবহার কাছে সেদিন তার বাবার প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না। আজো নেই। কিন্তু সে জানে তাকে কোন না কোন দিন হলেও বাবার প্রশ্নের উত্তর তাকে দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে দেবে সে?

আবহা মৃদুলকে তার এই পরিস্থিতির কথা জানায় নি। মৃদুলও জানতে চায় নি কখনো। আবহা জানে মৃদুল গত কয়টা বছর ধরে বেশ ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার ভিসার সমস্যা হয়েছে। ভার্সিটিতে স্কলারশিপ নিয়েও খুব বেশি একটা সুবিধা করতে পারছে না সে। তার এখন এমন অবস্থা যে সে না পারছে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসতে না পারছে সে দেশে ঠিকমতো স্থায়ী হতে। এরকম পরিস্থিতিতে পরা কোন ছেলেকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়া যায় না। আবহাও তাই দিচ্ছে না। চাপ দেয়া তো দূরে থাক সে মৃদুলকে আজ পর্যন্ত কোন কিছু জানায় নি পর্যন্ত। আবহা জানে জানিয়ে কোন লাভ হবে না। মৃদুল তার জীবন থেকে আবারো হারিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু এবার তাকে আর ধরে রাখার মতো ক্ষমতা আবহার নেই। তবে আবহার মৃদুলের প্রতি ভালোবাসাটুকু আজো আছে। এবং থাকবে। কিন্তু হয়তো একদিন সেই ভালোবাসার মানুষটি আর থাকবে না।

“আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”

আবহা এবার নড়েচড়ে বসলো। বাবাকে কিছু অন্তত তার বলতে হবে।

“বাবা আমি আমার মাস্টার্সটা শেষ করতে চাই আগে”

“মাস্টার্স শেষ করতে চাস তো করবি। তার সাথে তোর বিয়ের সম্পর্ক কোথায়?”

আবহা আবারো চুপ হয়ে গেল। কোন উত্তর তার মাথায় আসছে না এই মুহূর্তে। তবে সে বুঝতে পারলো বাবাকে আর বেশিদিন তার এসব দায়সারা উত্তর দিয়ে আর সে ঠেকাতে পারবে না। বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা যে করেই হোক করবেনই। সেটা আবহার মতেই হোক কিংবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই হোক।

“আমি তোকে আর এক বছর সময় দিচ্ছি। তোর মাস্টার্স ততদিনে শেষ হয়ে যাবে। এরপর আমি আর তোর কোন কথা শুনতে চাই না। অনেক ভালো ভালো সম্পর্ক তুই ফিরিয়ে দিয়েছিস। আমি তোর জন্য আর ছেলে খুঁজতে পারবো না।”

প্রত্যেক মেয়েই তার জীবনের কোন না কোন সময়ে তার বাবা মার কাছ থেকে এই কথাটি শুনে থাকে। “বোঝা” নামক বিপরীতার্থক শব্দটি তখন জীবনের একটি অংশ হিসেবে মনে হয় তাদের কাছে। আবহারও এখন মনে হচ্ছে। আবহা তার মাথা নিচু করে ফেলল। কারণ তার চোখ থেকে পানি বের হচ্ছে। সে চায় না তার বাবা তার চোখের পানি দেখুক।

আবহার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু নিঃশব্দে তার হাতের উপর এসে পরলো। সেটা শুধু আবহাই জানলো। আর জানলো তার হাতের উপর পরে থাকা চোখের জলটি।

 

 












আবহা ঘুমিয়ে পরেছিল।

হঠাৎ করেই সে জেগে উঠলো। অন্ধকারে হাতরে হাতরে মোবাইলটা খুঁজে বের করতে লাগলো। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ লাগছে তার এখন। কিভাবে সে ঘুমিয়ে পরেছিল? আজকে রাতে তো মৃদুলের ফোন আসার কথা। ঘুমিয়ে পরলে যদি ফোন ধরতে না পারে? আবহা মোবাইলটা হাতে নিল। দুইটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। না মৃদুল এখনো ফোন করে নি। আবহা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক তাহলে মৃদুলের ফোনটা মিস হয় নি। আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আবহার মৃদুলের সাথে। আজকে রাতে যে করেই হোক তার মৃদুলের সাথে কথা বলতেই হবে।

গত কয়েকদিনে আবহার জীবনে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তার জন্য নতুন আরেকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। ছেলেপক্ষের অবস্থা বেশ ভালো আর ছেলেও চার্টার্ড একাউন্টেড। আবহার বাবা মার অনেক আগ্রহ ছিল এই বিয়েটার প্রতি। কিন্তু আবহা আবার তার সেই আগের অজুহাত দেখিয়ে এই সম্পর্কটিও ফিরিয়ে দেয়। তবে এবার আর চুপ করে থাকতে পারে নি সে। মাকে বলেছিল সে তার সব কথা। মাকে বলেছিল এই আশায় যে হয়তো মা তাকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে। আবহার মা বিয়েটা ফিরিয়ে দিয়েছেন ঠিকই তবে এই বিষয় নিয়ে পরে আর মেয়ের সাথে একটিবারের জন্য হলেও কথাও বলে দেখেন নি তিনি। আবহা বুঝতে পারছে সে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। মাকে বলাটা তার মোটেও উচিত হয় নি। কিন্তু এখন আর কিছু করারও নেই। যে কোনো সময় এখন তাকে পরিবার থেকে বিয়ের জন্য প্রচণ্ডরকম ভাবে চাপ দেয়া হবে। আবহার এখন বিষয়টি যে করেই হোক মৃদুলকে জানাতে হবে। আর চুপ করে থাকতে পারবে না সে।

মৃদুল ফোন করলো ভোর চারটায়। আবহা তখনও জেগে ছিল। ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে মৃদুল বলে উঠলো,

আবহা শোন, আজকে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না। কাজ পরে আছে আমার একটা।

আবহা চুপ করে রইলো। বেশ খারাপ লাগছে তার। কেন এই মানুষটা তাকে এখন আর বুঝতে পারে না?

হ্যালো আবহা। হ্যালো।

হ্যা বল, শুনতে পাচ্ছি।

কি করছিলে?

কিছু না, শুয়ে ছিলাম। তুমি ভালো আছো?

আমার আর ভালো থাকা। স্কলারশিপটাও বোধয় বাতিল হয়ে যাবে। ভার্সিটির এতো খরচ আমি কোথা থেকে যে জোগাড় করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

আবহা আবারো চুপ হয়ে গেলো। সে মনে মনে কথা গুছাচ্ছে। আজ যে করেই হোক তাকে বলতে হবেই। ওপাশ থেকে মৃদুল বলে যেতে লাগলো,

ভিসাটাও রিনিউ করতে পারছি না বুঝলে আবহা। আমি যে এখানে কতো বড় বিপদের মধ্যে আছি। কারো সাথে যে জিনিসটা নিয়ে আলোচনা করবো এমন মানুষও এখানে নেই।

আমার সাথে করলেই তো পারো। আমি তো আছি।

তুমি কি আর এসব বুঝবে? তুমি তো দেশে থাকো বেশ আরামেই আছো।

আবহা আর সহ্য করতে পারলো না। তার বুক ফেটে যাচ্ছিলো মৃদুলের কথাবার্তা শুনে। ঠুকরে ঠুকরে কাঁদতে শুরু করলো সে।   

আরে একি কাঁদছ কেন?

মৃদুল আমাকে বাসা থেকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে।

আবহা আবারো কাঁদতে শুরু করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কেন যেন তার এই কথার কোন প্রত্যুত্তর পেলো না সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মৃদুল বলে উঠলো, “তাহলে আমি কি করবো?”

আবহা নিজের কানকে যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কি বলছে এসব মৃদুল? আবহা আবারো বলল,

মৃদুল আমার জন্য ঘন ঘন বিয়ের প্রস্তাব আসছে। আমি অনেক কষ্ট করে অনেক অজুহাত দেখিয়ে সেগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমার পক্ষে আর সম্ভব না মৃদুল। তুমি প্লিজ কিছু একটা করো। আমি আর পারছি না।

দেখ আমি এখন তোমাকে কিভাবে বিয়ে করবো? আমি নিজেই আছি বিপদের মধ্যে। তার উপর আমার পরিবারের কথাও তো আমার চিন্তা করতে হবে নাকি। আমি আমার ফ্যামিলিতে এখন বিয়ের কথা বলতে পারবো না। আর আমিও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত না এখন।

এসব তুমি কি বলছো মৃদুল। আমি ভালোবাসি তোমাকে।

আমি জানি আবহা তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু আমার কথাটা একবারও কি চিন্তা করে দেখেছো তুমি? আমি এই পরিস্থিতিতে কিভাবে তোমাকে......? আর তার উপর এখন আমি আর আগের মতো...

আবহার কাছে মনে হলো তার চারপাশের সবকিছু কেমন যেন থেমে গেছে। কি বলছে এসব মৃদুল?

আগের মতো কি মৃদুল?

দেখ আবহা আমি অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি তোমাকে কথাগুলো বলার কিন্তু তুমি আমাকে কখনো সুযোগই দাও নি। আবহা দেখ আমি আর আগের মতো করে তোমাকে অনুভব করতে পারি না। আজ প্রায় কতো বছর হলো আমাদের সম্পর্কের? প্রায় ছয় বছর। এই ছয় বছরে আমি একটি বারের জন্যও দেশে আসতে পারি নি। তোমাকে দেখতে পারি নি। এভাবে তো হয় না আবহা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে আগের মতো করে অনুভব করার কিন্তু আমি আর পারছি না। তার উপর তুমি আবার তোমার এসব উটকো ঝামেলার কথা আমাকে শুনাচ্ছো? তুমিই বলো আমার পক্ষে কি কিছু করা সম্ভব এখন? আর দেখো আমি আমার ফ্যামিলির মতের বাহিরে কোন কিছুই করতে পারবো না। আমার বাবা মা আমাকে নিয়ে এমনিতেই অনেক চিন্তার মধ্যে আছে আমি তাদের টেনশান আরো বাড়াতে পারবো না।

আবহা এখন আর কাঁদছে না। কেমন যেন নিজেকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে এখন তার কাছে। মৃদুলের এতগুলো কথার বিপরীতে সে তাকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করলো,

মৃদুল তুমি কি জানো তুমি কি বলছো?

হ্যা আমি বেশ ভালো করেই জানি। এবং তুমিও বেশ ভালো করেই জানো যে আমি না ভেবে চিনতে কোন কথা বলি না। আমি অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলাম তোমাকে কথাগুলো বলার। দেখো তুমি এখন বড় হয়েছ। নিজের কথা চিন্তা করো। নিজের ভবিষ্যতটার কথা চিন্তা করো। আমাকে নিয়ে আর ভেবো না। দেখো জীবনে সবারই কোন না কোন সময় সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এগুতে হয়। আমাকে নাহয় তোমার অতীত ভেবে ঝেড়ে ফেলে দাও। আর আমিও তো নিরুপায় তাই না। আমি কখনো দেশেও আসতে পারবো কিনা তারও তো কোন ঠিক নেই। তুমি বরং তোমার কথা চিন্তা করো.....আমার জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করবে তুমি? আর আমি নিজেও তো.........

আবহার কাছে মনে হতে লাগলো তার চারপাশ কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ওপাশে ফোনে মৃদুল কি বলছে তা আবহা এখন আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আবহা নিজের মনে মনে বলল, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি মৃদুল, আমি তো কখনো তোমাকে আমার কাছে পাই নি, তোমাকে স্পর্শ করতে পারি নি। তারপরও আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি অনুভব করে করে। তোমার প্রতি আমার সেই অনুভবটি সবসময় ছিল। এবং থাকবে মৃদুল...

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কয়েকবার করে হলেও এক ধরণের নিস্তব্ধতা আসে। জীবন শুরুর আগেও যেমন সবকিছু নিস্তব্ধ থাকে ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরও এই নিস্তব্ধতার মাঝেই সবাইকে চলে যেতে হয়। তবে এই জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানেও মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে একবারের জন্য হলেও সেই নিস্তব্ধতা গ্রাস করে। তখন নিজের মনের শব্দগুলোও মানুষ শুনতে পায় না।

ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেয়ার পরও আবহা অনেকক্ষণ ধরে তার কানে মোবাইল ফোনটি লাগিয়ে রাখলো।













আজ পহেলা বৈশাখ।

এই দিনটির জন্য আবহা অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আবহা নতুন শাড়ি কিনেছে, চুড়ি কিনেছে সেই সাথে তার প্রয়োজনীয় আরো অনেক কিছু কিনেছে সে। তবে এ সবকিছু সে কিনেছে আজকেই। অনেক ঘুরে ঘুরে এসব কিনতে হয়েছে তার। সাজসজ্জার দোকানে গেলে অবশ্য এমনিতেই আবহার মাথা ঠিক থাকে না। তাই এসব কেনাকাটা করতে যাবার সময় আবহা সবসময় কাউকে না কাউকে সাথে করে নিয়ে যায়। আজ সে নিয়ে গিয়েছিলো অরণ্যকে সাথে করে। অরণ্য আবহার বন্ধু। অবশ্য তাদের বন্ধুত্বটা খুব বেশি দিনের নয়, এই মাস খানেক আগেই ভার্সিটিতে আবহার সাথে অরণ্যর পরিচয় হয়েছিলো। আবহার সেই ঘটনার পর সে আর মন খুলে কখনো কারো সাথে মিশতে পারে নি। আজো সে পারে না। কিন্তু তারপরও অরণ্যর সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে সে। কিংবা অরণ্য তাকে মানাতে সাহায্য করেছে। আবহা মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে এই কিছুদিন আগে। আরও আগে ভর্তি হবার কথা ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস আগে বেশ ভয়ংকর রকম অসুস্থ হয়ে পরেছিল আবহা। টানা দশদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে নি সে। তার এই অসুস্থতার কারণ কি তা ডাক্তাররা বের করতে পারে নি। সবাই বলেছে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। আবহা কিছু খেতে পারতো না তখন। ঘুমাতে পারতো না, হাসতে পারতো না, কাঁদতে পারতো না, কিছু অনুভব করতে পারতো না। কিন্তু এভাবে তার বেশিদিন যায় নি। একটা সময় পরে এসে আবহা বুঝতে পেরেছিল একজন মানুষের জীবন আরেকজন মানুষের জন্য কখনো আটকে থাকে না, থেমেও যায় না। আবহারও তা যায় নি। কিন্তু না ভুলতে পারার মতো কিছু স্মৃতি তার সেই যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো তাকে দিয়ে গেছে। যা সবসময় তার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে। কোন এক গভীর নিশ্চুপ রাতে সে হয়তো তার সেই স্মৃতিগুলো কিছুক্ষণের জন্য আবার বের করে দেখবে। তারপর সযত্নে তার মনের কোন কোণায় আবার সেগুলোকে লুকিয়ে রাখবে।

মাস্টার্স জীবনের প্রথম সেমিস্টারটা আবহার বেশ বোরিং গিয়েছে। তার কেন যেন তখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করতো না। ক্লাসের এক কোণায় যেয়ে চুপচাপ সে বসে থাকতো। সেমিস্টারের শেষের দিকে অরণ্যর সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিলো। একটা টার্ম পেপার জমা দেয়ার বেলায় আবহাকে সাহায্য করেছিল অরণ্য। সেই থেকে তাদের বন্ধুত্ব শুরু। এখন পুরো ভার্সিটিতে আবহার এই একজনই মাত্র বন্ধু আছে।

আবহা সবকিছু গুছিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলো। কালকে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে তার। উঠে রেডি হতে হবে, শাড়ি পরতে হবে। সে অরণ্যকে বলে রেখেছে তাকে যেন সে নিতে আসে। কাল ভার্সিটিতে যাবে তারা। ভার্সিটিতে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বেশ বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবার। আবহার খুব ইচ্ছা ছিল এবারের অনুষ্ঠানে যাবার। গতবার কোন একটা কারণে সে যেতে পারে নি। এবার তাই আর মিস করতে চাচ্ছে না সে।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আবহা প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। কত কিছু করতে হবে তার। আবহা এখনো ঠিকমতো শাড়ি পরতে জানে না। তাই সে তার চাচাতো বোনকে আনিয়ে রেখেছে তার বাসায় যাতে সে আবহাকে শাড়ি পরতে সাহায্য করতে পারে। আবহা প্রায় রেডি হয়ে গিয়েছিলো ঠিক এমন সময় অরণ্যর ফোন আসলো।

হ্যালো অরণ্য।

হ্যা, কি রেডি হয়েছিস?

হয়েছি তো। তুই কোথায়?

এইতো আমি প্রায় চলে এসেছি। তোদের বাসার কাছেই। তুমি নিচে নেমে আয়।

আচ্ছা আসছি দাঁড়া।

আবহার বেশ উৎফুল্ল লাগছে আজকে। আজ অনেক অনেকদিন পর তার এতোটা ভালো লাগছে। হয়তো আজকের দিনটার মাধ্যমেই সে তার পুরনো সব অতীতকে মুছে ফেলতে পারবে। আবহা তার বাসার নিচে নেমে এলো। ঐতো অরণ্যকে দেখা যাচ্ছে। সবুজ রঙের একটা পাঞ্জাবী পরেছে সে।

কিরে এলি তাহলে?

হ্যা। আমি তো ভেবেছিলাম তোর আরও দেরি হবে। এতো তাড়াতাড়ি রেডি হলি কিভাবে?

আরে বলিস না ঘুম থেকে উঠেছি ভোর ছয়টায়। আর তাছাড়া প্রান্তি ছিল তাই আর দেরি হয় নি। প্রান্তিকে তো চিনিসই?

হ্যা চিনি তো। তোর বোন। তাহলে চল আর দেরি করে লাভ কি?

আগে বাসায় আয়। কিছু খেয়েছিস?

আরে আমি খেয়েই বের হয়েছি। তুই চল তো।

আচ্ছা চল।

আবহারা ভার্সিটিতে পৌঁছল সকালে দশটায়। ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন পর আবহার তার পুরনো দিনের অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। এমনকি তার ছোটবেলার কিছু বন্ধুদের সাথেও তার দেখা হয়ে গেলো। সবাই বেশ হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল ছিল তখন। তবে আবহা একটা ব্যাপার খেয়াল করলো যে তাদের কেউই একা কিংবা তাদের বন্ধুদের সাথে আসে নি। সবাই এসেছে তাদের প্রিয় মানুষটিকে সাথে করে নিয়ে। আবহার কিছুটা খারাপ লাগলো তখন। আবহা কখনোই তার প্রিয় মানুষটির সাথে কখনো কোথাও যেতে পারে নি। যখন মৃদুল ছিল তখন সে তাকে প্রায়ই বলতো অন্তত একটিবারের জন্য তুমি দেশে আসো। আমি একটিবারের জন্য হলেও তোমাকে অন্তত একটু দেখি। তোমার সাথে একবারের জন্য হলেও বৃষ্টিতে ভিজি, একটিবারের জন্য হলেও তোমার হাতটা একটু......

আবহা আর কিছু চিন্তা করতে চাচ্ছে না। মৃদুল তার কথা কখনো শুনে নি। সম্পর্কের প্রথম দিকে সে একবার দেশে আসার জন্য চেষ্টা করেছিল। তারপর আর হয়তো কখনো করেনি। আর এখন তো আর...

কিরে কি চিন্তা করছিস?

অরণ্যর কথায় আবহার সম্বিৎ ফিরে এলো। অরণ্যকে সে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

এখানেই তো। তুই তো দেখলাম অনেক ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলি। কতো মানুষকে যে চিনিস তুই। কারা ওরা?

সবাই আমার বন্ধু। অনেকদিন পর তাদের সাথে দেখা হলো রে। আগে একসাথে কতো মজা করতাম।

ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। এখন চল ঐদিকটায় যাই। কনসার্ট একটু পরই শুরু হবে।

হ্যা চল।

সারাটা দিন আবহার বেশ ভালই কাটল। তারা একসাথে মিলে কনসার্ট উপভোগ করলো, পান্তা ইলিশ খেলো, আড্ডা দিলো। অনেকদিন পর আবহার মন বেশ ভালো হয়ে গেলো। আগের সবকিছু সে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে গিয়েছিলো। বিকেলের দিকে অনুষ্ঠান শেষ হবার পর বাসায় ফেরার পথে সে অরণ্যকে বলল,

অরণ্য, থ্যাংকস রে। আজকের দিনটা আমার আসলেই অনেক ভালো গিয়েছে। এর সব ক্রেডিট তোর।

উত্তরে অরণ্য কিছু বলল না। কেমন যেন একটু বিষণ্ণ আর অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সে। যাবার সময় তারা সিএনজি খুঁজে পেলো না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের বাসে উঠতে হলো। বাসটাও মোটামুটি অনেকটা ফাঁকা ছিল। তাই বসার জন্য পেছনের দিকে দুটো সিটও তারা পেয়ে গেলো। আবহা তখন তার মনে মনে উথাল পাথাল সব চিন্তা করছে। আর সেটা করার একমাত্র কারণ হচ্ছে এই মুহূর্তে তার মৃদুলের কথা একবারও মনে আসছে না। আজ সারাদিনে আসেও নি। হয়তো আজকের দিনটার মাধ্যমেই সে তাকে ভুলে যেতে শিখতে পারবে। আবহা বেশ হাসিখুশি মুখ নিয়ে অরণ্যর দিকে তাকাল। কিন্তু অরণ্য কেমন যেন একটু মুষড়ে আছে বলে আবহার কাছে মনে হলো। কথাও বলছে না তেমন। আবহা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

এই কি হয়েছে রে তোর?

কই কিছু না তো।

তাহলে কথা বলছিস না কেন? এভাবে মুখ গোমড়া করে থাকবি নাতো। আমার দিকে তাকা দেখি। তাকা।

অরণ্য আবহার দিকে তাকাল এবং সাথে সাথে তার মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবহা এবার একটু অবাক হলো। এমন করছে কেন সে?

তুই আমাকে কি বলবি তোর কি হয়েছে?

কিছু না। তোকে আজ সুন্দর লাগছে অনেক।

থ্যাংক ইউ। সেটা তো আমি জানিই। আর আমি তো দেখতে সুন্দরই তাই না।

আবহা আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ সে দেখতে পেলো অরণ্য তার বাম হাতটা আলতো করে ধরেছে। এর আগেও আবহা অরণ্যর হাত ধরেছে কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবহা কেমন যেন জমে গেলো নিজের মধ্যে। এরকম করছে কেন অরণ্য?

আবহা, আমার তোকে কিছু কথা বলার ছিল।

হ্যা বল।

তুই কি কিছুই বুঝিস না?

কি বুঝবো? কিসের কথা বলছিস তুই?

আমি এতদিন ধরে তোর সব প্রয়োজনে তোর পাশে আছি। তোকে সময় দিচ্ছি। তুই যা চাচ্ছিস তাই করছি। তুই কি এসবকিছুর পরও কিছুই বুঝতে পারছিস না?

অরণ্য তুই আমার বন্ধু। আর তুই সবসময় আমার বন্ধু থাকবি। দেখ আমিও তো তোকে সময় দিচ্ছি, হয়তো তোর এখনো কোন কাজে আসতে পারি নি তবে তার মানে এই না যে আমি তোর কাছ থেকে শুধু সুবিধা নিয়েই যাচ্ছি। তুই এসব কথা আমাকে কেন বলছিস? বন্ধুত্বের মাঝে তো এসব কথা আসার কথা না। কি হয়েছে তোর?

হ্যা বন্ধুত্বের মাঝে এসব কথা আসার কথা না কারণ আমি তোকে আমার বন্ধু ভাবি না। আমি পছন্দ করি তোকে। সেটা কি তুই একটিবারের জন্য হলেও বুঝতে পারিস নি?

আবহার চারপাশ কেমন যেন দুলে উঠলো। অরণ্য তার একমাত্র বন্ধু এখন। আর সেই কিনা? আবহা কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড খারাপ লাগতে শুরু করেছে তার। আবহা অরণ্যর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

দেখ অরণ্য, তুই আমাকে হয়তো ঠিকমতো বুঝতেই পারিস নি। আর তুই তো জানিস আমার...

হ্যা আমি জানি। আর জানি দেখেই তোর সাথে আছি যাতে তুই তাকে ভুলে গিয়ে আমার হতে পারিস। কিন্তু তুই তো তুইই। তুই কি ভাবিস আমি তোর জন্য এতো কষ্ট শুধু শুধু করছি? কেন তুই তাকে ভুলতে পারছিস না এখনো?

আবহার কাছে মনে হতে লাগলো তার পাশে বসে থাকা এই মানুষটিকে সে ঠিক যেন চেনে না। এক সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মানুষের সাথে কথা বলছে সে এখন।

অরণ্য তুই আমার বন্ধু, আমার একমাত্র বন্ধু তুই এখন। আর তুইই যদি আমার সাথে এমন করিস তাহলে...

তাহলে কি? তাহলে কি? তুই জানিস তোর জন্য কতো কষ্ট করতে হয়েছে আমার এই কয়েক মাসে? কতো কিছু সেক্রিফাইস করেছি আমি শুধুমাত্র তোকে পাবার জন্য। আর আজ তুই আমাকে বলছিস যে তুই এতদিন ধরে কিছুই বুঝতে পারিস নি।

বুঝতে পারিনি কারণ আমি তোকে আমার বন্ধু ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই...

হ্যা আমি। আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু সেটা তুই বুঝিস নি এবং বুঝবিও না। থাক তুই তোর মতো। আমি জীবনেও আর তোর সাথে যোগাযোগ করবো না। তুই থাক তোর মৃদুলকে নিয়ে।

এই বলে অরণ্য উঠে দাঁড়ালো। ততক্ষণে বনানীর মোড়ে সিগন্যাল পরে গিয়েছে। আবহা কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখতে পেলো অরণ্য তাকে একা রেখে বাস থেকে নেমে পরল। তখন রাত হয়ে গেছে অনেক। পুরো বাসে সেই একটিমাত্র মেয়ে যে কিনা একা বসে আছে এখন। আবহার সারাজীবনে এতোটা অসহায় নিজেকে কখনোই মনে হয়নি। কেন শুধু তার সাথেই এমনটা হচ্ছে? আবহার বুক চিরে কান্না আসতে লাগলো। নিজের হাতে থাকা রঙিন চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে সে নিজের মনেই বলতে লাগলো, মৃদুল, তুমি কেন আমাকে এভাবে একা করে গেলে? তুমি কি কখনো বুঝতে পারো নি কতোটা ভালোবাসতাম আমি তোমাকে? তুমি কি কখনো বুঝতে পারনি আজ তোমার জন্য আমি নিজের কাছে নিজে কতোটা অসহায় হয়ে গিয়েছি। আজ এই মুহূর্তে আমার মতো একা আর কেউ নেই। কেউ নেই মৃদুল।

বাসের অন্যান্য যাত্রীরা দেখতে পেলো তাদের পেছনের সিটে বসা লাল পাড়ের শাড়ি গায়ে একটি মেয়ে মাথা নিচু করে ঠুকরে ঠুকরে কাঁদছে। ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলো এসে পরেছে মেয়েটির মুখে। যাত্রীদের সবার কাছে মনে হলো তারা যেন কোন ইন্দ্রাণীকে দেখছে। মেয়েটি কাঁদছে। কাঁদুক। কেউ তার কান্না থামাতে যাবে না আজ। কারণ তার কোন প্রয়োজন নেই। মেয়েটি কাঁদছে তার চারপাশের সমস্ত কিছুকে আলোকিত করে।

যে আলোর কাছে অন্ধকারের কোন স্থান নেই।

Likes Comments
০ Share