Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মোঃ মাতীন পাগলা

৯ বছর আগে লিখেছেন

হযরত শাহ্‌ জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী

বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গ ইসলামের আলোকে আলোকিত করার  ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্যকরা যায়  তিনি  সুলতানুল বাংলা , হযরত মাওলানা শাহ্‌জালাল মুজার্‌রদ ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি। এতদঞ্চল ধর্ম-বর্ণ,শ্রেণীনির্বিশেষে জন সাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ ব্যাপক ও অতুলনীয়

নামঃ হযরত শাহ্‌জালাল মুজার্‌রদ ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার  পূর্ণ নাম জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ্‌ রহমতুল্লাহি আলাইহি। আপামর জনসাধারণের মাঝে প্রচলিত নাম হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি। ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণের তথ্যগত বিচ্যুতি ও মতভেদের কারনে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের জীবনেতিহাস নিয়ে দ্বন্ধ সৃষ্টি হলেও উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে আমরা বলতে পারি যে হযরত শাহ্‌ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনিই ইবনে বতুতা বর্ণিত জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি যা সমসাময়িক এবং পরবর্তি নির্ভর যোগ্য ঐতিহাসিক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বহুমুখি গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কারনে বাংলার মুসলিম সমাজে  বহু লকব বা গুণবাচক উপাধি দ্বারা বিভূষিত। বিভিন্ন শিলালিপি, ঐতিহাসিক ও মনীষীগণের বর্ণনা ও গবেষকগণের রচনাবলীতে সাধারণত নিম্নলিখিত লকবগুলি পাওয়া যায়ঃ শেখ,শায়খুল মাশায়েখ, কুতুব, মুজার্‌রদ, মখদুম, সুলতানুল বাংলা, আরিফান বুয়দ, কুতুব বুয়দ, মাওলানা, জালালুদ্দীন, তাবরিজী, ইয়েমেনী, কুন্যাভী,তাইজী, সিরাজী, প্রাচ্য-সূর্য, ইত্যাদি। উনার কুনিয়াত হল কোরাইশী। পিতার নামঃ হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর পিতার নাম হযরত শেখ মুহাম্মদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি একজন কোরাইশ বংশীয় স্বনামধন্য খ্যাতিমান দরবেশ ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত দরবেশ হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী উনার খলিফা ছিলেন। সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরি রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মত বুজুর্গ ব্যক্তি হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফয়েজ হাসিল করেন। সুতরাং হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খিলাফত পাওয়া যে কোন লোকের জন্য সহজ বিষয় ছিল না। সম্ভবত এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ কোরাইশী রহমতুল্লাহি আলাইহি জন্মগতভাবে ইয়েমেনী হলেও সূফী ধারা মোতাবেক নামের শেষে তাবরিজী উপাধি ধারণ করায় নাম হয়েছে শেখ মুহাম্মদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি যা বিভিন্ন শিলালিপি ও ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়। শায়খ শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর বিদুষী মাতা ছিলেন সাইয়্যেদ বংশীয় । হযরত শেখ মুহাম্মদ কোরাইশী রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর পিতার নাম ছিল হযরত শেখ ইব্রাহিম কোরাইশী রহমতুল্লাহি আলাইহি। জন্ম তারিখ ও স্থানঃ ঐতিহাসিক ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুসারে গবেষকগণের মতে হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ৫৯৬ হিজরী সনে বিলাদত লাভকরেন এবং ৭৪৬ হিজরী সনে ১৯শে জিলক্বদ বিছাল লাভ করেন। তিনি জমিনে সুদীর্ঘ ১৫০ বছর অবস্থান করেন এবং হায়াত মুবারকের শেষ পর্যন্ত হিদায়তের কাজে আনজাম দেন। উনার জন্মস্থান হল ইয়েমেনের তাইজ নগরীর কুন্যা নামক স্থানে। এখানে একটি বিষয়  উল্লেখ্য যে, কোন কোন লেখক হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি কে আলাদা দু  জন দরবেশ বর্ণনা করেন এবং জালালুদ্দীন তাবরিজীর জন্ম ও ইন্তেকালের তারিখ এবং পান্ডুয়াতে উনার মাযার শরীফ বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু যে সমস্ত গ্রন্থের সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে  তার মূল গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়নিএবং পান্ডুয়াতে উনার মাযার শরীফ নেই বলে সেখানকার খাদেমগণই বর্ণনা করেন। সেখানে উনার জওয়াব সমাধি বা স্মৃতি সৌধ বিদ্যমান। শিক্ষাঃ হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পিতা-মাতা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ভার গ্রহণ করেন উনার বুযুর্গ মামা সৈয়দ আহ্‌মদ কবির সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি সোহ্‌রাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ এবং মক্কার বিশিষ্ট আলেম ছিলেম। হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে তাঁর মুরীদ কর্তৃক মাওলানা সম্বোধন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন আলেম ছিলেন।(মুলত: ইলমে তাসাউফের উচ্চ মাকাম হাসিল কারি গন ইলেম লাদুনি প্রাপ্ত হন অর্থ্যাত আল্লাহ্ পাক উনার প্রদত্ত ইলিম হাসিল করেন। ইতিহাসে আমরা এরকম আরো নজির দেখতে পাই যেমন ইমান আবুল হাসান খারকানি রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কোন দুনিয়াবী শিক্ষক গনের কাছ থেকে ইলিম বা তালিম গ্রহন না করেও তিনি ইলিমে শরিয়ত ও ইলমে তাসাউফ উনার গভির ইলিম রাখতেন)  এছাড়াও হযরত শায়খ্‌ আবু সাঈদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্‌তী রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর মত জগত খ্যাত তরিকতের ইমাম ও বুযুর্গ দরবেশ সাধকগণের শিষ্যত্ব ও সান্নিধ্যও হযরত কুতুব উদ্দীন বখ্‌তিয়ার কাকীরহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়ারহমতুল্লাহি আলাইহি, হাদীস বিশারদ হযরত বাহাউদ্দীন যাকরিয়া মুলতানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বোরহানুদ্দীন সাগরজী রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর মত যুগের দিকপাল মহান মনীষীগণের সাথে গভীর বন্ধুত্ব থাকাটাও প্রমাণ করে যে, হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মি অতিন্দ্রীয় জ্ঞান তো বটেই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জ্ঞান রাজ্যের  বিভিন্ন শাখায় ও বুতপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হযরতের শায়খ/পীরগনঃ হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি শৈশব থেকে প্রায় ২২/২৩/৩০ বছর পর্যন্ত মামা হযরত সৈয়দ আহ্‌মদ কবির সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহিএঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে শরীয়ত ও তাসাউফে (মারফতের) গভির জ্ঞান লাভ করেন। এরপর তিনি আবু সাঈদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বায়াত গ্রহন করেন এবং উনার সোহ্‌বতে প্রায় দুই বছর কাটান। এরপর হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি সোহ্‌রাওয়ার্দী ত্বরিকার ইমাম হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট মুরীদ হন। এ সূত্রে হযরত শেখ সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি হন উনার পীর ভাই বাসতীর্থ। শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রায় ৭ বৎসর শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সোহবতে কাটান। উনার বিসাল শরীফের পর হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সুযোগ্য পুত্র শায়খ হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট মুরীদ হন এবং দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর তাঁর খেদমতে কাটান। বুজুর্গগণের সাক্ষাতঃ ফারসী মালফুযাত ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ অনুসারে হযরত শায়খ্‌ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত শায়খ্‌ শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর মুরীদ থাকাকালে বাগদাদে তিনি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্‌তী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে সাক্ষাত করেন। তারিখে ফিরিশতার বর্ণনা অনুসারে তিনি নিশাপুরে হযরত শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথেও সাক্ষাত করেন। সফরঃ হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কর্মময় জীবনে বহু দেশ সফর করেন তিনি ইয়েমেন মিশর, তুরস্ক, ততকালীন জাজিরাতুল আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের ব্যাপক অঞ্চল সফর করেন। সে সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রগুলোর প্রায় সব জায়গা যেমন মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, নিশাপুর, গারজু, সমরকন্দ, বোখারা, মুলতান, বদায়ুন, দিল্লী, আজমীর ইত্যাদি অঞ্চলগুলো সফর করেন। পাক-ভারত উপমহাদেশে শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি একাধিকবার ভ্রমণ করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজের ও তবকাতে নাসিরীর বর্ণনানুসারে হযরত শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি মুলতানের সুলতান নাসিরুদ্দীন কুবাচা এবং দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুতমিশের শাসনামলে বঙ্গ অঞ্চল সফর করেন। তখন তিনি হযরত শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ ছিলেন। ধর্মপরায়ন সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ হযরত কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর মুরীদ ছিলেন। যখন সুলতান জানতে পারলেন যে শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীতে আগমন করছেন তখন সুলতান সভাসদগণ এবং দিল্লীর আপামর জনগণ হযরতকে সংবর্ধনার জন্য নগরের বাহিরে এগিয়ে গেলেন।শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি সেখানে পৌঁছলে তাঁর সম্মানে সুলতান ঘোড়ার পৃষ্ঠ থেকে নেমে উনাকে স্বাগত জানালেন এবং স্ব-সম্মানে শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন। শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি এরূপ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পাওয়ায় দিল্লীর শায়খুল ইসলাম নজমুদ্দীন সুগরা ঈর্ষান্বিতহয়ে পড়েন। সুলতান ইলতুতমিশ হযরত ও সংগীদের থাকার জন্য শাহী ব্যবস্থা করতে চাইলে নজমুদ্দীন সুগরা শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে পরীক্ষার নাম করে বায়তুল জ্বীন নামে পরিত্যক্ত প্রাসাদে থাকার প্রস্তাব করে। বায়তুল জ্বীন, জ্বীনদের দখলাধীন আবাসস্থল হওয়াতে সেখানে কোন লোকজন থাকতে পারতো না এবং দিনের বেলায়ও সেখানে যেতে সাহস করতো না। প্রভাবশালী সুগরার প্রস্তাবে সুলতান যখন ইতস্ততঃ করছিলেন তখন শায়খ জালাল নিজেই বায়তুল জ্বীনের চাবি চেয়ে নেন। তিনি তাঁর মুরীদ দরবেশ আবু তোরাবের (তাঁর মাজার সিলেট শহরে অবস্থিত) হাতে চাবি দিয়ে বললেন, তালা খুলে ঘরেপ্রবেশ করে উচ্চস্বরে জ্বীনদেরকে বলবে, শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি এখানে এসেছেন তোমরা অনেক দিন পর্যন্ত এখানে আছ, এখন তিনি অবস্থান করবেন, তোমরা অন্য কোথাও চলে যাও। একথা বলে আমার এই হামায়েল শরীফ (ক্ষুদ্র কোরআন শরীফ) সে ঘরে ঝুলিয়ে দিও। কথামত কাজ হল। জ্বীনরা প্রাসাদ ছেড়ে গেল এবং শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি নির্বিঘ্নে সেখানে অবস্থান করলেন। ফওয়ায়েদুস সালেকীন গ্রন্থ অনুসারে হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বর্ণনায় এ সময়ের আরেকটি ঘটনায় নজমুদ্দীন সুগরার ঈর্ষাকাতরতা ও হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বুযুর্গী সম্পর্কে জানা যায়। তিনি বলেন- শায়খুল ইসলাম (নজমুদ্দীন সুগরা) জালালুদ্দীন তাবরিজী সম্পর্কে অপবাদ রটনা করলেন। সুলতানের নিকট অভিযোগ পেশ করা হল। শায়খ্‌ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিচার চাইলেন এবং একজন বিচারক নিয়োগের প্রস্তাব করলেন। নজমুদ্দীন সুগরা উনি প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বললেন, “শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি যাকে বিচারক ঠিক করবেন তার প্রতি আমারও আস্থা থাকবে। শায়খ জালাল বললেন, আমি শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া উনাকে বিচারক মানলাম। বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী তখন দিল্লীতে ছিলেন না। নজমুদ্দীন সুগরা অন্য কাউকে বিচারক ঠিক করার জন্য বললেন এজন্য যে শায়খ যাকারিয়া মুলতানী কবে দিল্লী আসেন ঠিক নেই।  শায়খ জালাল বললেন, আগামীকালই তিনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন। এ কথায় সবাই অবাক হয়ে গেলেন। পরের দিন দরবার শুরুর পর সবাই বিচারকের অপেক্ষায়। হঠাত শোনা গেল বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী রহমতুল্লাহি আলাইহি আসছেন। রাজ দরবারে উপস্থিত হবার পর তিনি প্রথমে হযরত জালালুদ্দীন তাবরিজীর জুতা মোবারক সামনে পেয়ে হাতে নিলেন, চুমু খেলেন ও চোখে লাগালেন। এতে সকলের নিকট শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বুযুর্গী প্রকাশ পেল। অপরাধীরা যার যার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলেন শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রত্যেককে ক্ষমা করে দিলেন। অন্য আরেক বর্ণনায় জানা যায় এ ঘটনার পর সুলতান ইলতুৎমিশ নজমুদ্দীন সুগরাকে শায়খুল ইসলাম পদ হতে অব্যাহতি দেন। এ ঘটনার পর শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ততকালীন ইসলামি ক অন্যতম ভূমি বদায়ুন চলে যান। এ সময় তিনি দিল্লীতে অল্প কিছুকাল অবস্থান করে ছিলেন। বদায়ুন মতান্তরে মুলতান অবস্থানকালে শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন,“এখানে কোন ওলী-দরবেশ আছেন কি? লোকজন বলল, এখানে কাজী বাচ্চা দিওয়ানা নামক একজন দরবেশ আছেন। তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন এবং একটি আনার/বেদানা দিলেন। এ বাচ্চা দিওয়ানা হলেন হযরত শায়খ ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর রহমতুল্লাহি আলাইহি। এটা ছিল উনার উপাধি যদিও তিনি বয়সে বাচ্চা ছিলেন না। আখবারুল আখিয়ার কিতাবের বর্ণনায় আরো জানা যায় যে, সেদিন শায়খ ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর রহমতুল্লাহি আলাইহি রোযা রেখে ছিলেন। এ কারণে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে আনারটি ভাগ করে দেন শুধু নিজের জন্য একটি দানা রেখে দেন। ইফতারের সময় ঐ দানাটি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে অভূতপূর্ব এক আধ্যাত্নিক জয্‌বা দেখা গেল। তিনি ভাবলেন আহা! সবটা আনারই যদি খেতে পারতাম তাহলে কতইনা সৌভাগ্য হত। পরবর্তীকালে স্বীয় মুরশীদ কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলে তিনি বললেন, আফসোসের কি আছে? প্রকৃত পক্ষে ফলটির একটি দানাই যথার্থ ছিল যা তুমি খেয়েছে। শায়খ ফরিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বর্ণনায় বদায়ুনের আরেকটি ঘটনা জানা যায়, শায়খ ফরিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমরা একটি ঘরে বসেছিলাম, এক দই বিক্রেতা সেই পথ দিয়ে অতিক্রম করছিল। প্রকৃত পক্ষে সে ছিল একজন চোর। হযরত শায়খ তাবরিজীর রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রতি তার দৃষ্টি পড়তেই তার ভিতরটা একেবারে পরিবর্তিত হয়ে গেল। সে ইসলাম গ্রহন করলে তার নাম রাখা হয় আলী। এই শায়খ আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শিক্ষার আঁচলে বাধা পড়ে আত্মজ্ঞানের জগতে এমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে বদায়ুনের লোকদের শ্রদ্ধার কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যান। বদায়ুনে খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শিক্ষা সমাপ্তির পর দস্তারবন্দির(পাগড়ী পরানো) সময় উনার ওস্তাদ হযরত আলাউদ্দিন উসুলী এবং শায়খ আলী বা মওলা আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা মাথায় পাগড়ী বেধে দেন। সমসাময়িক ইসরারুল আউলীয়া ও আখতার দেহলভীর তাযকিরায়ে আউলিয়ায়ে হিন্দ অনুসারে জানা যায়, শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি কিছুদিন বদায়ুনে অবস্থানের পর আল্লাহ্‌র হুকুমে বঙ্গাভিমুখে রওয়ানা হন। শায়খ আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সঙ্গে আসতে চাইলে তিনি শায়খ আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি কে বললেন, আল্লাহ্‌র হুকুমে তোমাকে এই শহরের কুতুব নিযুক্ত করলাম। এ কথা শুনে শায়খ আলী থাকতে রাজি হন। মাওলানা উসুলীও প্রারম্ভিককালে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটি বাড়ির সদর দরজায় এসে পৌঁছান। এখানে শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি শায়খ সোহ্‌রাওয়ার্দীর রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে অবস্থান করছিলেন। শায়খ তাবরিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ হয়। আর উনার অন্তনির্হিত শক্তি ও যোগ্যতা অনুভব করে গৃহমধ্যে আহবান করে তিনি তাকে উনার কোর্তাটি প্রদান করেন ও নিরুদ্দেশ্য জীবনের সদুদ্দেশ্য জানিয়ে দেন । মাওলানা উসুলী বিদ্যার্জনের প্রতি প্রবৃত্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যে কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি বিদ্যান রূপে পরিগণিত হন। বদায়ুন থেকে হযরত শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মুসলিম বাংলার প্রথম রাজধানী লখনৌতি বা লক্ষণাবতী আগমন করেন। তখন বাংলার গর্ভণর ছিলেন ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ। বাংলায় যাত্রাপথে শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি কোন এক পুকুর পাড়ে বিশ্রাম করছিলেন। হঠাত উঠে পুকুরে অজু করলেন এবং সঙ্গের লোকদের বললেন, আস, নজমুদ্দীন সুগরার নামাযে জানাজা পড়ি কারণ তিনি এক্ষুনি দিল্লীতে ইন্তেকাল করেছেন। পরবর্তীতে এ ঘটনা সত্যতা  প্রমাণিত হয়। লক্ষণাবতীতে শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ইসলাম প্রচার করেন। তিনি হিন্দুদের প্রধান মন্দিরের কাছে একটি গাছের নিচে আস্তানা স্থাপন করেন। লোকজন ধীরে ধীরে তাঁর নিকট আসতে থাকে এবং তাঁর ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়। অনেক লোক মুসলমানও হয়। লক্ষণাবতী/পান্ডুয়া অঞ্চলে দেও-দৈত্যের উপদ্রবে মানুষ অশান্তিতে দিন যাপন করত। হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি এর প্রভাবে দেও- দৈত্যগুলো ঐ স্থান ত্যাগ করে। এতে মুগ্ধ হয়ে বহু হিন্দু মুসলমান হয়। মন্দিরের কাছেই ইবাদতের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এভাবে বাংলার মুসলমানদের একটি নব যুগের সূচনা হয়। লখনৌতি থেকে তিনি বাগদাদ প্রত্যাগমন করেন। কারণ প্রতি বছর হজ্বের সময় তিনি স্বীয়মুরশীদ শিহাবুদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী উনার খেদমতে উপস্থিত থাকতেন। সিলেটের পথে বাংলায় আগমনঃ বিভিন্ন জীবনী কারগণের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশের সিলেটের আগমনের পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত পীর মুরশীদ ও মামা সৈয়দ আহ্‌মদ কবীর সোহ্‌রাওয়ার্দী এবং সংগীয় পীর বাহাউদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দীর নিকট বর্ণনা  করেন। স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে অবিলম্বে হিন্দুস্তান যাত্রার আদেশ দেন। স্বপ্নের ইঙ্গিত মতে মুরশীদ একমুষ্ঠি মাটি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, এই মাটির বর্ণ,গন্ধ ও স্বাদ যেখানে পাইবে সেখানেই তুমি অবস্থান ঠিক করিবে। তিনি আরও বললেন, এই মৃত্তিকা মুষ্ঠি যে স্থানে পরিত্যাগ করিবে সে স্থানের মহত্ত্বের আর তুলনা থাকিবে না। পীরের নির্দেশের পর হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশে আসার আগে জন্মভূমি ইয়েমেন গমন করেন। সেখানে পূর্বপুরুষ ও মাতা-পিতার মাযার যিয়ারত করেন এবং উলুহিয়াতের তত্ত্ব প্রচার করেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও গুণে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লোক তাঁর দিকে ধাবিত হয়। এতে ইয়েমেনরাজ ঈর্ষান্বিত হয়ে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি কে বিষ মিশ্রিত শরবত দ্বারা কামালত পরীক্ষা করতে চাইলেন। হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বিষ মিশ্রিত শরবত বিস্‌মিল্লাহ বলে পান করলে সে বিষের প্রতিক্রিয়ায় উল্টো ইয়েমেন রাজই মৃত্যুবরণ করে। ইয়েমেনের পরবর্তী রাজা শাহ্‌জাদা আলী পিতার মৃত্যু এবং শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কারামত দেখে উনার ভক্তে পরিণত হন এবং শাসকের তখ্‌তে (সিংহাসনে) না বসে শায়খ শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথী হতে চাইলেন কিন্তু হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাকে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে ইয়েমেন হতে যাত্রা করেন। ইয়েমেন হতে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদ আসেন। বাগদাদে হযরত বাহাউদ্দীন সোহ্‌রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট হতে পুনরায় বিদায় গ্রহন করেন। সেখানে থেকে বিশ্বের প্রধান প্রধান জনপদে কিছু দিন করে অবস্থান করে সমরকন্দ, আফগানিস্তান হয়ে মুলতান উপস্থিত হন। মুলতান হতে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীতে এসে উপস্থিত হন। ইয়েমেনের শাহ্‌জাদা আলী সিংহাসন ছেড়ে এ সময়ে উনার সাথে মিলিত হন। দিল্লীতে হযরত নিজামুদ্দীন আউলীয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে, হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীতে অবস্থান কালে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর একজন মুরিদ জানালেন যে,আরব দেশ থেকে এক দরবেশ এসেছেন তিনি নারী মুখ দর্শণ করেন না। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে পথ চলেন এবং সব সময একজন কম বয়সী সুদর্শন বালক কে সঙ্গে রাখেন। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উতসুক হয়ে একজন মুরিদকে পাঠালেন দরবেশকে নিয়ে আসার জন্য। হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি অবস্থা বুঝতে পেরে প্রেরিত মুরিদের হাতে একটি কৌটার মধ্যে তুলা দিয়ে তার উপরে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার(কয়লা) দিয়ে কৌটার মুখ বন্ধ করে ফেরত পাঠান। হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি  কৌটার মুখ খুলে দেখলেন যে, তুলার উপর একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কিন্তু এতে তুলার একটি আশও জ্বলছে না। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি এ ঘটনা থেকে আগত দরবেশের কামালিয়াত ও ফজিলত বুঝতে পারলেন এবং নিজেই হযরত শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি সাথে সাক্ষাত করেন এবং শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ একজোড়া কবুতর উপহার দেন। সে সময় থেকে আজও এ কবুতর জালালী কবুতর নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। দিল্লী থেকে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মুর্শীদ প্রদত্ত মাটি সহকারে বাংলাদেশে আগমণ করেন। খুলনা, রংপুর ,সোনারগাঁ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। এখানে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হল,  হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান কুমিল্লা সফর করছিলেন তখন কুমিল্লার মাটির সাথে মুর্শীদ প্রদত্ত মাটির মিল পেয়ে তিনি বলেছিলেন কুহু মিলা। কিংবদন্তি অনুসারে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সেখান থেকে কুমিল্লা শব্দটির উতপত্তি। কুমিল্লার যে স্থানটিতে একটি টিলার উপরে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি কিছু দিন অবস্থান করে মোরাকাবা জিকির আসকার ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন ছিলেন, সেখানে উনার কর্তনকৃত চুল ও নখ প্রোথিত আছে। এখানে নয়নাভিরাম টিলার উপরে ঐ আস্তানাটি রয়েছে। আস্তানাকে কেন্দ্র করে একটি জওয়াব সমাধী, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। বর্ণিত রয়েছে যে,এই আস্তানাটির নিকটবর্তী শাহ্‌পুর গ্রামে ভারতের ভাগলপুর হতে আগত প্রায় ২৫০ বছর পূর্বের প্রসিদ্ধ  আউলিয়া হযরত শাহ্‌ নুরুর্দ্দীন আলক্বাদেরী প্রকাশ্যে হযরত বন্দী শাহ্‌ রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রতি বৃহস্পতিবার হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মাজার শরীফ সিলেট থেকে চট্টগ্রাম হযরত শাহ্‌ আমানত রহমতুল্লাহি আলাইহি খানকায় পদব্রজে সফর করতেন। সিলেট বিজয়ঃ সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে ৭০৩ হিজরীতে শাহ্‌জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সিলেট বিজয় করেন। বর্ণিত আছে যে গৌড় গোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহানুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শিশু পুত্র হত্যার প্রতিবিধানার্থে প্রেরিত সিকান্দার গাজীর বাহিনী গৌড় গোবিন্দের ঐন্ত্রজালিক ক্ষমতার কারণে বারবার পরাভুত হয়। অবশেষে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনার অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াইকিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম সহযোগে গৌড় গোবিন্দের ঐন্ত্রজালিক ক্ষমতাকে পরাভূত করে সিলেট বিজয় করেন। রিয়াযত ও সাধনাঃ হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ইবাদত ও রিয়াযত- সাধনার এক বিস্ময়কর প্রতিক। তিনি সায়েমুদ্দহর ও কায়েমুললাইল ছিলেন অর্থাৎ নিষিদ্ধ দিন ব্যতীত সারা বছর দিনে রোজা রাখতেন এবং রাতে ইবাদতের হক আদায় করতেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি কোন রাত্র কিয়ামের জন্য, কোন রাত রুকু, কোন রাত সিজদার জন্য নির্দিষ্ট করে নিতেন । নিম্নে উনার ইবাদত ও রিয়াযত-সাধনার কয়েকটি ঐতিহাসিক বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন,তিনি (শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি) ৪০ বৎসর হতে বরাবর রোযা রাখতেছিলেন। দশ দিন অন্তর তিনি ইফতার করতেন । উনার শরীর মুবারক ছিল পাতলা, আকৃতিতে ছিলেন লম্বা গন্ডদ্বয় ছিল ক্ষীণ। ইবনে বতুতা আরো বলেন ,সে দেশের হিন্দু মুসলমান সকলে শায়খের দর্শনের জন্য আসত এবং উনাকে হাদিয়া(নযরানা) প্রদান করত। তা ফকির ও কাঙাল সকলেই খেত কিন্তু শায়খ কেবল একটি গরুর দুধ পান করতেন। ডঃ জে,ওয়াইজ Notes on Shahjalal the patron saint of Sylhet গ্রন্থে উলেৱখ করেন সুহেল-ই- ইয়ামন গ্রন্থে বর্নিত আছে, for thirty years Shah Jalal Rahmatullah is said to have lived in a cave without Crossing the threshold.” ইসরারুল আউলীয়ায় বর্ণিত আছে যে, শায়খ ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি অধিকাংশ সময় অনাহারে থাকা সত্বেও কাহার নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করিতেন না। একবার তিন দিন পর্যন্ত উনার নিকট কিছুই ছিল না । তিনি ও উনার সাথীগণ তরমুজ দ্বারা ইফতার করতেন । তথাকার (বদায়ুন) শাসনকর্তা এই সংবাদ পাইলেন এবং এ কথাও জানতে পারলেন যে তিনি কাহারও দান-দক্ষিণা গ্রহন করেন না । তাই একজন লোক দ্বারা কিছু আশরফি শায়খের খাদিমের নিকট এ বলে পাঠালেন, যেভাবে ইচ্ছা খরচ কর কিন্তু শায়খ যেন জানিতে না পারেন কোথা হতে এই খরচ হচ্ছে। খাদিম তা গোপন রাখা পছন্দ করলেন না। তিনি শায়খের কাছে সকল কথা খুলে বললেন। শায়খ জিজ্ঞাসা করিলেন – সেই লোক কিভাবে আসিয়াছিল এবং কোথায় কোথায় পা পড়িয়া ছিল? খাদিম সব দেখাইয়া দিলেন, শায়খ বললেন- সেই ব্যাক্তি যেখানে যেখানে পা ফেলিয়া আসিয়াছে তথাকার মাটি খুঁড়িয়া এবং আশরাফি গুলি বাহিরে  ফেলিয়া দাও। হযরত শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর মুরিদ ও খিদমতে ছিলেন সাত বছর। বর্ণিত আছে শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রতি বছর বাগদাদ হইতে পদব্রজে হজ্বে গমন করতেন। বার্ধক্যের জন্য তিনি ঠান্ডা খাবার হজম করতে পারতেন না। গরম খাদ্য পরিবেশনের জন্য শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মাথায় একটি জ্বলন্ত চুলা বহন করতেন। বাগদাদ থেকে মক্কা পর্যন্ত গরম খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতেন। এ প্রসঙ্গে ইসরারুল আউলিয়া গ্রন্থে শায়খ ফরিদউদ্দীন গঞ্জেশকর রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিযি উনার শায়খ বাহাউদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর এতটাই সেবা করতেন যে অন্য কোন মুরীদ এতটা করতেন না। একদা তিনি জ্বলন্ত চুলা মাথায় করিয়া যাচ্ছিলেন। আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় ও যাচ্ছেন ? তিনি উত্তর করলেন , হজ্বে । উনার খিদমতের পদ্বতি দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম – কতদিন যাবৎ তিনি এইভাবে  পীরের খেদমত করছেন? তারা বললেন, পঁচিশ বৎসর যাবত আমরা এমনই দেখিতেছি। হযরতের বুযুর্গীঃ হযরত শায়খ শাহ্‌ জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনা বুযুর্গী ও কামালত সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তায়ালাই উত্তম অবগত। আমরা কয়েকটি ঘটনা ও মনীষীর  উক্তি তুলে ধরছি। হযরত শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি  যখন উনার মামা সৈয়দ আহমদ কবির রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তত্তাবধানে ছিলেন তখন মামার মনোভাব অনুসারে একটি বাঘের যথাযথ উপযুক্ত বিচার সম্পন্ন করার পর সৈয়দ আহমদ কবির রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন জালাল সুমা বকামাল রছিদি। অর্থাৎ জালাল তুমি আত্ম উন্নতির চরম শিখরে পৌছিয়াছ। ফাওয়ায়েদুলফওয়াদ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে , একবার শায়খ শিহবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী মক্কা শরীফ হতে আসার পথে ভক্তগন তাঁকে অনেক নজর- নেয়াজ প্রদান করলেন। এক গরিব বৃদ্ধাও হযরতকে একটি দিরহাম প্রদান করলেন। তিনি তাঁর সাথী দরবেশগণ কে প্রাপ্ত দ্রব্য সামগ্রী থেকে নিতে আদেশ দিলেন এবং সকলেই নিজের ইচ্ছামত সামগ্রী উঠিয়ে নিলেন। হযরত শায়খ জালাল কিছুই নিলেন না। শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি কিছু নিতে বললে শায়খ জালাল গরিব বৃদ্ধার দেওয়া দিরহামটি উঠিয়ে নিলেন। তা দেখে শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, জালালুদ্দীন!  বাহ্যত যদিও তুমি একটি দিরহাম গ্রহণ করলে যাহা সকলের চোখেই নগন্য কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তুমি এমন জিনিস গ্রহণ করলে যা ওই সকল মূল্যবান দ্রব্যাদির  আত্মা স্বরূপ তুমি অন্যান্যদের জন্য কিছুই রাখিলেনা চতুর্দশ শতকের বিশখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে হযরত শাহ্‌জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে কে কেন্দ্র করে লিখেন, অলিয়্য মিনাল আউলিয়া বা আউলিয়াদের ওলি, মিনাল কুবারুল আউলিয়া বা শ্রেষ্ঠ আউলিয়াগনের অন্যতম, মাসিরাল আযিমা বা মহান নির্দেশনাবলির স্থাপয়িতা ও আফরাদুর রিজাল বা মানুষের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে বতুতার বর্ণনায় আরো জানা যায় যে , চীনের বিখ্যাত সূফী সাধক শায়খ বুরহানউদ্দীন সাগরজী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রসঙ্গক্রমে বলেন , আমার ভাই শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি এঁর পদবী ইহা অপেক্ষা অনেক উর্ধ্বে। সংসারের সমস্ত ব্যাপারে তাঁর অধিকার আছে। তিনি আরো বলেন, আমি জানি তিনি প্রত্যেক দিন ফজরের নামায মক্কা শরীফে পড়তেন এবং প্রত্যেক বছর হজ্ব পালন করতেন। তিনি আরাফা এবং ঈদের দিনে অদৃশ্য হয়ে যেতেন কারো কোন খবর হতো না। এছাড়াও ওই সময়ের বিভিন্ন শিলালিপিতে খোদিত আছে, জালালুদ্দীন জালালুলৱাহ আরিফান বুয়দ। অর্থাৎ জালালুদ্দীন আল্লাহর দ্বীপ্তি এবং আরেফগণের গৌরব। জালালুদ্দীন কুতুব বুয়দ অর্থাৎ জালালুদ্দীন কুতুবগনের সুঘ্রাণ। সাকিন আউজ জান্নাত ওয়ালা অর্থাৎ বেহেস্তে তাঁর স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
Likes Comments
০ Share

Comments (0)

  • - তাহমিদুর রহমান

    সুন্দর পোস্ট। ৭৪ জন দেখেছেন অথচ কোন মন্তব্য নেই! 

    - রব্বানী চৌধুরী

    বেঁচে থাকার জন্য ও জীবন ধারণের বা সুস্থ্য জীবন যাপনের জন্য তথ্য সমৃদ্ধ পোষ্টটি শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা জানবেন ভালো থাকবেন।

     

    - Azimul Haque

    খুবই উপকারি একটা পোষ্ট। 

    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

    Load more comments...